জিম্বাবুয়ে ‘দ্য জায়ান্ট কিলার’ ডেভিড

দলীয় ১৩৮ রানের সময় ওসেলসের রান আউট ফেভারিট বানিয়ে দিল পুঁচকে জিম্বাবুয়েকে! সেই সময়ের বর্ননা দিতে গিয়ে হটন বলেন, ‘আমি শুধু ভাবছিলাম, এখন আর আমরা আমাদেরকে এই ম্যাচ হারতে দিতে পারি না। তাদের ছয়জন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ছিল, কিন্তু আমাদের চারজন বোলার ছিল যারা বাঁহাতিদের বিপক্ষে বিশ্বসেরা।’

দ্য বুক অব স্যামুয়েলের ডেভিড এবং গোলিয়াথের যুদ্ধের কথা মনে আছে? সেই যে অপরাজেয় বিশালাকায় গোলিয়াথকে পরাজিত করেছিল পুঁচকে ডেভিড! রুপক হিসেবে অসমতার ব্যাখ্যায় মানুষের মুখে মুখে এখনো ফেরে তাদের নাম। স্পোর্টসেও উদাহরণ হিসাবে এই দুজনের নাম উঠে এসেছে বারবার। ফুটবলসহ অন্যান্য স্পোর্টসে ডেভিডের বিজয় খুব একটা বিরল না হলেও ক্রিকেটে কিন্তু অসম লড়াইয়ে গোলিয়াথরাই বারবার বিজয় মুকুট পড়েছে।

তবে, কিছু ক্ষেত্রে যে ডেভিডরা জেতেনি তা নয়, বরং চমকের পসরা সাজিয়ে ক্রিকেটবিশ্বকে থমকে দিয়েছে তারা। আজ তেমনই এক ডেভিড-গোলিয়াথের কাহিনি শোনাবো, যেখানে প্রতি মুহূর্তে আপনাকে চমকাতে হবে। হাতে বেশ কিছুটা সময় এবং ধৈর্য থাকলে চলুন ঘুরে আসি সাদা-কালো যুগের ক্রিকেট থেকে।

১৯৮০ সালে স্বাধীনতা লাভের পূর্বে জিম্বাবুয়ের নাম ছিল রোডেশিয়া! এই নামেই তারা দক্ষিন আফ্রিকার ‘কারি কাপ’ নামক ঘরোয়া লিগে খেলত। ১৯৮০ সালে স্বাধীনতা লাভের পর নতুন করে ক্রিকেট জোয়ার শুরু হয় জিম্বাবুয়েতে। যদিও অনেকটা পিকনিক টাইপ ক্রিকেটের চল ছিল সেখানে। যাই হোক, ১৯৮৩ সালে প্রুডেনশিয়াল ওয়ার্ল্ড কাপে খেলার সুযোগ পায় জিম্বাবুয়ে, এবং সেখানেই হয় তাদের ওয়ানডে ম্যাচ খেলার অভিষেক।

  • প্রস্তুতি পর্ব

যে দেশে ঘরোয়া ক্রিকেটেরই কোন প্রচলন ছিল না, তাদের ক্রিকেট কাঠামোর কথা একবার ভাবুন! নেই কোন ফান্ড, নেই কোন আধুনিক সুযোগ সুবিধাও। ক্রিকেটারদের বেশিরভাগই সখের ক্রিকেট খেলেন, যদিও বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় ছিলেন যারা দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া লিগে সিরিয়াস ক্রিকেট খেলতেন। কিন্তু পুরো সিস্টেমটা বদলে গেল যখন ডানকান ফ্লেচারকে অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচন করা হল। নামটা পরিচিত লাগছে? হ্যাঁ, ভারতের সাবেক কোচ ডানকান ফ্লেচারের কথাই বলছি।

ডানকান আমুদে লোক ছিলেন, কিন্তু সেইসাথে ছিলেন খুবই সিরিয়াস ধরনের অধিনায়ক। দলের ক্রিকেটারদের রুতিন তখন নেটে বল নক করা এবং সন্ধ্যায় বিয়ার গেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফ্লেচার রুটিনে পরিবর্তন আনলেন, রবার্টসন নামক এক দশাসই রাগবি খেলোয়াড়কে নিয়োগ দিলেন খেলোয়াড়দের ফিটনেস নিয়ে কাজ করতে। রবার্টসন আবার ফ্লেচারের চেয়েও এককাঠি সরেস, সে এমনভাবে প্লেয়ারদের জিম করাতে লাগলো, যেন সবাইকে রাগবি খেলোয়াড় বানিয়ে ছাড়বে! ওয়েট লিফটিং থেকে শুরু করে বক্সিং সবই ছিল তার ব্যায়ামের তালিকায়। বিশ্বকাপের আগেই একেকজন ক্রিকেটার হয়ে উঠলেন সুপ্রিম ফিট!

এখানেই ক্ষান্ত দিলেন না ফ্লেচার, বেসবল খেলোয়াড়দের নিয়ে আসলেন ব্যাটসম্যানদের দিকে বল ছুড়ে মারার জন্য, এতে করে ব্যাটসম্যানরা এক্সট্রা পেসে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগলো। ডানকান সবসময়ই দলের খেলোয়াড়দের একটা কথা বলতেন, ‘আমরা হয়ত ব্যাট বলের লড়াইয়ে অন্যদের থেকে পিছিয়ে থাকব, কিন্তু ফিল্ডিংয়ে আমরা বিশ্বসেরা হতে পারি।’

ব্যাট বলের প্রস্তুতি তো ভালোই হচ্ছিল, কিন্তু বিশ্বকাপে যাবার খরচটা যোগাবে কে? জিম্বাবুয়েকে স্পন্সর করার তেমন কেউ ছিল না, খেলোয়াড়রা নিজেরাই শুরু করলেন ফান্ড রেইজিংয়ের কাজ। নিজেদের পাওয়া বিভিন্ন ক্রিকেটীয় পুরস্কারগুলো নিলামে তোলা থেকে শুরু করে ‘টাই বিক্রির কাজ’ কোনটাই বাদ পড়েনি। তারা প্রতি সপ্তাহে দায়িত্ব ভাগ করে নিয়ে কেক বানাতে এবং বিক্রি করতে লাগলেন, এমনকি তাদের স্ত্রীরাও এব্যাপারে সহায়তা করতে লাগলো। রাতে অনেকেই বারে গিয়ে বাউন্সার হিসাবে কাজ করলো এবং সেই টাকা জমা পড়ল বিশ্বকাপ যাত্রার ফান্ডে! অবশেষে এল সেই স্বপ্নের বিশ্বকাপ!

১৯৮৩ সালের ৯ জুন, জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট ইতিহাসের জন্য এক অমর দিন। বিশ্বকাপের আসরে ওয়ানডে ক্রিকেটে জিম্বাবুয়ের প্রথম ম্যাচ! কিন্তু প্রতিপক্ষের নামটাই যে উল্লাসে ভাটা পড়ার জন্য যথেষ্ট! দ্যা মাইটি অস্ট্রেলিয়া! থম্পসন, হিউজ, বোর্ডার, কেপলার ওসেলস, রড মার্শ, একেকটা নাম তখন একেকটা ব্র্যান্ডের মত। যাদেরকে টিভিতে দেখে অভ্যস্ত, তাদের সামনেই কিনা প্রথম ম্যাচ খেলতে হবে!

এই ব্যাপারে ওই ম্যাচে খেলা জিম্বাবুয়ের উইকেটরক্ষক ডেভিড হটন বলেছিলেন, ‘আমাদের মধ্যে প্রচুর নার্ভাসনেস কাজ করছিল। আমার মনে আছে, আমাদের দলের দুই ওপেনারের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, যদিও তারা বাচাল নামেই পরিচিত ছিল দলে। এটা অনেকটা এমন যে, হঠাৎ করেই আপনার সামনে আপনার হিরোরা উপস্থিত, যাদেরকে আপনি টেলিভিশনে দেখে অভ্যস্ত। এদেরকে হারাতে হবে – কথাটা জাস্ট কৌতুকের মত শোনাচ্ছিল।’

  • সেই ম্যাচ

টসে জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিল অস্ট্রেলিয়া। জিম্বাবুয়ের পরিকল্পনা ছিল, ভালো একটি শুরু, রান ওয়েল বিটুইন দ্যা উইকেট এবং খুব ভালো ফিল্ডিং করা। প্লান মোতাবেক শুরুটাও হল বেশ ভালোই, দুই ওপেনার স্কোরবোর্ডে যোগ করে ফেললেন ৫৫ রান! নার্ভাসনেসটাও কাটতে লাগলো আস্তে আস্তে, কিন্তু হঠাৎ ধ্বস! লাঞ্চের আগেই জিম্বাবুয়ের স্কোর গিয়ে দাঁড়ালো ৯৪/৫!

জানিয়ে রাখা ভালো, তখনকার ওয়ানডে ম্যাচ ছিল ৬০ ওভারের। এর মধ্যেই ঘটে গেছে এক মজার রেকর্ড, অ্যান্ডি পাইক্রফট দু’দুবার সামলেছেন হ্যাট্রিক ডেলিভারি এবং দুইবারই সারভাইভ করে গেছেন। এছাড়া, উইকেটরক্ষক হটনের আউট নিয়েও হয়ে গেছে এক পশলা নাটক। ইয়ালপের বল হাটনের ব্যাট ছুঁয়ে জমা পড়ল মার্শের হাতে, কিন্তু উদযাপনের মুহূর্তে সেটা হাত থেকে পড়ে গেল মাটিতে। আম্পায়ার নট আউট দিয়ে দিলেন, হটনও উইকেট থেকে নট নড়নচড়ন!

অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ডাররা তখন হটনের গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলেন। ইউ নো, অজি থিংস! হাটন বিরক্ত হয়ে বললেন, আমাকে কি করতে বল তোমরা! সে বল ফেলে দিয়েছে এবং আম্পায়ারও আউট দেয়নি! অস্ট্রেলিয়ানরা তখন স্কয়ার লেগের আম্পায়ারকে ঘিরে ধরলেন, একটু পর লেগ আম্পায়ার আঙুল উঁচু করে দিলেন!

ডানকান ফ্লেচার

যাই হোক, লাঞ্চের পর ভোজবাজির মত পুরো দৃশ্যপট পাল্টে গেল। এবং পাল্টে দেবার নায়ক সেই ডানকান ফ্লেচার। ষষ্ঠ এবং সপ্তম উইকেটে ৭০ এবং ৭৫ রানের গুরুত্বপূর্ণ দুটি জুটি গড়ে ফ্লেচার অপরাজিত থাকলেন ৬৯ রানে। অ্যা রিয়েল ক্যাপ্টেনস নক! জিম্বাবুয়ে নির্ধারিত ৬০ ওভার ব্যাট করে সংগ্রহ করলো ২৩৯/৬!

বোর্ডে রান জমা হয়ে গেল, দলের বোলিং এবং ফিল্ডিং শক্তিও খারাপ নয়। জয়ের আশা না করলেও একধরনের বুনো আত্মবিশ্বাস দেখা গেল জিম্বাবুয়ের খেলোয়াড়দের ভেতর। বোলাররাও শুরু থেকে বেশ ভালোই চেপে ধরল অস্ট্রেলিয়ানদের। উইকেট পড়ছিল না, কিন্তু রানের গতি ছিল মন্থর। আস্কিং রান রেট ক্রমেই বেড়ে চলছিল, এবং স্বভাবতই চাপে পড়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং অর্ডার।

৬১ রানে প্রথম উইকেটের পতন, অধিনায়ক হিউজও ফিরলেন শুন্য রানে। এক পর্যায়ে ১৩৩ রানেই নেই অস্ট্রেলিয়ার চার উইকেট। উইকেটে অবশ্য ওসেলস রয়েছেন, কিন্তু দলীয় ১৩৮ রানের সময় ওসেলসের রান আউট ফেভারিট বানিয়ে দিল পুঁচকে জিম্বাবুয়েকে! সেই সময়ের বর্ননা দিতে গিয়ে হটন বলেন, ‘আমি শুধু ভাবছিলাম, এখন আর আমরা আমাদেরকে এই ম্যাচ হারতে দিতে পারি না। তাদের ছয়জন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ছিল, কিন্তু আমাদের চারজন বোলার ছিল যারা বাঁহাতিদের বিপক্ষে বিশ্বসেরা।’

চির যৌবনা বলে পরিচিত স্পিনার ট্রেইকস একপ্রান্ত থেকে টাইট বল করে যাচ্ছিলেন, ফিল্ডাররা তাকে যোগ্য সাপোর্ট দিচ্ছিল। রবার্টসনের জিম ট্রেনিং যে কতটা উপকারী ছিল সেটা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছিল। একটা উদাহরন দেই, দ্বাদশ ব্যক্তি হিসাবে ফিল্ডিং করতে নেমেছিলেন জেরাল্ড পিকওভার। বাউন্ডারি থেকে একটি চার আটকাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। লাইটনিং ফাস্ট নামে পরিচিত পিকওভার, জাতীয় দলের হয়ে হকিও খেলেছেন। তো, ডাইভ দিতে গিয়ে পিকওভারের ট্রাউজার নেমে আসলো হাঁটু পর্যন্ত!

কিন্তু বল ছুঁড়ে ফেরত পাঠানোর আগে সেটা বেমালুম অগ্রাহ্য করে গেলেন তিনি। হুম, পিকওভার সেদিন আন্ডারওয়্যার না পড়েই ফিল্ডিং করছিলেন! কমিটমেন্টের কথা একবার ভাবুন! অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের বিরক্তি বাড়ছিলো, কারন ভালো শটগুলোও রানের মুখ দেখছিল না। ভয় শুধু ছিল রড মার্শকে নিয়ে, কারণ সে প্রথম বল থেকেই ভালো টাইমিং করে যাচ্ছিল।

কিন্তু, সমর্থনের অভাব ছিল অপর পাশ থেকে। টাইট বোলিং এবং চমৎকার ফিল্ডিং অস্ট্রেলিয়ার জন্য কাজটা আরও অসম্ভব করে তুলল এবং পুরো ৬০ ওভার ব্যাট করেও তারা পিছিয়ে রইল ১৩ রানে! হ্যাঁ, নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ জিম্বাবুয়ে জিতে গেল ১৩ রানে! অধিনায়ক ডানকান ফ্লেচার শিকার করলেন ৪ উইকেট এবং ম্যাচ সেরার পুরষ্কার!

জন ট্রাইকোস

না, অস্ট্রেলিয়ানরা মেনে নিতে পারেনি সেই হার। বিমর্ষ অবস্থায় টুপি ছুঁড়ে ফেলতে দেখা যায় কয়েকজন খেলোয়াড়কে। মেনে নিতে পারেননি ক্যাপ্টেন হিউজও। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এটা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। ব্লাডি মিনোজগুলো তাদের খেলোয়াড়ি জীবনের সেরা সময় পার করেছিল সেই ম্যাচে এবং আমরা আমাদের সবথেকে খারাপ সময় পার করেছিলাম। এবং ওই হার আমাদেরকে ওই বিশ্বকাপ থেকে তো বটেই, মানসিক ভাবেও ছিটকে ফেলেছিল।’

অস্ট্রেলিয়ানরা মেনে নিতে না পারলেও, জিম্বাবুইয়ানদের আপত্তির কিছুই ছিল না। বরং গ্যালারীতে জমা হওয়া কয়েকজন সমর্থক নেমে আসেন মাঠের ভেতর। এরপর পার্টি, বিয়ার, ড্যান্স, অল ইন জিম্বাবুইয়ান স্টাইল!

ডেভিড জিতে গেল, গোলিয়াথ আবারও পরাজিত! পরাজয়ের কারণ কি জানেন? ডেভিড নামধারী জিম্বাবুয়ে খেলেছিল একটা দল হয়ে, আর ডেভিডকে পাত্তা না দেয়াটা ছিল গোলিয়াথের ভুল! যদিও, হারের কারন হিসাবে, অস্ট্রেলিয়ানরা অপরিচিত জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটারদের কথা তুলে আনেন। কিন্তু তাতে করে জিম্বাবুইয়ান বীরত্বে একটুও কালি পড়ে না। সঠিক নেতৃত্ব, জয়ের ক্ষুধা, প্রস্তুতি এবং সুযোগ কাজে লাগানোর প্রথম বিজ্ঞাপন হিসাবে জিম্বাবুয়ের নাম উচ্চারিত হবে সবার আগে। জিম্বাবুয়ে, ‘দ্য জায়ান্ট কিলার ডেভিড।’

ম্যাচটির মর্যাদা বোঝাতে জিম্বাবুইয়ান উইকেটরক্ষক ডেভিড হটন বলেন, ‘ব্যাট হাতে শুন্য রান এবং কোন ক্যাচ না ধরেও এটা আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সেরা দিন!’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...