১৫ মার্চ, ১৮৭৭। ক্রিকেট ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক দিন। এই দিনটায় অফিসিয়ালি টেস্ট ক্রিকেটের জন্ম হয়। মেলবোর্নে ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ দিয়ে ‘জেন্টলম্যানস গেইম’ খ্যাত ক্রিকেটের গোড়াপত্তন হয়। অবশ্য ওই দিনটির মাহাত্ম্য আরো বাড়িয়ে দেয় চার্লস ব্যানারম্যানের সেই ঐতিহাসিক সেঞ্চুরিতে! সেদিন টেস্ট ইতিহাসের প্রথম সেঞ্চুরির মালিক হন ব্যানারম্যান। প্রথম দিনেই ১২৬ রানের চোখ ধাঁধানো ইনিংসে ক্রিকেটের যাত্রা শুরু করেন ব্যানারম্যান।
অজি ওপেনার চার্লস ব্যানারম্যান ক্রিকেট ইতিহাসের এক অনন্য ব্যক্তি! যিনি টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম বল খেলেন। সেই সাথে প্রথম রানও আসে তার ব্যাট থেকে। প্রথম হাফ সেঞ্চুরির পর প্রথম সেঞ্চুরির রেকর্ড এরপর প্রথম দেড়শ! সব ‘প্রথম’ রেকর্ডই নিজের ঝুলিতে পুরেন। টেস্ট ক্রিকেটের পথচলার প্রথম দিনেই রেকর্ড বইয়ের পুরোটাই নিজের করে রাখেন তিনি।
ওই টেস্টের প্রথম দিনেই ১২৬ রানে অপরাজিত থাকেন ব্যানারম্যান। পরের দিন আরো ৩৯ রান যোগ করতেই ১৬৫ রানে জর্জ উলিয়েটে বলে ইনজুরিতে পড়েন তিনি। তার আঙুল ভেঙে যাওয়ায় এরপর আর ব্যাটিংয়ে নামতে পারেননি। তিনিই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ইনজুরিতে পড়েন।
সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার ছিল অজিরা ওই ইনিংসে ২৪৫ রান সংগ্রহ করে যার মধ্যে ব্যানারম্যানই ১৬৫ রান করেন! এমনকি ব্যানারম্যান ছাড়া আর কেউই ২০ রানের কোটা ছুঁতে পারেননি ওই ইনিংসে। দলের ৬৭.৪ শতাংশ রান একাই করেন ব্যানারম্যান। এরপর ১৪২ বছর সেই রেকর্ড অক্ষত ছিল!
১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই সিডনিতে আরেক অজি ব্যাটসম্যান মাইকেল স্ল্যাটার দলীয় রানের ৬৬.৮৪ শতাংশ রান করেছিলেন। অজিদের করা ১৮৪ রানের মধ্যে ১২৩ রানই করেন স্ল্যাটার। ব্যানারম্যানের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটি অবশ্য খুব বেশিদিন টেকেনি। ১৮৮৪ সালে অজি অধিনায়ক বিলি মারডচ টেস্ট ইতিহাসের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করে সেটি ভেঙে দেন। তবে টেস্টে দলের পক্ষে সবচেয়ে বেশি শতাংশ রানের (৬৬.৪) রেকর্ডটি এখনো অক্ষত আছে ব্যানারম্যানের।
প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্যানারম্যান এক ইনিংসে ১৫ টির বেশি চার মারার কীর্তি গড়েন। তাঁর খেলা ১৬৫ রানের ইনিংসের পথে ১৮টি চার মারেন তিনি। ১৮৮৪ সালে বিলি মারডচ ওভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২৪ টি চার মেরে সেই রেকর্ড ভেঙ্গে দেন। অবশ্য অভিষেকে সবচেয়ে বেশি বাউন্ডারি মারার রেকর্ড ২০ বছর আঁকড়ে ধরে রাখেন ব্যানারম্যান। ১৮৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যানচেস্টারে ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষিক্ত হওয়া কুমার শ্রী রঞ্জিতসিংজি ২৩ বাউন্ডারি মেরে সেই রেকর্ড গুড়িয়ে দেন।
অভিষেকে ব্যানারম্যানের মারা ১৮টি বাউন্ডারি অজিদের হয়ে অভিষেকে এখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ১৯৮৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে পার্থে অভিষেক ম্যাচে ওয়েন ফিলিপস ২০ টি বাউন্ডারি হাঁকান। ব্যানারম্যানের এই রেকর্ডটি ১০০ বছর অক্ষত ছিল! অভিষেকে সবচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত রান সংগ্রাহকের মালিকও ব্যানারম্যান। ১৯২৯ সালে অজি ব্যাটসম্যান আর্চি জ্যাকসন ১৬৩ রান করলেও অল্পের জন্য সেই রেকর্ড ভাঙ্গতে পারেননি।
অভিষেক টেস্টে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের তালিকায় ব্যানারম্যানের করা ১৬৫ রানের ইনিংস পঞ্চম স্থানে আছে। তার এই রেকর্ড ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানি ওপেনার খালিদ আব্দুল্লাহ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই ১৬৬ রান করে ভেঙ্গে দেন। ব্যানারম্যান এবং আব্দুল্লাহ ছাড়াও তিনজন ব্যাটসম্যান অভিষেক টেস্টে ১৬৫ রানের চেয়ে বেশি সংগ্রহ করেন। ১৯৮৭ সালে শ্রীলঙ্কার ব্রেন্ডন কুরুপ্পু, নিউজিল্যান্ডের হামিশ রাদারফোর্ড ২০১৩ সালে এবং ভারতের শিখর ধাওয়ান ২০১৩ সালে এই রেকর্ড তালিকায় নাম লেখান।
১৮৭৮ সালে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া দল ইংল্যান্ড সফরে যায়। সেই সফরে দুর্দান্ত ব্যাটিং করলেও দুর্ভাগ্যবশত সেই সিরিজের কোনো টেস্টই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি! সেই সিরিজে সর্বোচ্চ এভারেজধারী ব্যাটসম্যান ছিলেন ব্যানারম্যান।
তিন জুলাই, ১৮৫১। ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন চার্লস ব্যানারম্যান। পরবর্তীতে পরিবারের সাথে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে পাড়ি জমান তিনি। এরপর অস্ট্রেলিয়াতেই নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়েন তিনি। সেখানে সিডনির ওয়ারউইক ক্রিকেট ক্লাবে যোগ দেন তিনি। সেখানে কোচ উইলিয়াম ক্যাফেইনের অধীনে ক্যারিয়ার গড়েন ব্যানারম্যান। তার সময়ের অন্যতম সেরা ফিল্ডার হিসেবেও বেশ সুনাম ছিল ব্যানারম্যানের।
ব্যানারম্যান তার অভিষিক্ত সেই ঐতিহাসিক টেস্টের পর ক্যারিয়ারে আর মাত্র দু’টি টেস্ট খেলেন! অসুস্থতার কারণে ক্যারিয়ার লম্বা করতে পারেননি তিনি। অবশ্য শুধু অসুস্থতা বললে ভুলই হবে। জুয়ায় টাকা লাগিয়ে ঋনের দায় আর অ্যালকোহলই তার ক্যারিয়ার নষ্টের বড় কারণ। ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ হবার পর অবশ্য প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে আম্পায়ারিং করেন তিনি! ১৮৮৭ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত মোট ১২টি টেস্টে আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
২০ আগস্ট, ১৯৩০ – ৭৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ব্যানারম্যান। যার হাত ধরে টেস্ট ক্রিকেটের পথচলার শুরুটা সেই মানুষটার ক্যারিয়ার শুরু না হতেই শেষ হয়ে যায় নিজের ভুলের কারণে। তিনি না থাকলেও তার করা অনন্য রেকর্ড গুলো থেকে যাবে ব্যানারম্যানের ব্যানারে।