দীনহীন পাইপলাইন, মানহীন সিস্টেম

এসব কিছু কি হঠাৎ করে হয়েছে? না। যখন আপনার মানসম্মত ডমেস্টিক স্ট্রাকচার নাই, দল নির্বাচনে সুনির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়া নাই, তখন এটা অবশ্যম্ভাবী।

এই যে কোনো কিছু না করেই এশিয়া কাপে সাব্বির রহমান ফিরলেন আর বিশ্বকাপে নাজমুল হোসেন শান্ত, এটা আমাদের পাইপলাইন তো বটেই, সর্বোপরি ক্রিকেট সিস্টেমেরই একটা দীনতা। চিন্তা করেন একবার, পুরো দেশ থেকে ন্যূনতম পারফর্ম করা দুইজন পুরোদস্তুর ওপেনার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! কী ভীতিকর একটা অবস্থা! এমনকি স্কোয়াড গোছাতে এবং খেলোয়াড়দের পরখ করতে তিনদিনের ট্রায়াল কিংবা ম্যাচ সিনারিওর আয়োজন করা হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন এটা জাতীয় দল নয়, স্কুল ক্রিকেট। ট্রায়ালের পারফরম্যান্স দেখে পিটি স্যার দল তৈরি করবেন।

এসব কিছু কি হঠাৎ করে হয়েছে? না। যখন আপনার মানসম্মত ডমেস্টিক স্ট্রাকচার নাই, দল নির্বাচনে সুনির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়া নাই, তখন এটা অবশ্যম্ভাবী।

যদিও অসম্ভব তারপরেও গতকাল প্রধান নির্বাচককে দুইটা প্রশ্ন করতে খুব মন চাচ্ছিল। জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করছিল যে, ‘নান্নু ভাই, এই সময়টায় এসে দলে নেওয়ার মতো আপনারা দুইজন ওপেনারও খুঁজে পাচ্ছেন না। এটা আমাদের পাইপলাইন বা ক্রিকেট সিস্টেমেরই একটা চূড়ান্ত ব্যর্থতা বা রূঢ় বাস্তবতা বলে আপনি অনেস্টলি মনে করেন কি না?’

‘আরেকটা সম্পূরক প্রশ্ন, আপনি এবং সুমন ভাই এত বছর ধরে নির্বাচক প্যানেলে আছেন, কোনোসময় কী এমন দুর্দিন দেখেছেন বা এরকম চ্যালেঞ্জে পড়েছেন যে দলের জন্য দুইটা ওপেনার খুঁজে পেতে এখনকার মতো গলদ্‌ঘর্ম অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে?’

গতকালের প্রেস কনফারেন্স দেখে নান্নু ভাইয়ের জন্য মায়াই হচ্ছিল। তিনি একটা প্রশ্নেরও কোনো সদুত্তর দিতে পারছিলেন না। তাঁর উত্তরগুলায় ন্যূনতম আত্মবিশ্বাস ছিল না। রিয়াদের বাদ পড়া প্রসঙ্গে যে কথাগুলা বলেছেন, সেগুলো শুনলেই বুঝবেন। পুরো সংবাদ সম্মেলনেই তিনি শুধু কয়েকটা ‘খোকা বোঝানো’ কথা বললেন এবং চাঁচাছোলাভাবে বলতে গেলে, প্রশ্নবান ছোটার প্রাক্কালে অনেকটা পালিয়েই গেলেন।

বিসিবির দল নির্বাচনে যেমন কোনো স্থিতিশীলতা নেই, তেমনি নেই তাঁদের কথাবার্তায় এমনকি লক্ষ্যেও। এক ইমনকে নিয়েই গেল দশমাসে দু-দুবার ডাকা ও বাদ দেওয়ার যে খেলাটা খেলা হয়েছে, সেটাই যথেষ্ট দল নির্বাচনে অস্থিতিশীলতা তুলে ধরার জন্য। আর কথাবার্তার অস্থিতিশীলতা নিয়ে বলতে গেলে আমাকে একটু পিছনে ফিরতে হবে।

গত পরশু বোর্ড সভাপতি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁদের টার্গেট আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। আমি যদি তাঁর কথাটা উদ্ধৃত করি তাহলে তা দাঁড়ায়, ‘এমন কোনো কোচ বা বোর্ড নাই যে হঠাৎ করে রাতারাতি একমাসের মধ্যে একটা টিম ভালো করে দেবে। তাই এতদিন যা হয়েছে, হয়েছে। এখন আমরা লং টার্ম প্ল্যান করছি। টার্গেট করছি নেক্সট টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ। এটার জন্য আমরা দল তৈরি করছি।’

অথচ গত মাসেও আসছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে টার্গেট করে এশিয়া কাপকে প্রস্তুতির মঞ্চ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন তিনি। সেজন্য হেড কোচ রাসেল ডমিঙ্গোকে সরিয়ে তড়িঘড়ি করেই টেকনিক্যাল কনসালটেন্টের মোড়কে ওড়িয়ে এনেছিলেন নতুন হেড কোচ শ্রীধরন শ্রীরামকে। আর এখন বলছেন, তাঁদের লক্ষ্য না কি আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ!

আর ব্যর্থতাকে কত সহজেই না তিনি আড়াল করে গেলেন কথার মাধ্যমে! ‘এতদিন যা হয়েছে, হয়েছে।’ মানে বিষয়টা কত হালকা! ব্যর্থতাকে ঢাকতে গিয়ে বললেন, একটা দলকে একমাসের মধ্যে ভালো করে দেওয়ার মতো কোনো কোচ বা বোর্ড নাই।

আরেকটা সুন্দর ‘খোকা বোঝানো’ কথা! তা তাঁদেরকে একমাসের মধ্যে দলকে একেবারে ভালো দল বানাতে কে বলেছে? এমন একটা ভাব যেন গেল বিশ্বকাপ থেকে এ বিশ্বকাপের মধ্যবর্তী বিরতিটা কেবল এক মাসের!

হিসাব করলে দেখা যায়, গত বিশ্বকাপ থেকে আজ পর্যন্ত দশমাস সময় পেয়েছে বিসিবি খেলোয়াড়দের প্রস্তুত করার জন্য। এ সময়টায় তাঁরা কী করেছেন? কিছুই না। শুধু হেলায় হেলায় দিন কাটিয়েছেন৷ তাই এখন এসে বলতে হচ্ছে যে, মাত্র একমাসে দলকে ভালো করা সম্ভব না।

আমি বিসিবিকে একেবারে না পেরে একটা ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দিতাম যদি গেল বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আশানুরূপ কিছু করে আসত। একটু ভালো করলেই যে গা-ছাড়া ভাব আসাটা আমাদের স্বভাবগত! কিন্তু গত বিশ্বকাপে এরকম নাজুক পারফরম্যান্সের পরেও কেন দলটা নিয়ে অবহেলা করল বিসিবি?

এই যে এখন শেষবেলায় এসে তড়িঘড়ি করে কনক্রিটের উইকেট বানানোর কাজে হাত দিলেন তাঁরা, এই কাজটা কেন গত বিশ্বকাপের পরপরই ধরলেন না? এখন যে পরবর্তী বিশ্বকাপকে টার্গেট করছেন, ওই সময় কেন আসছে বিশ্বকাপকে টার্গেট করে দশমাসের একটা প্ল্যান করলেন না? রাসেল ডমিঙ্গোর দর্শন টি-টোয়েন্টিতে চলে না বুঝতে এত দেরি হলো কেন?

এগুলোর জবাব কি তাঁরা দিতে পারবেন? উঁহুঁ। এসবের সদুত্তর তাঁদের কাছে নেই বলেই এখন একমাসের দোহাই দিয়ে কোনোমতে পিঠ বাঁচাচ্ছেন।

আসলে এসব কনক্রিটের উইকেট বানানো, আগামী বিশ্বকাপকে টার্গেট – সবই হচ্ছে পাবলিসিটি স্টান্ট। বাংলায় বললে, ভবিষ্যতের মূলা। যেটা মূলত চোখে ধুলা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই না। সময় হলেই মিলিয়ে নিতে পারবেন।

এবার দল নিয়ে কিছু বলি। দল নিয়ে বলতে গেলে আমাদের যে রিসোর্স, তাতে দল ঠিকই আছে বলে আমার মত। এই দল নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন তোলার সুযোগ নাই। রিয়াদকে বাদ দেওয়াটা আমি ব্যক্তিগতভাবে ভালো সিদ্ধান্ত হিসেবে নিয়েছি। সেটা আরো আগেই হওয়া দরকার ছিল বলে বিশ্বাসও করি। আর শান্ত-সৌম্যর ব্যাপারে বলতে গেলে, এই দুইজনের যাঁকেই নেওয়া হতো না কেন, আমার মনে হয় না খুব বেশি তর্কের সুযোগ থাকত বা সিদ্ধান্তটা খুব বেশি ব্যবধান তৈরি করত।

এই মুহূর্তে শান্ত-সৌম্যর একজনকেও আমার প্রস্তুত মনে হয় না এই সংস্করণটা খেলার জন্য। দু’জনেরই পেছনে কোনো পারফরম্যান্স নাই। তবে তুলনায় গেলে শান্তর চেয়ে সৌম্যকে নিলে হয়তো-বা আউটসাইড চান্সটা বেশি থাকত। তবে সেটাও খুব খুব সামান্য। এই ধরেন ২-৩%। সেটা সৌম্যর ওই গতিময় ও বাউন্সি উইকেটে স্বাচ্ছন্দ্যে খেলার সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে।

তারপরেও তাঁর জায়গায় শান্তকে নেওয়ায় একেবারে নির্বাচকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সুযোগ দেখছি না। আর নির্বাচকরাও অপারগ। দলে একজন বিকল্প ওপেনার তো নিতেই হতো। তাই এই চরম সংকটে কোনো পারফরম্যান্স ছাড়াই বাধ্য হয়ে একজনকে নেওয়া হলো এবং তিনি হলেন শান্ত, যা মূলত আমাদের ক্রিকেট সিস্টেমের দরিদ্রতাকেই মোটাদাগে প্রকাশ করছে।

এখন অনেক আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কই হতে পারে। কিন্তু দল যেহেতু একবার ঘোষণা হয়েই গেছে, তাই এসবে আর ফায়দা নাই। আমাদের পছন্দের ক্রিকেটার থাকুক বা না থাকুক, দল পছন্দ হোক বা না হোক, কোনো ইনজুরি সমস্যা দেখা না দিলে এ দলটাই বিশ্বকাপে আমাদের প্রতিনিধি হতে যাচ্ছে।

তাই আশা করি, রিয়াদ না থাকায় দু:খিত হওয়া মানুষটাও চাইবে তাঁর জায়গায় খেলা ক্রিকেটারটা যেন নিজের সেরা খেলাটাই খেলেন। আবার সৌম্যর জায়গায় শান্ত বা সব মিলিয়েই শান্তকে দলে দেখে বিস্মিত এমনকি ক্রুদ্ধ হওয়া মানুষটাও যেন চান শান্ত সুযোগ পেলে তার সদ্ব্যবহার করবেন। কেননা তাতে আখের লাভটা যে বাংলাদেশেরই হবে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...