এক অধ্যাবসায়ীর নির্মাণ

মেলবোর্নে বোলারদের কৃতিত্বে অজিরা বোতলবন্দী মাত্র ১৯৫ রানে। কিন্তু ব্যাটিংয়ে নেমে আবারো স্টার্কের গোলার আঘাতে ছত্রভঙ্গ মায়াঙ্ক আগারওয়ালের স্ট্যাম্প। কামিন্সের প্রতাপে ফিরে যান পূজারা এবং অভিষিক্ত গিলও। তবে কি আবারো লজ্জায় পড়বে ভারত?

সবাই বলতো বিরাট কোহলির ভারত।

কোহলির ভারত নাকি হারার আগে হারে না। দলের বিপদে সবার আগে কথা বলে কোহলির ব্যাট। সেই কোহলিকে বিদায় নিতে হলো দলের ঘোরতম দু:সময়ে। আগের টেস্টেই ৩৬ রানে অলআউটের লজ্জায় পড়া ভারতকে রেখে সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকতে অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে উড়াল দিলেন তিনি ভারতের উদ্দেশ্যে। আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন যাকে, তার উপর অগাধ আস্থা রাখেন বিরাট। ভারতের দু:সময়ের এই কান্ডারির নাম আজিঙ্কা রাহানে।

মেলবোর্নে বোলারদের কৃতিত্বে অজিরা বোতলবন্দী মাত্র ১৯৫ রানে। কিন্তু ব্যাটিংয়ে নেমে আবারো স্টার্কের গোলার আঘাতে ছত্রভঙ্গ মায়াঙ্ক আগারওয়ালের স্ট্যাম্প। কামিন্সের প্রতাপে ফিরে যান পূজারা এবং অভিষিক্ত গিলও। তবে কি আবারো লজ্জায় পড়বে ভারত?

উইকেটে আসেন হ্যাংলা-পাতলা গড়নের রাহানে। প্রথমে বিহারি, তারপর পান্টকে নিয়ে প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দেয়ার পর জাদেজাকে সাথে নিয়ে উপহার দেন সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাস্টার ক্লাস।

কামিন্সের দাপুটে আগ্রাসন, হ্যাজলউডের সুশৃঙ্খল আক্রমণ, স্টার্কের অসম্ভব সব গোলা, আর লায়নের ছলাকলা-কৌশল—সবকিছু রাহানে নামক কঠিন বরফে আছড়ে পড়ে ঝিমিয়ে যেতে বাধ্য হয়। নান্দনিক কাভার ড্রাইভে যখন তিন অঙ্কে পৌঁছান ততক্ষণে ভারত পেয়ে গেছে শতাধিক রানের লিড।

দ্বিতীয় ইনিংসেও ১৯ রানে দুই উইকেট হারিয়ে ভারত যখন কাঁপছে স্টার্ক-কামিন্সের গোলায়, গিলকে সাথে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। অজি আগ্রাসনের সামনে লড়াই করলেন বুক চিতিয়ে। ইতিহাস রচনায় সময় নেন ৬৮ মিনিট। ম্যাচ জিতে সিরিজে সমতা ফেরায় ভারত। ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে গৌরবময় সোনালি পালক যুক্ত করতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন আজিঙ্কা রাহানে।

আর এটাই রাহানের বিজ্ঞাপন। তার ক্যারিয়ারটাই এমন সুযোগ পেলে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার গল্প।

১৯৮৮ সালের ৬জুন ভারতের আহমেদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন আজিঙ্কা মাধুকর রাহানে। ছোটবেলায় ডমবিভিলের গলিতে খেলতে খেলতেই বড় হয়েছেন। দশ বছর বয়সেই দ্রোণাচার্য ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে অনুশীলন শুরু করেন তিনি। সেখানে খেলার সময়ই থানে জেলা দলের হয়ে সুযোগ পান। সেখানে ভালো করার পর তিনি নজর কাড়েন প্রখ্যাত কোচ প্রভীন আমরের। ১৭ বছর বয়স থেকে তার অধীনেই ব্যাটিং চর্চা শুরু করেন তিনি।

১৯ বছর বয়সে মুম্বাইয়ের নিসার আলি ট্রফিতে অভিষেক হয় তাঁর। অভিষেকেই বাজিমাত করেন তিনি, খেলেন ১৪৩ রানের দারুণ এক ইনিংস। দুলীপ ট্রফিতে ইংল্যান্ড লায়ন্সের বিপক্ষে করেন ১৭২ রান। নিজের দ্বিতীয় মৌসুমেই রঞ্জি ট্রফিতে করেন ১০৪৯ রান। মূলত সে মৌসুমে হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে ২৬৫ রান করার পরই সবার নজর কাড়তে সক্ষম হন তিনি।

এরপর টানা তিন মৌসুমে হাজার রানের সীমা অতিক্রম করেন তিনি।

২০১১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের জন্য ভারতীয় দলে ডাক পান রাহানে। এরপর টানা ১৬ মাস তিনি দলের সাথে ছিলেন কিন্তু তার অভিষেক ঘটেনি। অবশেষে ২০১৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফিরোজ শাহ কোটলাতে অভিষেক ঘটে তার। অভিষেক টেস্টে ভালো করতে না পারলেও দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের দলে ডাক পান তিনি।

সেখানেই স্টেইন-মরকেলদের সামলে দ্বিতীয় টেস্টে খেলেন ৯৬ রানের দারুণ এক ইনিংস। অবশেষে বেসিন রিজার্ভে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। পরের বছরই লর্ডসে নিজের প্রথম ইনিংসেই তুলে নেন দারুণ এক সেঞ্চুরি। ২০১৫ বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে করেন ৩৯৯ রান। সে বছরই দিল্লিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এক টেস্টের দুই ইনিংসেই করেন শতরান।

২০১৬ সালে উঠে আসেন আইসিসি টেস্ট ব্যাটিং র‍্যাংকিংয়ের আট নম্বরে।

লাজুক-স্বল্পভাষী এই ক্রিকেটারকে মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে কখনোই উত্তেজিত হতে দেখা যায় না। বরাবরই তিনি ভদ্রতার প্রতিমূর্তি। তাই বলে মাঠে ছাড় দেন নাহ বিন্দুপরিমাণ, লড়ে যান নিজের সবটা দিয়ে। পাশাপাশি তার ক্রিকেট মস্তিষ্কও তুখোড়, তার অধীনে এখনো কোনো ম্যাচ হারেনি ভারত। রঙিন পোশাকের ক্রিকেটে নিয়মিত হতে না পারলেও সাদা পোশাকের ক্রিকেটে নিজেকে করে তুলেছেন অপ্রতিরোধ্য। টেস্টে অবশ্য ইদানিং সময়টা ভাল যাচ্ছে না। দল থেকে বাদ পড়ে সংগ্রাম করছেন মাঠের বাইরে।

সে তুলনায় সীমিত ওভারের ক্রিকেটে কিছুটা বিবর্ণ রাহানের পরিসংখ্যান। ৯০ টি একদিনের ম্যাচ খেলে ৩৫ গড়ে করেছেন ২,৯৬২ রান। ভারতের হয়ে খেলেছেন টি-টোয়েন্টিও, ২০ ম্যাচে করেছেন ৩৭৫ রান। আইপিএলে ২০১২ সাল থেকে রাজস্থানের হয়ে খেলেন তিনি, একপ্রকার দলটির ঘরের ছেলে হয়ে ছিলেন। অবশেষে গত মৌসুমে রিকি পন্টিংয়ের ডাকে যোগ দেন দিল্লী ক্যাপিটালসে। আইপিএলে এখনো পর্যন্ত সংগ্রহ করেছেন চার হাজারের ওপর রান।

তিনি বিরাট কোহলির মতো আগ্রাসী নন আবার পূজারার মতো মৌন সন্ন্যাসীও নন। নান্দনিক ব্যাটিংয়ে উইকেটের চারপাশে শটের ফুলঝুরি ছড়িয়ে বইয়ে দিয়েছেন রানের ফল্গুধারা। ক্রিকেটের স্বার্থকতা বুঝি এখানেই।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...