যুব ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন নাজমুল হোসেন শান্ত। আর বাংলাদেশকে যুব বিশ্বকাপের ফাইনালে অবিশ্বাস্য জয় এনে দেওয়ার নায়ক পারভেজ হোসেন ইমন। এই দু’জনের অনন্য এক দ্বৈরথে রোমঞ্চকর এক ম্যাচের সাক্ষী হল মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম।
দুই সেঞ্চুরিয়ানের সেই লড়াইয়ে শেষ হাসি হাসলেন ইমন। ২২০ রানের জবাবে তিনি ফরচুন বরিশালের জয় নিশ্চিত করলেন ১১ বল বাকি থাকতেই। নিজে সেঞ্চুরি করলেন মাত্র ৪২ বলে। বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টির ইতিহাসেই দ্রুততম সেঞ্চুরি। আর এই ইমনের বয়স মাত্র ১৮ বছর!
এদিন রেকর্ডের বন্যা বইয়ে দিলেন দুই দলের ক্রিকেটাররা। তবে শেষ হাসি হাসল তামিম ইকবালের দল ফরচুন বরিশাল। দিনের প্রথম ম্যাচে প্রথমবারের মত দুইশ পেরোনো ইনিংসের মুখ দেখালো পদ্মাপারের দল। ট্যুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাজিক ফিগারের দেখাও মিলল এই দিন। রাজশাহীর অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর অশান্ত ব্যাটিংয়ে ভর করে রানের পাহাড়ে উঠে মিনিস্টার গ্রুপ রাজশাহী। সেই পাহাড় টপকে টপকে কয় তুলে নিলেন বরিশাল। রেকর্ড রান তারা করে কি অবিশ্বাস্য জয়। টুর্নামেন্টে পাওয়ারপ্লেতে সর্বোচ্চ স্কোর, ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ স্কোর, যে কোনও উইকেটে সর্বোচ্চ জুটি, সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর এ ম্যাচে কি করেন নি রাজশাহী। তবে এত এত কিছু করলেও তা জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল না।
টসে জিতে বরিশাল অধিনায়ক তামিম ইকবাল রাজশাহীকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান। প্রথম ২ ওভারে রাজশাহী তুললেন ১০ রান। সকালের সূর্য সব সময় দিনের সঠিক পূর্বাভাস দেয় না। তৃতীয় ওভারেই খোলস থেকে বের হলেন ওপেনার আনিসুল ইসলাম ঈমন। সুমন খানকে ওভারের দ্বিতীয় বলটি ছিল ব্যাক অব লেন্থে পুল করে ডিপ পয়েন্ট দিয়ে সীমানা ছাড়া করে শুরু এরপর লাগামহীন ঘোরার মত ছুটতে থাকে ইমনের ব্যাট সাথে তার দল মিনিস্টার গ্রুপ রাজশাহী।
পুরো ইনিংসজুড়েই বরিশাল বোলাররা লেংথ বা লাইন খুঁজে পাননি, কখনো বেশি শর্ট বল আবার কখনো অথবা বেশি ফুললেংথে বল করে বেধরক মার খেয়েছেন বরিশালের বোলাররা। বিপরীতে ইমন, শান্তরা পাওয়ার হিটিং আর দুর্দান্ত প্লেসমেন্টে উইকেটের চারপাশে স্ট্রোকের পসরা সাজান। ৩৯ বলে ৬৯ করে সুমন খানের বলে ইমন ফিরলেও শান্ত পুরো ইনিংস জুরে অশান্তিতে ভুগিয়েছেন প্রতিপক্ষ বোলারদের। চলতি ট্যুর্নামেন্টের প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে খেলেছেন ৫৫ বলে ১০৯ রানের ঝকঝকে ইনিংস। সাত উইকেট হারিয়ে রাজশাহীর বোর্ডে জমা পরে ২২০ রানের বিশাল সংগ্রহ। বরিশালের বোলারদের একমাত্র পাওয়া বলতে ১৯ তম ওভারে পেসার কামরুল ইসলাম রাব্বীর হ্যাট্রিক যা এই ট্যুর্নামেন্টেরও প্রথম হ্যাট্রিক।
ম্যাচ জিততে চাইলে রেকর্ড রান তারা করতে হবে বরিশালকে। পাহাড়সম টার্গেট ছুতে চাই পাহাড়ের মত দৃঢ়চেতা মনোভাব আর খুনে ব্যাটিং। প্রতিপক্ষের বোলিং লাইন আপকে স্রেফ খুন করা ছাড়া এই ম্যাচের জয়ের কোনো বিকল্প নেই বরিশালের সামনে। শুরু থেকেই খেলতে হবে অল আউট ক্রিকেট। ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘এট্যাক ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’। ড্রেসিং রুমে এরকম একটায় বার্তায় হয়তো দিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
লক্ষ তারা করতে নেমে শুরু থেকেই চড়াও বরিশালের দুই ওপেনার। ইনিংসের প্রথম বলে সাইফুদ্দিনকে কাভার দিয়ে চার মেরে রানের খাতা খোলেন সাইফ হাসান। এরপর রাজশাহীর মত প্রথম দুই ওভার একটু দেখেশু শুরু। এরপর তৃতীয় ওভার থেকে শুরু এবাদতের ওই ওভারের শেষ তিন বলে দুই ছয় এক চারে তুললেন ১৮। তবে বরিশালের আসল খেলাটা শুরু হয় ৪৪ রানে সাইফ হাসানের আউট হওয়ার পর। এই আউটই সাপে বর হয়ে দাড়াল রাজশাহীর বোলারদের জন্য।
উইকেটে আসলেন সদ্য কিশোর বয়স পেড়োনো ইমন। অনুর্ধ ১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালের সুবাধে অনেকেই যাকে বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম নায়ক হিসেবেই চিনে। দ্বিতীয় বলেই মোহাম্মদ সাইফউদ্দীন ফ্লিক করে চার মেরে শুরু এরপর আর ইমনকে থামানোর সাধ্যি কার। উইকেটে এসে সময় নিলেন না দ্রুতই মানিয়ে নিয়ে রাজশাহীর বোলারদের বোলের সুতা খুলে ফেলার জোগার। অন্যদিকে অধিনায়ক তামিম ইকবালও খোলস থেকে বের হতে লাগলেন ৯ ওভারের আগেই দলীয় শতক। বড় লক্ষ তারা করতে নেমে যে চাপ থাকার কথা সেই চাপ যেন এক ফুতকারে উড়ে দিলেন ইমন।
নার্ভ ধরে রেখে সাইফউদ্দিন, ফরহাদ রেজাদের উপর রোলার কোস্টার চালাতে শুরু করলেন। বিন্দুমাত্র সুযোগ দিলেন না রাজশাহীর বোলারদের। ১৩ তম ওভারে তিন ছয়, এক চারে এক রকম ম্যাচ থেকেই ছিটকে দিলেন ইমন। ৫৩ করে তামিম রান আউটে কাটা পরলেও দলের উপর একটুও প্রভাব পরতে দিলেন না ইমন। মিরপুরে বাকিটা সময় চলল ইমনের দায়িত্বশীল পাওয়ার হিটিংয়ের প্রদর্শনী। ১৮ তম ওভারের প্রথম বলে চার মেরে নিজের সেঞ্চুরির সাথে দলের জয় নিশ্চিত করে মাঠ ছাড়েন ইমন। ১০০ রানের ইনিংসটি খেলতে বল খরচ করেছেন মাত্র ৪২ যেখানে সাতটি ছয়ের সাথে আছে নয়টি চারের মার।
স্ট্রাইক রেটের দিকে তাকেতে ভুলে যাবেন না, সংখ্যাটা ২৩৮.০৯! পরিচর্যা পেলে হয়তো ইমন হয়ে উঠবেন ‘নেক্সট বিগ থিঙ’!