আমাদের একটা শচীন ছিল

তখন আসলে দিনকাল অন্যরকম ছিল বস; টেস্ট হোক কিংবা ওয়ান ডে, সকাল ১০টা বা দুপুর দুটোয় টিভির সামনে বসে পড়তে হতো, এমআরএফ এর স্টিকার লাগানো উইলোটা হাতে নিয়ে লোকটা বাইশ গজে কী কী সব কাণ্ড কারখানা করে তা দেখার জন্য। আসলে আমাদের তখন একটা শচীন ছিল।

ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ, ইনস্টাগ্রাম বা টুইটার তখন অনেক দূরের গ্রহ। ইন্টারনেট – তাঁকেও তো হাত বাড়ালে সহজে পাওয়ার উপায় নেই, যখন তখন ক্রিকবাজ-ক্রিকইনফো খুলে স্কোর দেখা – সে আবার কেমন ব্যাপার! তখন আসলে দিনকাল অন্যরকম ছিল বস; টেস্ট হোক কিংবা ওয়ান ডে, সকাল ১০টা বা দুপুর দুটোয় টিভির সামনে বসে পড়তে হতো, এমআরএফ এর স্টিকার লাগানো উইলোটা হাতে নিয়ে লোকটা বাইশ গজে কী কী সব কাণ্ড কারখানা করে তা দেখার জন্য।

আসলে আমাদের তখন একটা শচীন ছিল।

তখন আজকালকার দিনের মতো ইডেনে টেস্ট হলে গ্যালারির একটা সিট্ও ফাঁকা থাকতো না, সিজন টিকিট বা ডেইলি টিকিটের জন্য হপ্তাখানেক আগে থেকেই হুড়োহুড়ি পড়তো, দিনকাল তখন অন্যরকম ছিল গুরু। লোকে অফিস কাট মেরে ইডেন যেত লোকটার সেঞ্চুরি দেখবে বলে, প্রেমিকরা ডেট ক্যানসেল করতো নীল রঙা জার্সি গায়ে লোকটাকে ব্যাট করতে দেখবে বলে। আরে তখনকার দিনে হটস্টার ছিল না, যে যখন যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থাতেই দেখে নেবে ম্যাকগ্রা, ডোনাল্ডদের ঠ্যাংগানি দিচ্ছে লোকটা। সবাই আসলে লোকটার ব্যাটিং দেখবে বলেই অনেক কৃচ্ছসাধন করতো।

আসলে তখন আমাদের একটা শচীন ছিল।

অন্যসব দেশে তখন কতসব তারকা। অস্ট্রেলিয়া তো সোনায় মোড়া দল, এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায় দেখ। প্রতিবেশী পাকিস্তান – তাঁদের ই কী কম নাকি, এমনকি শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ – হাতে তাঁদের কী সব ব্যাটসম্যান আর কী সব বোলার, বাপরে! আমাদের ও আছে সৌরভ, দ্রাবিড়, লক্ষণ, শেবাগ, যুবরাজ, শ্রীনাথ, জাহির, কুম্বলে – কিন্তু ঐ যে সবার ওপরে শচীন সত্য, তাহার উপরে নাই।

না হলে বলুন না কেন ঐ লোকটা ’৯৬ এর সেমিফাইনালে আউট হবার পর তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে দলের ব্যাটিং? কেন ’৯৯ বিশ্বকাপের সময় সদ্য পিতৃহারা উথালপাথাল করা মন নিয়ে তাঁকেই দেশকে উদ্ধার করতে আসতে হবে? কেনই বা ২০০৩ এর কাপ ফাইনালে ৩৬০ তাড়া করতে নেমে ঐ লোকটার ওপর ই সবচেয়ে ভরসা করতে হবে, কেন না লোকটা গোটা বিশ্বকাপে অবিশ্বাস্য ব্যাটিং করে তার আগে ৬৬৯ রান করে ফেলেছেন।

তাই তো ফাইনালে ৪ রানে লোকটা আউট হলে টিভি বন্ধ করে দেয় জনতা, কিংবা পিতৃহারা সেই যুবক সেঞ্চুরি করে আকাশের দিকে ব্যাট তুলে বাবাকে খুঁজলে ভারী হয়ে আসে আমাদের চোখ ও। বুড়ো হয়ে গেলেও তাই বোধহয় বলতে পারবো – আসলে আমাদের একটা শচীন ছিল।

গোটা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এতো এতো রানের স্ট্যাটিসটিক্স – সেতো এমনি ই কেউ করেনি, ছেড়ে বেরিয়ে আসুন ওসব, বছরের পর বছর ধরে শতকোটি দেশবাসীর চাপ মাথায় নিয়ে বাইশগজে দাপিয়ে বেড়িয়েছে, এটা কী কম কিছু? অবিশ্বাস্য লাগে না?  বিস্ময় বালক হয়ে কিশোর পেরিয়ে যৌবনের মাঝামাঝি পর্যন্ত শুধু চেয়ে গিয়েছে একটা অন্তত বিশ্বকাপ, হ্যাঁ সেটাও পেয়েছে সে।

সতীর্থরাই যেখানে বিশ্বকাপ শুরুর আগে সদর্পে ঘোষণা করে দেয় শচীনের জন্যই বিশ্বকাপ জিততে চাই, আর ৩৮ বছর বয়সে পৌঁছেও সেই বিশ্বকাপে দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান – আবার কার, সেই এমআরএফ হাতে নামা ১০ নম্বর জার্সিধারীরই। অধরা মাধুরী ছোঁয়ার দিন নিজের উত্তরসূরী বিরাটের কাঁধে চেপে ওয়াংখেড়ের মাটিতে সকলের অলক্ষ্যেই লোকটা সেদিন ব্যাটনটা যেন হস্তান্তর করে দেন কিছুটা, আর তাই তাঁর উত্তরসূরী বিরাট ও বোধহয় সারাজীবন বলবেন – আমাদের একটা শচীন ছিল।

আপনি হয়ত বলবেন বড়ো ম্যাচে কী এমন রান করেছে শচীন, ক’টা টেস্ট নিজে হাতে জিতিয়েছে শচীন, বিশ্বকাপ ফাইনালে শচীন কী করেছে? আমি বলবো ওসব মাথা থেকে বের করে দিন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যতবার শচীন ব্যাট করতে গিয়েছেন ততবার যেন অদৃশ্য জাতীয় পতাকাকে বহন করে নিয়ে গিয়েছেন কাঁধে, দেশের মান রক্ষার সব দায়িত্ব যেন তাঁর ই কাঁধে।

আর বাকিরা? বিচার আপনার, কিন্তু তিনিও রক্তমাংসেরই মানুষ, তাই জন্য ২০১৩ সালের ১৬ নভেম্বর শেষ বারের মত ওয়াঙখেড়ের বাইশগজকে বিদায় জানানোর সময় তাঁর চোখ ও জলে ভরে ওঠে, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো সেই সময় আপনার চোখের কোণেও দু ফোঁটা জল আসেনি? কিংবা সেই ক্রিকেটের ওবামা বক্তৃতা বলে খ্যাত বিদায়ী সন্ধিক্ষণের সেই বক্তৃতা শেষে আপনার একটুও কষ্ট হয়নি যে শচীনকে আর কখনো ভারতের হয়ে ব্যাট করতে দেখতে পাবেন না বলে? হ্যাঁ আপনার চোখের কোণটাও চিকচিক করে উঠেছিল, আর আপনিও নির্ঘাত অস্ফুটে বলে উঠেছিলেন – আমাদের একটা শচীন ছিল।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...