বাবর বার্তা

উপমহাদেশের ক্রিকেট জ্বর বহু পুরনো। ক্রিকেটের প্রতি এই উন্মাদনা যেমন বহু তরুণকে স্বপ্ন জুগিয়েছে, তেমনি পাহাড়সম প্রত্যাশার চাপে চুরমার করে দিয়েছে অনেক তরুণের ক্যারিয়ারও। চমক জাগানিয়া অভিষেকের পরও বিনোদ কাম্বলি বা বাসিত আলীর মত প্রতিভাবান খেলোয়াড় অপ্রত্যাশিতভাবে হারিয়ে গিয়েছেন। তবুও প্রতিনিয়ত নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন বাবর। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন ফ্যাভ-ফোর নয়, বরং ফ্যাভ-ফাইভ হয়ে বিরাট কোহলি, জো রুট, কেন উইলিয়ামসন আর স্টিভ স্মিথের সাথে এক কাতারে উচ্চারিত হবে বাবর আযমের নাম।

২০১৭ সালে বোলিং নির্ভর পাকিস্তান দল খেই হারিয়ে ফেলে তাদের বড় দুই ব্যাটিং বীর মিসবাহ উল হক আর ইউনুস খানের অবসরের ঘোষণায়। টালমাটাল হয়ে পড়ে পাকিস্তানের ব্যাটিং ভবিষ্যৎ। ম্যাচ জেতার চেয়ে যখন হোমগ্রাউন্ডে ম্যাচ আয়োজন করার দিকেই বেশী মনোযোগ দিচ্ছিলো পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি), তখন ব্যাটিং অর্ডারের রক্ষাকর্তা হয়ে উদয় হন বাবর আযম। তাঁর আগমনী ঝড় পাকিস্তানের ক্রিকেটকে শুধু আশার আলোই দেখায়নি, বরং পুরো বিশ্বকেই আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছিলো পাকিস্তানের পুরনো বিধ্বংসী চেহারা।

২০১৫ সালে বাবরের অভিষেক ঘটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে। চমৎকার এই অভিষেকের পর তার ওপর এক ধাক্কায় নেমে আসে প্রত্যাশার পাহাড়। চাচাতো ভাই কামরান আকমলও পাকিস্তান ক্রিকেটের অন্যতম ভরসাস্থল হওয়ায় অন্যসব তরুণ খেলোয়াড়দের চেয়ে তার ওপর চাপটা যেন একটু বেশিই ছিলো। কিন্তু দুর্দান্ত সূচনার পরপরই নিজেকে হারিয়ে ফেলতে শুরু করেন তিনি।

প্রায় পুরো একটা বছর ফর্ম ফিরে পাননি। যে সমর্থকরা তাকে মাথায় তুলে রেখেছিলো, তাঁরাই এবার তাঁকে ‘ওভাররেটেড’ বলে ডাকতে শুরু করলো। কোন সাধারণ খেলোয়াড় হলে হয়তো সেখানেই থেমে যেত তার ক্যারিয়ার। কিন্তু না। নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে ফিরে এলেন বাবর, দারুণ দক্ষতায় নিজের জাত চেনালেন। জানালেন, হারিয়ে যেতে নয় বরং মুঘল সম্রাট বাবরের মতই রাজ করতে এসেছেন তিনি। শুরু হলো পাকিস্তান ক্রিকেটের বাবর রূপকথা।

আজকের বাবর পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। তাঁর হয়ে কথা বলে তাঁর ব্যাট। টেস্ট হোক বা ওয়ানডে, বাবরের ব্যাট কিন্তু থেমে নেই। ২৯ টি টেস্ট ম্যাচ খেলে সংগ্রহ করেছেন ২০৪৫ রান। ওয়ানডেতে খেলেছেন ৭৪টি ম্যাচ, রানসংখ্যা তিন হাজারের ওপরে। সেঞ্চুরি হাঁকাতেও কার্পণ্য করেননি। ১৬টি সেঞ্চুরির পাঁচটি অর্জন করেছেন টেস্টে। বাকি এগারোটি পঞ্চাশ ওভারের খেলায়। দলের কেউই তার এমন পারফরম্যান্সের আশেপাশে নেই। ফর্ম আর ধারাবাহিকতার সমন্বয় তাঁকে এনে দিয়েছে দলের অধিনায়কত্ব। সে গুরুদায়িত্বও পালন করে চলেছেন সমানতালে।

অনেকেই বাবরকে তুলনা করেন পাকিস্তানের কিংবদন্তি ক্রিকেটার ইনজামাম উল হকের সাথে। ইনজামামের ক্যারিয়ারের শুরুটাও ছিলো দেখার মতই। মাত্র ২২ বছর বয়সে স্বয়ং ইমরান খানের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়! কিন্তু ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপের পর তিনিও ফর্ম হারিয়ে ফেলেন। প্রায় চার বছর নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন।

১৯৯৬ সালে শেষমেশ প্রসন্ন হন ভাগ্যদেবতা। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি ইনজামামকে। একের পর এক জাদু দেখিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন এমন এক উচ্চতায়, যেখানে তাকে ছাড়া পাকিস্তান ক্রিকেটের কথা ভাবাই যায়না৷ বাবরকে এখনি ইনজামামের সমতূল্য ভাবা না গেলেও বলতে বাঁধা নেই, দ্রুতই বাবর নিজের স্থান করে নেবেন ইউনিস খান, জহির আব্বাস, হানিফ মোহাম্মদের মত খেলোয়াড়দের পাশে। পরিসংখ্যানও সায় দেয় এই কথায়।

বাবরের বয়স এখন ২৬, যেখানে অধিকাংশ ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ারের স্বর্ণযূগ হলো ২৯ থেকে ৩৩ বছর বয়স। অর্থাৎ, বাবরের সামনে এখনো অনেকটা পথ বাকি নিজেকে আরো বেশি প্রমাণ করবার। বাবর যে প্রতিনিয়ত সে পথেই এগোচ্ছেন, তার সাক্ষ্য দেয় গতকালের পাকিস্তান বনাম জিম্বাবুয়ে ম্যাচে তাঁর ৫৫ বলে ৮২ রানের বিধ্বংসী ইনিংস।

উপমহাদেশের ক্রিকেট জ্বর বহু পুরনো। ক্রিকেটের প্রতি এই উন্মাদনা যেমন বহু তরুণকে স্বপ্ন জুগিয়েছে, তেমনি পাহাড়সম প্রত্যাশার চাপে চুরমার করে দিয়েছে অনেক তরুণের ক্যারিয়ারও। চমক জাগানিয়া অভিষেকের পরও বিনোদ কাম্বলি বা বাসিত আলীর মত প্রতিভাবান খেলোয়াড় অপ্রত্যাশিতভাবে হারিয়ে গিয়েছেন। তবুও প্রতিনিয়ত নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন বাবর। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন ফ্যাভ-ফোর নয়, বরং ফ্যাভ-ফাইভ হয়ে বিরাট কোহলি, জো রুট, কেন উইলিয়ামসন আর স্টিভ স্মিথের সাথে এক কাতারে উচ্চারিত হবে বাবর আযমের নাম।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...