ঝড়ো ব্যাটিংয়ের মায়াবী বিভ্রম

বিশ্বকাপ শুরুর পর কেটে গেছে দশ দিন। ড্রপ ইন পিচ আর অস্ট্রেলিয়ার বাউন্সি উইকেটে এবারের বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে ব্যাটসম্যানদেরই- এমন ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন অনেকেই।

বিশ্বকাপ শুরুর পর কেটে গেছে দশ দিন। ড্রপ ইন পিচ আর অস্ট্রেলিয়ার বাউন্সি উইকেটে এবারের বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে ব্যাটসম্যানদেরই- এমন ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন অনেকেই।

সেই ভবিষ্যতবাণী সত্যি প্রমাণ করেই এই দশদিনে দেখা মিলেছে দারুণ সব ইনিংসের, মায়াবী ব্যাটের পরশ বুলিয়ে তাঁরা বিস্ময়ে ভাসিয়েছেন বিশ্বজুড়ে থাকা ক্রিকেটপ্রেমীদের। আসুন দেখে নেয়া যাক এবারের বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত সেরা পাঁচ ইনিংসকে।

  • পল স্টার্লিং – আয়ারল্যান্ড (অপরাজিত ৬৬ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ)

দুইবারের বিশ্বকাপজয়ী দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবার বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে মূল পর্বে ওঠার আগেই। বাছাই পর্বের লড়াইয়ের শেষ ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরেই মূলত বিদায়ঘন্টা বাজে পুরান-হোল্ডারদের। কারিবীয় বধের সেই ম্যাচে রান তাড়া করতে নেমে ব্যাট হাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আইরিশ ওপেনার পল স্টার্লিং।

শুরুতে দারুণ বলে করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটারদের মাত্র ১৪৬ রানে বেঁধে রেখে ব্যাটারদের জন্য মঞ্চটা তৈরিই রেখেছিলেন আইরিশ বোলাররা। সেই মঞ্চে দাঁড়িয়েই প্রতিপক্ষ বোলারদের কচুকাটা করেছেন স্টার্লিং, তাঁর ১৩৭ স্ট্রাইক রেটে করা অপরাজিত ৬৬ রানে ভর করেই বিশ্ববাসী দেখেছে এবারের বিশ্বকাপের প্রথম অঘটন। তাঁকে অ্যাণ্ড্রু বালবার্নি এবং লরেন টাকার যোগ্য সঙ্গ দিলেও দুই দলের মাঝে মূল পার্থক্যটা গড়ে দিয়েছেন স্টার্লিংই।

  • কুইন্টন ডি কক – দক্ষিণ আফ্রিকা (অপরাজিত ৪৭ বনাম জিম্বাবুয়ে)

এবারের বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচেই হোঁচট খেয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। আরও একবার ভাগ্যের মারপ্যাঁচে বৃষ্টি বাঁধায় নিশ্চিত জয় নিয়ে ফিরতে পারেনি তাঁরা। জিম্বাবুয়ের সাথে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে তাই সেমির দৌড় থেকে খানিকটা পিছিয়েই পড়েছে প্রোটিয়ারা।

অথচ বৃষ্টি বাঁধায় নয় ওভারে নেমে আসা ম্যাচে জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল তাঁরা। কুইন্টন ডি কক রীতিমতো ঝড় চালাচ্ছিলেন মুজারাবানি-চাতারাদের উপর। ৭৯ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে চাতারার প্রথম ওভার থেকেই মারমুখী ব্যাটিং করেছেন ডি কক, প্রথম ওভারেই তুলে নেন ২৩ রান। ঝড় থামেনি পরের দুই ওভারেও, তিন ওভারে ৫১ রান করে যখন বিরসবদনে ডাগ আউটে ফিরছেন দুই প্রোটিয়া ওপেনার ততক্ষণে ডি কক একাই করে ফেলেছেন ৪৭ রান। অন্যপ্রান্তে তাঁর সঙ্গী বাভুমা সংগ্রহ তখন মোটে ২ রান। 

  • ফিন অ্যালেন ও ডেভন কনওয়ে – নিউজিল্যান্ড( যথাক্রমে ৪২ এবং অপরাজিত ৯২ বনাম অস্ট্রেলিয়া)

বিশ্বকাপের এবারের আসরের উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল তাসমানপাড়ের দুই প্রতিবেশী অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন এবং ঘরের মাঠে শুরুতে অজিদের ফেবারিট ভাবা হলেও মাঠের খেলায় একপ্রকার উড়েই গেছে স্বাগতিকরা।

শুরুতেই কিউইদের দুই ওপেনার ফিন অ্যালেন এবং ডেভন কনওয়ে মারমুখী ব্যাটিং করে অজিদেরকে ছিটকে দেন ম্যাচ থেকে। পাওয়ার প্লের পুরোটাই ছিল অ্যালেনের ওয়ান ম্যান শো, কামিন্স-স্টার্ক-হ্যাজেলউডদের রীতিমতো পাড়ার বোলারে নামিয়ে আনেন এই ওপেনার। তাঁর ১৬ বলে ৪২ রানের বিধ্বংসী ইনিংসে ভর করে বড় সংগ্রহের চমৎকার ভিত্তি পেয়ে যায় কিউইরা।

তাঁর গড়া মঞ্চে দাঁড়িয়েই পরবর্তীতে সৌধ গড়ার কাজটা সারেন কনওয়ে, মাঝের ওভারগুলোতেও থামতে দেননি রানের চাকা। পুরো ইনিংসেও তাঁকে আউট করতে পারেননি অজি বোলাররা, অপরাজিত থাকেন ৯২ রান করে। পরবর্তীতে রান পাহাড়ে চাপা পরে বড় হারের মুখ দেখতে হয় অজিদের। 

  • মার্কাস স্টোয়িনিস – অস্ট্রেলিয়া (অপরাজিত ৫৯ বনাম শ্রীলঙ্কা)

প্রথম ম্যাচে বড় ব্যবধানে হেরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচের আগে এমনিতেই চাপে ছিল অজিরা। পার্থে লঙ্কানদের দেয়া ১৫৯ রান তাড়া করতে নেমে এক পর্যায়ে দুই স্পিনার ডি সিলভা এবং থিকসানার সামনে রীতিমতো ধুঁকছিলেন অজি কাপ্তান অ্যারন ফিঞ্চ।

কিন্তু, পাঁচ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে পুরো ম্যাচের চিত্রনাট্য পাল্টে দেন স্টোয়িনিস। পার্থের বড় মাঠও বাঁধা হয়ে উঠতে পারেনি তাঁর অসুরীয় শক্তির সামনে, অপরাজিত ৫৯ রানের ইনিংস খেলার পথে হাঁকিয়েছেন বিশাল ছয়টি ছক্কা। ১৭ বলে তাঁর ছোঁয়া ফিফটি টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে যৌথভাবে দ্বিতীয় দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড। ২১ বল আগেই জয়ের দেখা পাওয়া অজিরা তাঁর ইনিংসের সুবাদেই কমিয়ে আনতে পেরেছে রান রেটের পার্থক্যটা, নতুন করে স্বপ্ন দেখছে সেমিতে খেলার।  

  • বিরাট কোহলি – ভারত (অপরাজিত ৮২ বনাম পাকিস্তান)

বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই উত্তেজনার ছড়াছড়ি। তাছাড়া এবারের ম্যাচটা ছিল আরও তাৎপর্যপূর্ণ, পুরো বিশ্ববাসী মুখিয়ে ছিল দুই দলের লড়াই উপভোগ করতে। পাকিস্তান কি পারবে জয়ের ধারা বজায় রাখতে নাকি ভারত নেবে মধুর প্রতিশোধ – ম্যাচের আগে সবার মুখে মুখে ফিরছিল এই কথাই।

পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা এ ম্যাচে অতিমানবীয় এক ইনিংস খেলে দলকে জয় এনে দিয়েছেন বিরাট কোহলি। এমনিতেই গত দুই-তিন বছরে আগের সেই কোহলিসুলভ ইনিংসের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না বলে রব উঠছিল। বিরাট নিজেও খানিকটা চাপে ছিলেন পারফরম্যান্স নিয়ে। তবে বড় তারকারা জ্বলে উঠতে বেছে নেন বড় ম্যাচকেই, পুরনো এই সত্যটাকেই যেন আরো একবার প্রমাণ করলেন কোহলি।

পাকিস্তানের দেয়া ১৬০ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে যখন ধুঁকছেন বাকি ব্যাটসম্যানরা, তখন একপ্রান্তে অবিচল ছিলেন কোহলি। বিশেষ করে হারিস রউফকে টানা দুই বলে যেভাবে ছক্কা হাঁকালেন, সেই শট দুটোকে ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসেরই সেরা শট হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন ক্রিকেটবোদ্ধারা। ছয় চার এবং চার ছক্কায় হাঁকানো কোহলির এই ইনিংসকে ইতোমধ্যেই টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস বলছেন ধারাভাষ্যকাররা। 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...