দ্য ফাইনাল ডিসাইডিঙ মোমেন্ট

ক্রিকেট বিশ্বকাপ মানেই উত্তেজনার কমতি নেই। রোমাঞ্চকর এক টুর্নামেন্ট। পুরো ক্রিকেট দুনিয়ায় আলাদা এক উন্মাদনা। এখন পর্যন্ত ওয়ানডে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে ১২ বার। আর এই ১২ আসরের মাঝে সর্বোচ্চ পাঁচবার শিরোপা জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপের ফাইনালের রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে সবচেয়ে সফল দলটি অস্ট্রেলিয়াই।

ক্রিকেট বিশ্বকাপ মানেই উত্তেজনার কমতি নেই। রোমাঞ্চকর এক টুর্নামেন্ট। পুরো ক্রিকেট দুনিয়ায় আলাদা এক উন্মাদনা। এখন পর্যন্ত ওয়ানডে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে ১২ বার। আর এই ১২ আসরের মাঝে সর্বোচ্চ পাঁচবার শিরোপা জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপের ফাইনালের রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে সবচেয়ে সফল দলটি অস্ট্রেলিয়াই।

বিশ্বকাপ ফাইনালের লড়াইয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরানো সেরা মূহুর্তগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক। জয়ের কাছ থেকেও হেরে যাওয়া কিংবা হারের মুখ থেকে উঠে এসে শিরোপা জয় – সেই গুরুত্বপূর্ণ, রোমাঞ্চকর আর রোমহর্ষক মুহূর্তগুলোর স্মৃতিচারণা করা যাক।

  • ১৯৭৫ বিশ্বকাপ ফাইনাল

২১ জুন, ১৯৭৫। বিশ্বকাপের প্রথম আসর। লর্ডসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়া। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৫০ রানে টপ অর্ডারের তিন ব্যাটারকে হারিয়ে বিপাকে পড়ে ক্যারিবীয়রা। এরপর দলের হাল ধরেন অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড ও রোহান কানহাই। সেখান থেকে কানহাইর ৫৫ ও লয়েডের ঝড়ো সেঞ্চুরিতে ৮ উইকেটে ২৯১ রান সংগ্রহ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৮৫ বলে ২ ছক্কা ও ১২ চারে ১০২ রান করেন লয়েড।

জবাবে ব্যাট করতে নেমে অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেলের ৬২ রানে ভর করে ২৭৪ রান তুলতে সক্ষম হয় অস্ট্রেলিয়া। ১৭ রানের জয়ে বিশ্বকাপের প্রথম আসরেই শিরোপা জেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

  • ১৯৮৩ বিশ্বকাপ ফাইনাল

১৯৮৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ভারতের দেওয়া মাত্র ১৮৪ রানের লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে ৫৭ রানে তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই উইকেট নেই। ভিভ রিচার্ডস সাত বাউন্ডারিতে তখন ২৭ বলে ৩৩ রানে অপরাজিত। ভারতের এই ম্যাচে জয়ের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ভিভের ব্যাটিংয়ে মনে হচ্ছিল যত দ্রুত ম্যাচ শেষ করা যায়! কিন্তু দলীয় ৫৭ রানে মদন লালের বলে মিড উইকেটের উপর দিয়ে মারতে যান ভিভ। তবে ব্যাটে বলে ঠিকমত না হওয়ায় বলটি উপরে উঠে যায়। স্কোয়ার লেগ থেকে উলটো দিকে দৌড়ে গিয়ে দুর্দান্ত এক ক্যাচে ভিভকে ফেরান ভারতীয় অধিনায়ক কপিল দেব!

ওই উইকেটের পরই পালটে যায় ম্যাচের চিত্র। ভিভ ৩৩ রানে ফেরার পর মাত্র ১৪০ রানে গুড়িয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৪৩ রানের জয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তোলে ভারত।

  • ১৯৮৭ বিশ্বকাপ ফাইনাল

৮ নভেম্বর, ১৯৮৭। ইতিহাসের চতুর্থ বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ডেভিড বুনের ফিফটিতে ৫ উইকেটে ২৫৩ রান সংগ্রহ করে অস্ট্রেলিয়া। জবাবে লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে ২ উইকেটে তখন ইংলিশদের সংগ্রহ ১৩৫ রান। ম্যাচ তখন ইংলিশদের পক্ষেই ছিল। দলীয় ১৩৫ রানে অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডারের বল রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে ইংলিশ অধিনায়ক মাইক গ্যাটিং টপ এজ হয়ে ধরা পড়েন গ্রেগ ডায়ারের হাতে।

গ্যাটিং ফিরেন ৪১ রানে। এরপর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে আর লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি ইংল্যান্ড। মাত্র ৭ রানে হেরে বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের স্বপ্নভঙ্গ হয় ইংলিশদের। গ্যাটিংয়ের পর অসাধারণ খেলা অ্যালান লাম্বও ৪৫ রানে ফিরলে ইংল্যান্ডের হয়ে আর ম্যাচে হাল ধরতে পারেননি কেউ।

  • ১৯৯২ বিশ্বকাপ ফাইনাল

১৯৯২ সালে মেলবোর্নে বিশ্বকাপের পঞ্চম আসরের ফাইনালে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের দেওয়া ২৫০ রানের লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে ৯২ বলে তখন ১০৯ রান প্রয়োজন ছিল ইংলিশদের। হাতে ছিল ৬ উইকেট! ম্যাচ তখন ইংল্যান্ডের পক্ষেই ছিল।

এরপর ইনিংসের ৩৫তম ওভারে পর পর দুই বলে অ্যালান লাম্ব ও ক্রিস লুইসকে ফিরিয়ে ম্যাচ নিজেদের আয়ত্তে আনেন ওয়াসিম আকরাম! আকরামের এক ওভারেই পালটে যায় ম্যাচের মোড়। শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ড ২২৭ রানে অলআউট হলে ২২ রানের জয়ে ইমরান খানের নেতৃত্বে প্রথমবার বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তোলে পাকিস্তান।

  • ১৯৯৬ বিশ্বকাপ ফাইনাল

১৯৯৬ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো শিরোপা জয়লাভ করে শ্রীলঙ্কা। সেবার ফাইনালে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে ৭ উইকেটে পরাজিত করে লঙ্কানরা। অজিদের দেওয়া ২৪২ রান তাড়া করতে নেমে মাত্র ২৩ রানে ২ উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে লঙ্কানরা।

এরপর দ্রুতই আসাঙ্কা গুরুসিনহা ব্যাকওয়ার্ড স্কোয়ার লেগে ক্যাচ তুলে দেন! কিন্তু সেই সুযোগ মিস করেন স্টুয়ার্ট ল! সেখান থেকে ৬৫ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলে দলকে জয়ের ভীত গড়ে দেন গুরুসিনহা। যদিও অরবিন্দ ডি সিলভার অপরাজিত ১০৭ রানে ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানের জয়ে শিরোপা ঘরে তোলে লঙ্কানরা।

  • ১৯৯৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল

১৯৯৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে ঐতিহাসিক লর্ডসে মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তান। দুই দলের সামনের দ্বিতীয়বার শিরোপা জয়ের হাতছানি। টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ে নেমে শেন ওয়ার্ন ম্যাজিকে মাত্র ১৩২ রানেই শেষ পাকিস্তান! প্রথম ৫ ওভারে বিনা উইকেটে ছিল ২১ রান।

সেখান থেকেই হঠাৎ ছন্দপতন। গ্লেন ম্যাগ্রার বলে দলীয় ২১ রানে দ্বিতীয় স্লিপে দুর্দান্ত এক ক্যাচে ওয়াজাতুল্লাহ ওয়াস্তিকে ফেরান মার্ক ওয়াহ। এরপর ডেমিয়েন ফ্লেমিং, টম মুডি, শেন ওয়ার্নদের সামনে আর দাঁড়াতে পারেনি পাকিস্তান।

পাকিস্তানের ১৩২ রানের জবাবে সহজ লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে ৮ উইকেটের বড় জয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তোলে অস্ট্রেলিয়া।

  • ২০০৭ বিশ্বকাপ ফাইনাল

২০০৭ বিশ্বকাপ ফাইনাল। অস্ট্রেলিয়ার সামনে টানা তৃতীয়বার শিরোপা জয়ের হাতছানি। ব্রিজটাউনে ফাইনালে শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি অজিরা। বৃষ্টিবাঁধায় খেলা নেমে আসে ৩৮ ওভারে। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের তাণ্ডবে ওপেনিং জুটিতে আসে ২২.৫ ওভারে ১৭২ রান!

গিলক্রিস্টের তাণ্ডবময় ১০৪ বলে ৮ ছক্কা ও ১৩ চারে ১৪৯ রানের ইনিংসে ৪ উইকেটে ২৮১ রান সংগ্রহ করে অস্ট্রেলিয়া। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ৮ উইকেটে ২১৫ রান করে শ্রীলঙ্কা। ডার্কওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে ৫৩ রানের জয়ে টানা তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জেতে অস্ট্রেলিয়া।

গিলক্রিস্টের সেই ইনিংসের পেছনে অবশ্য স্কোয়াশ বলের কারিশমাও ছিল। অনুশীলনে প্রায়ই তিনি গ্রিপিংয়ের জন্য স্কোয়াশ বল ব্যবহার করতেন গিলি। যদিও আন্তর্জাতিক ম্যাচে কখনো ব্যবহার করেননি। তবে কোচের পরামর্শে সেবার বিশ্বকাপে তিনি স্কোয়াশ বল ব্যবহার করেন। কিন্তু প্রথম ৬ ম্যাচে দেখা পান মাত্র এক ফিফটির। এরপর স্কোয়াশ বল ছাড়া সেমিফাইনালে ব্যাট করতে নেমে ফিরলেন মাত্র এক রানে!

এরপর ফাইনালে আবার নামলেন স্কোয়াশ বল নিয়েই। খেললেন তাণ্ডবময় এক ইনিংস। বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংসটি সেদিন খেলেছিলেন গিলি। অবশ্য সেঞ্চুরির পর ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের দিকে দেখিয়ে স্কোয়াশ বল ইশারা করছিলেন তিনি। বাঁ হাতেই ছিল সেই স্কোয়াশ বল।

  • ২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনাল

২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওয়াংখেড়েতে মুখোমুখি হয় স্বাগতিক ভারত ও শ্রীলঙ্কা। দুই দলের সামনেই দ্বিতীয়বার শিরোপা জয়ের হাতছানি। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে মাহেলা জয়াবর্ধনের সেঞ্চুরিতে ৬ উইকেটে ২৭৪ রান সংগ্রহ করে শ্রীলঙ্কা। জবাবে ব্যাট করতে নেমে লাসিথ মালিঙ্গার বোলিং নৈপুণ্যে ৩১ রানে ২ উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে ভারত।

ম্যাচে তখন লঙ্কানদের আধিপত্য। এরপর গৌতম গম্ভীর ও বিরাট কোহলির ব্যাটে ৮৩ রানের জুটিতে আবারও জয়ের স্বপ্ন দেখে ভারত। দলীয় ৬৮ রানে ডিপ মিড অফে গম্ভীরের একটি কঠিন সুযোগ মিস করে লঙ্কানরা। সেখান থেকে গম্ভীর খেলেন ৯৭ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংস। ৬ উইকেটের জয়ে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জয় করে ভারত।

  • ২০১৫ বিশ্বকাপ ফাইনাল

২০১৫ বিশ্বকাপ। তাসমান পাড়ের দুই দেশের লড়াই। মেলবোর্নের অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি নিউজিল্যান্ড। ইনিংসের প্রথম ওভারেই দুর্দান্ত এক ইয়োর্কারে নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালামের স্টাম্প উপড়ে দেন মিশেল স্টার্ক। এরপরই নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে ব্ল্যাকক্যাপরা।

৩৯ রানে ৩ উইকেট থেকে দলের হাল ধরেন রস টেলর ও গ্র‍্যান্ট এলিয়ট। কিন্তু ১১১ রানের জুটির পথে দলীয় ১৫০ রানে একই ওভারে টেলর ও কোরি অ্যান্ডারসনকে ফিরিয়ে নিউজিল্যান্ডকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দেন জেমস ফকনার। এরপর আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি ব্ল্যাকক্যাপসরা।

শেষ পর্যন্ত ১৮৩ রানেই গুড়িয়ে যায় নিউজিল্যান্ড। জবাবে ব্যাট করতে নেমে স্টিভ স্মিথ ও মাইকেল ক্লার্কের ফিফটিতে ৭ উইকেটের জয়ে শিরোপা জয় করে অজিরা।

  • ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল

২০১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের দেওয়া ২৪২ রানের লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে শেষ ৩ বলে ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ৯ রানের। স্ট্রাইকে তখন ইংলিশ অলরাউন্ডার বেন স্টোকস। ট্রেন্ট বোল্টের ফুলটস বল ডিপ মিড উইকেটে পাঠিয়ে দুই রানের জন্য দৌড় দিলেন স্টোকস। বাউন্ডারি লাইন থেকে বল কুঁড়িয়ে স্ট্রাইক প্রান্তে থ্রো করেন মার্টিন গাপটিল। ঠিক সেসময় রান আউট থেকে বাঁচার জন্য ড্রাইভ দেন স্টোকস। আর বল সরাসরি স্টোকসের ব্যাটে লেগে উইকেটের পেছন দিয়ে বাউন্ডারি!

স্টোকস অবশ্য সাথেই সাথেই হাত উঠিয়ে জানান দেন এটি সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত। যেখানে ২ বলে যেখানে ৭ রানের দরকার হতো সেখানে এক অতিরিক্ত বাউন্ডারিতে শেষ ২ বলে দরকার ছিল মাত্র ৩ রানের! অবশ্য বোল্টের অসাধারণ বোলিংয়ে ম্যাচটি টাই হয়। এরপর সুপার ওভারও টাই হলে বাউন্ডারিতে এগিয়ে থাকার কারণে শিরোপা উঠে ইংল্যান্ডের হাতে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...