রকিবুল হাসান, বিরক্তিকর কিংবা কার্যকর

ওয়ানডেতে টেস্ট মেজাজের ব্যাটিং দিয়ে সমর্থকদের কাছে হয়েছেন বেশিরভাগ সময়ই হয়েছেন ‘বিরক্তি’র কারণ। তবে, তাঁর প্রতিভা কিংবা সামর্থ্যের কমতি ছিল না। এক সময় ভাবা হত মিডল অর্ডারের অন্যতম সেরা প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান। অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ভাল করার পর তাঁকে ভাবা হত উদীয়মান এক তারকা। কিন্তু জাতীয় দলে তাঁর স্লো খেলাটা অনেকের কাছেই বিরক্তির কারণ ছিল। এ কারণে অবশ্য বাদ পড়েছেন বেশ কয়েক বার। ঘরোয়া ক্রিকেটে সেরাটা দিয়ে আবারও ফিরেছেন জাতীয় দলে।

সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুক সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রল ব্যাপারটা নিতান্তই সাধারণ। বাজে পারফরম্যান্স কিংবা অন্যান্য ইস্যুতে ক্রিকেটাররা প্রায়শই ট্রলের শিকার হন। আজ থেকে ৮-১০ বছর আগে যদিও ‘ট্রল’ ব্যাপারটা ছিল মানুষের চিন্তাধারার বাইরে। আর যদি সেটা থাকত তাহলে হয়ত ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি ট্রলের শিকার হতেন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান রকিবুল হাসান।

ওয়ানডেতে টেস্ট মেজাজের ব্যাটিং দিয়ে সমর্থকদের কাছে বেশিরভাগ সময়ই হয়েছেন ‘বিরক্তি’র কারণ। তবে, তাঁর প্রতিভা কিংবা সামর্থ্যের কমতি ছিল না। এক সময় ভাবা হত মিডল অর্ডারের অন্যতম সেরা প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান। অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ভাল করার পর তাঁকে ভাবা হত উদীয়মান এক তারকা। কিন্তু জাতীয় দলে তাঁর স্লো খেলাটা অনেকের কাছেই বিরক্তির কারণ ছিল। এ কারণে অবশ্য বাদ পড়েছেন বেশ কয়েক বার। ঘরোয়া ক্রিকেটে সেরাটা দিয়ে আবারও ফিরেছেন জাতীয় দলে।

তবে, জাতীয় দলে কখনোই সামর্থ্যের সেরাটা দিতে পারেননি রকিবুল। ঘরোয়া ক্রিকেট আর জাতীয় দলের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই সেটা স্পষ্ট। তবে, জাতীয় দলে সুযোগও পেয়েছেন বেশ। সে সময়ে বাংলাদেশের কোচ জেমি সিডন্সের অন্যতম প্রিয় খেলোয়াড়ও ছিলেন তিনি। আর সে কারণেই ব্যর্থতার পরেও পেয়েছেন অনেক সুযোগ। কিন্তু সুযোগের ঠিক স্বদ্যব্যবহার করতে পারেননি রাকিবুল। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি বরাবরই ছিলেন সেরাদের একজন।

২০০৪ সাল থেকে ঘরোয়া ক্রিকেটে পদচারণা। বরিশাল বিভাগের হয়েই ক্যারিয়ারের শুরু। এক বছর বাদেই বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। আর অভিষেকেই জিম্বাবুয়ে ‘এ’ দলের বিপক্ষে করেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। পরের বছর ২০০৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে সুযোগ পান তিনি। ব্যাট হাতে বেশ দুর্দান্ত টুর্নামেন্টও কাটালেন। সেখান থেকে ফিরে পরের বছর ২০০৭ সালে গড়লেন বাংলাদেশের হয়ে অনন্য এক রেকর্ড! প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ত্রিপল সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন রকিবুল!

ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর ধারাবাহিক পারফরম্যান্স তাঁকে নিয়ে যায় জাতীয় দলের দোরগোড়ায়। ২০০৮ সালের নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষিক্ত হন তিনি। ওই সফরেই টেস্টেও সুযোগ পান রাকিবুল। মাত্র ২০ বছর বয়সেই জাতীয় দলের আঙিনায় পা দিয়েছিলেন তিনি! এ যেন স্বপ্ন না দেখতেই সব বাস্তবে রূপ নিচ্ছিলো।

ওয়ানডে অভিষেকের দ্বিতীয় ম্যাচেই দেখা পেয়েছিলেন প্রথম ফিফটির। এরপর বেশ কয়েক ম্যাচেই ছিলেন চরম ব্যর্থ। ওই বছরই ভারতের বিপক্ষে খেললেন ক্যারিয়ার সেরা ৮৯ রানের ইনিংস! অভিষেকের পর ২০০৮ সালে ১৭ ওয়ানডেতে খেলে করেছিলেন ৪ ফিফটি। স্ট্রাইক রেট নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও অভিষেক বছরটা ব্যাট হাতে বেশ ভালোই কাটিয়েছিলেন রকিবুল।

পরের বছর স্ট্রাইক রেটের উন্নতি না হলেও গড়ের দিক থেকে ছিলেন ক্যারিয়ারের সেরা অবস্থানে। ২০০৯ মৌসুমে ৩৬ গড়ে প্রায় ৫০০ রান করেছিলেন তিনি! জেমি সিডন্সের বেশ পছন্দেরও হয়ে ওঠেন এর মাঝেই। তবে, ডট বল খেলা নিয়ে সমালোচনাটাও হচ্ছিলো অনেক। উইকেটে পড়ে থাকলেও দ্রুত রান তোলার সেই মানসিকতাটা ছিল না তাঁর মাঝে!

এরপর থেকেই ধীরে ধীরে পারফরম্যান্সের গ্রাফটা আরও নিচে নামতে থাকে। টেস্টেও ছিলেন চরম অধারাবাহিক। অবশ্য টানা সুযোগও পাচ্ছিলেন না সেভাবে। অপরদিকে, ২০০৮ সালে টি-টোয়েন্টি অভিষেক হলেও ওই ফরম্যাটেও ছিলেন একেবারেই অনিয়মিত মুখ। ওয়ানডে ছাড়া বাকি দুই ফরম্যাটে কখনোই সেভাবে ভীত গড়তেই পারেননি তিনি। ওয়ানডেতে টানা সুযোগ পেলেও ছিলেন অধারাবাহিক। তবে, তৎকালীন বাংলাদেশের কোচ জেমি সিডন্স তাঁকে সুযোগ কম দেননি। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি রকিবুল।

২০১০ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল ঘোষণার পর নিজের নাম না দেখে আক্ষেপ করেছিলেন তিনি। একটা চাপা ক্ষোভ তো ছিলোই। তার উপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে দল থেকে বাদ পড়ার পর যেন ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙে যায়। বয়স তখন মাত্র ২২! ক্যারিয়ারে ঠিক মতো উত্থান-পতন, আলো-আধার দেখার আগেই হুট করে ঘোষণা দিলেন অবসরের। অবশ্য বিসিবি তাঁর অবসরের সেই আবেদন গ্রহণ করেননি। পরিবার এবং সতীর্থরাও বোঝালেন তাঁকে আবার ফিরে আসতে। কিন্তু, তিনি প্রথমে বলেছিলেন আর ফিরবেন না।

তবে, প্রায় সপ্তাহ খানেক পর অবসর ভেঙে আবার ঠিকই ফিরেছিলেন তিনি। কিন্তু দলে থিতু হতে পারেননি আর। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৬৫ বলে ৫৯ রানের ইনিংস খেললেও ওই সিরিজ পরই বাদ পড়েন দল থেকে। এরপর আর জাতীয় দলে ওয়ানডেতে ফিরতে পারেননি তিনি। পরের বছর ২০১১ সালে ২ টেস্টে সুযোগ পেলেও বাদ পড়েন এরপরই! জাতীয় দলের দরজাটাও বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে।

তার, টেকনিক কিংবা খেলার স্টাইল টেস্ট ক্রিকেটের সাথে মিললেও সাদা পোশাকেও তিনি লম্বা সময় খেলতে পারেননি। ৯ টেস্টে ১ ফিফটিতে মাত্র ২০ গড়ে রান করেছেন ৩৩৬! টি-টোয়েন্টিতে খেলেছেন ৫ ম্যাচ। এই ৫ ম্যাচে ৮২ স্ট্রাইক রেট আর ১০ গড়ে রান করেছেন মোটে ৫১। তবে বাকি দুই ফরম্যাটের তুলনায় ওয়ানডে ক্যারিয়ারটা ছিল বেশ সমৃদ্ধ। তিন বছরের ক্যারিয়ারে সুযোগ পেয়েছিলেন ৫৫ ম্যাচ! এই ৫৫ ম্যাচে ২৮ গড়ে ৮ ফিফটিতে করেছিলেন ১৩০৮ রান।

সময়ের বিচারে মিডল অর্ডারে তাঁর ব্যাটিং পরিসংখ্যান খারাপ ছিল না। কিন্তু প্রশ্নটা থেকে গিয়েছে স্ট্রাইক রেট নিয়ে! ওয়ানডেতে পুরো ক্যারিয়ারে তিনি মাত্র ৬১ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছেন! স্ট্রাইক রেটের কারণে পুরো ক্যারিয়ারে ছিলেন সমালোচনার বৃত্তে। তাঁর সামর্থ্য নিয়ে কারোই প্রশ্ন ছিল না। কারণ ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরলেই তিনি রান বন্যায় ভাসাতেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে বরাবরই ধারাবাহিক পারফরম্যান্স করেছেন।

ব্যাটিং টেকনিক, শট সিলেকশন সব কিছুতেই ছিলেন বেশ ভাল। ইনিংস বিল্ডআপ করেই খেলতে পছন্দ করতেন। তবে ব্যাট হাতে আগ্রাসী ভূমিকায় তাঁকে দেখা যায়নি কখনোই। একটু তেড়েফুঁড়ে মারতে গেলেই উইকেট দিয়ে এসেছেন তিনি! প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১১৬ ম্যাচে ৩৭ গড়ে ৬৬৬৭ রান! লিস্ট ‘এ’ তে ১৯০ ম্যাচে ৩৯ গড়ে রান করেছেন ৬২২১। ঘরোয়া ক্রিকেটে ৮০ ফিফটি আর ১৭ সেঞ্চুরির মালিক তিনি!

সবশেষ জাতীয় দলে খেলেছিলেন ২০১১ সালে! তখন বয়সটা মাত্র ২৭! মিডল অর্ডারে সাকিব, মুশফিক, রিয়াদদের ভীড়ে আর সুযোগ পাননি তিনি। তবে ওয়ানডেতে টানা ব্যর্থতার পরও তিনি যে লম্বা সময় সুযোগ পেয়েছেন ওই সুযোগটা আরও অনেকেই পাননি! এই ভেবে অন্তত ক্যারিয়ারে আক্ষেপটা নাও থাকতে পারে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...