দেশের ফুটবলে জাপানি হাওয়া

১৯ বছরের এই নারী ফ্রি স্টাইলার ফুটবলার হিসেবেই সাধারণের মাঝে পরিচিতি। তাঁর জন্ম জাপানে। মা মাতসুশিমা তমোমি জাপানি ও বাবা মাসুদুর রহমান বাংলাদেশি। ফুটবলার হওয়ার বাসনা তার সেই শৈশব থেকেই। তবে যখন ২ বছর বয়সে বাংলাদেশে আসেন তখন তার সবকিছুই ছিল অজানা আর অচেনা। ফুটবলের প্রতি ভালবাসাই তাকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে।

ফুটবলে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ডেনমার্কের খেলোয়াড় জামাল ভূঁইয়ার আগমনের পর থেকেই দেশের বাইরে অবস্থান করা খেলোয়াড়দের খুজে বের করার কাজটি করা একটু বেশি জোর দিয়ে শুরু হয়। যা এখনো অব্যহত রয়েছে। সর্বশেষ ফিনল্যান্ডে জন্ম ও বেড়ে ওঠা কাজি তারিক রহমানের জাতীয় অর্ন্তভুক্তি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশিদের জন্য লাল সবুজ পতাকাতলে আবদ্ধ হতে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে।

এছাড়া গত মার্চে নাগরিকত্ব পাওয়া এলিটা কিংসেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। নাইজেরিয়ার নাগরিকত্ব ছেড়ে এখন তিনি পুরদস্তুর বাংলাদেশি। এলিটা যদিও ভিন্ন পন্থায় বাংলাদেশের জার্সি গায়ে চাপানোর স্বপ্ন দেখছে। পুরুষ দলের জন্য বিষয়টিকে একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে মেয়েরা অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। এবার সেই কাজটিও করা শুরু হয়েছে। মাতসুশিমা সুমাইয়া নামের এক কন্যার আগমন ঘটেছে বাংলাদেশের নারী ফুটবলে। শুরুতেই জাতীয় দলে নয় দেশের ফুটবলে আগমন ঘটেছে তাঁর।

লাল সবুজ জার্সি গায়ে চাপানোর লক্ষ্য নিয়েই যোগ দিয়েছেন বসুন্ধরা কিংসে। একটা লিগ খেলা শেষও করেছেন কিছুদিন পূর্বে। সাবিনা খাতুন, মারিয়া মান্ডা, আখি খাতুন, শামসুন্নাহারদের সঙ্গে অনুশীলন করে নিজেকে প্রমাণেরও চেষ্টা করেছেন সুমাইয়া। এর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছুড়িয়ে পড়ে তার শারীরিক নানা কসরতের ভিডিও ও ছবি। যা দেখে মুগ্ধতায় মনটা ভরে ওঠে।

নিজেকে জাতীয় দলের জন্য তৈরি করতে সব ধরনের চেষ্টার কথা জানিয়েছেন জাপানি মা আর বাংলাদেশি বাবার এই মেয়ে। তবে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ দিয়ে কবে মাঠে ফিরতে পারেন সেটি কিছুটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে ছিল। পরে বসুন্ধরা কিংসের জার্সি গায়ে মাঠে নেমে সেই সংশয়ও দুর হয়ে গেছে। মেয়েদের ফুটবল লিগে কিছুদিনের বিরতি চলছিল। এরপর ফের শুরু হয়েছে এই লিগের খেলা। কিন্তু যে ক্লাবগুলোর অংশগ্রহনে ছয় বছরের বেশি সময় পর লিগ শুরু হয়েছিল তারাই সেই সময় খেলতে চাইছিলনা। পরে যদিও সেই সমস্যাটা আর থাকেনি। সে কারণেই মেয়েদের খেলা কবে মাঠে ফেরা হবে সেটি কিছুটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে ছিল।

পরে সমস্যা কাটিয়ে লিগও মাঠে গড়িয়েছে আর সেখানে শিরোপা জিতেছে সুমাইয়ার দল বসুন্ধরা কিংস। এই দলে ৭৭ নাম্বার জার্সি পড়ে খেলেছেন এই ষ্ট্রাইকার। পুরুষ দলের মতো মেয়েদের দল নিয়েও প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে বসুন্ধরা কিংস। ঢাকার পেশাদার ফুটবলে অভিষেকের পর গত দুই বছরে সবগুলোর শিরোপা জেতা হয়ে গেছে। মেয়েদের ফুটবলেও শিরোপা জয় করে তবেই মাঠ ছেড়েছে সাবিনা খাতুনের দল।

এই দলে মাতসুশিমা সুমাইয়ার যোগ দেওয়া নি:সন্দেহে দলের শক্তি বাড়িয়েছিল। লিগের কয়েকটি ম্যাচ আগেই শিরোপা জেতা হয়ে যেত দলটির। করোনা ভাইরাস যেন সবকিছুতে ব্যঘাত ঘটিয়েছে। তবে প্রথম লেগে নিবন্ধনের সুযোগ না থাকলেও দলে ভিড়িয়ে নতুন চমক দেখিয়েছে সুমাইয়াকে। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমের দ্বারা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নজরে আসা সুমাইয়াকে নিয়ে শক্তি অনেকটাই বাড়িয়েছে।

১৯ বছরের এই নারী ফ্রি স্টাইলার ফুটবলার হিসেবেই সাধারণের মাঝে পরিচিতি। তাঁর জন্ম জাপানে। মা মাতসুশিমা তমোমি জাপানি ও বাবা মাসুদুর রহমান বাংলাদেশি। ফুটবলার হওয়ার বাসনা তার সেই শৈশব থেকেই। তবে যখন ২ বছর বয়সে বাংলাদেশে আসেন তখন তার সবকিছুই ছিল অজানা আর অচেনা। ফুটবলের প্রতি ভালবাসাই তাকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে। নিজের ফুটবল কসরত ফেসবুকে দেখিয়ে প্রথমে সবার নজরে আসেন। ফুটবল নিয়ে তার কারিকুরি সবারই পছন্দ হয়েছে।

বিশেষত বাংলাদশের নারী ফুটবলারদের তার মতো শারিরিক সক্ষমতা নেই বলেও অনেকেই মনে করেন। তবে তাকে দলে ভেড়ানোর মতো সুবর্ণ সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে বসুন্ধরা কিংস সভাপতি ইমরুল হাসান বলেন, ‘মূলত বাফুফের মাধ্যমেই সুমাইয়াকে আমরা পেয়েছি। প্রথম লেগে তাকে দলে নেওয়ার সুযোগ ছিরনা। আমরা দ্বিতীয় লেগের জন্য সুমাইয়াকে দলে ভিড়িয়েছি। আমরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য দল গড়েছি, তাকে দলে নেওয়ার ফলে শক্তিটাও বেড়েছে। আর লিগে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জেতায় দলের সবাই বেশ খুশিও হয়েছেন।’

দেশের নারী ফুটবলে এখন চলছে দারুণ সময়। জাতীয় দলে না হোক বয়সভিত্তিক বিভিন্ন দল এরই মধ্যে দেশের পতাকাকে সমুজ্জল করেছে অনেকগুন। দলীয় খেলা হিসেবে ক্রিকেটের পর মেয়েদের বয়সভিত্তিক দলের কল্যানে বাংলাদেশকে চিনেছে অনেকে। ফুটবলার হতে প্রথম ধাপটি পূরণ করেছেন সুমাইয়া। এখন ক্লাব দলে যোগ্যতার প্রমাণ রেখে লাল সবুজ জার্সিতে নিজের জাতকে চেনাতে চান তিনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় দলে খেলার সম্ভাবনাটা কিছুটা জটিল হলেও এর আগেই তাকে অনুশীলনের সুযোগ দিয়েছিল বসুন্ধরা।

বসুন্ধরার টেকনিক্যাল ডিরেক্টর বায়েজিদ আলম জোবায়ের নিপু জানিয়েছেন, ’দলে যোগদানের পূর্বেই সুমাইয়ার শারীরিক কসরত আমরা দেখেছি। একজন ফুটবলার হতে গেলে যে ধরনের শারিরিক সক্ষমতার প্রয়োজন রয়েছে তার সবই তার মধ্যে বিদ্যমান। সুমাইয়ার স্কিল আমার কাছে ভাল লেগেছে। ওর বেশকিছু ভিডিও আমি দেখেছি। এরপর দলের খেলোয়াড়দের সাথে অনুশীলনে নিজেকে মেলে ধরেছে সুমাইয়া।’

বসুন্ধরায় যোগ দেবার পূর্বে বাফুফে ভবনে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল থমাস স্মলি ও জাতীয় মহিলা দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের সঙ্গে দেখা করে জাতীয় দলের খেলার নিজের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। কোচ ছোটন তাকে প্রমাণ করে তবেই জাতীয় দলে আসতে হবে জানিয়ে দিয়েছেন।

‘এ’ লেভেলের এই শিক্ষার্থীর খেলা দেখে বসুন্ধরা কোচ মাহমুদা শরিফাও খুশি হয়েছেন, ‘তাঁকে প্রথম লেগের সময় দেখেছিলাম। কিন্তু সে সময় দলে নেওয়া সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় লেগে বেশকিছু ম্যাচে খেলেছে সে। প্রথম মৌসুম বলে নিজেকে মেলে ধরতে কিছুটা সময় লেগেছে। আশা করি সামনের সময়গুলো সুমাইয়ার ভাল কাটবে।’

বসুন্ধরা কিংস দ্বিতীয় লেগের আগে নতুন খেলোয়াড় রেজিস্ট্রেশনের সুযোগে সুমাইয়াকে চুক্তিবদ্ধ করে। সুমাইয়া সি ব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ’এ’ লেভেলে লেখাপড়া করছেন। ২০১৮ সালে এই স্কুলের একটি ফুটবল দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আন্তঃইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টে। তার দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সুমাইয়া সেখানে সেরা খেলোয়াড় ও সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জিতেছিলেন। আইএমসি স্পোর্টিং একাডেমিতে খেলছেন এখন।

গত বছর লিগামেন্টে চোট পাওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে ফুটবল ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু খেলাটিকে ভালবেসে মনের অদম্য শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে আবারো ফিরেছেন। বসুন্ধরায় যোগ দেবার পূর্বে প্রতিদিন ৩/৪ ঘণ্টা অনুশীলন করেছেন। বাংলাদেশের জার্সি গায়ে খেলার ইচ্ছা পোষণ করে সুমাইয়া বলেন, ’নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে আমি জাতীয় দলে খেলতে চাই। পাশাপাশি এদেশের ফুটবল খেলার জন্য আমার মতো মেয়েদের আমি অনুপ্রাণিত করতে চাই। জাতীয় দলে খেললে সেটা অবশ্যই সম্ভব বলে মনে করছি।’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...