গ্যারেথ বেল, দ্য হান্ড্রেড মিলিয়ন ম্যান

১৯৫৮ সালের পর এই গ্যারেথ বেলের হাত ধরেই এবারের বিশ্বকাপে জায়গা পেয়েছিল ওয়েলস। ওয়েলসের ফুটবল ইতিহাসেও ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে নিজেকে নিয়ে গেছেন একদম শীর্ষে। ওয়েলসের হয়ে সর্বোচ্চ ১১১ টি ম্যাচ খেলার রেকর্ড তাঁর। একই সাথে ওয়েলসের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলের কীর্তিও বেলের(৪১)।

বয়সটা ত্রিশ পেরিয়ে কেবল ৩৩। এই বয়সে অনেকেই দিব্যি ফুটবল ক্যারিয়ার চালিয়ে যান। লিওনেল মেসি বিশ্বজয় করলেন ৩৫ বছর বয়সে। ইব্রাহোমোভিচ এসি মিলানের হয়ে সিরিআ জিতলেন বয়সের কোঠা চল্লিশ পেরোনোর পর। এরকম ত্রিশোর্ধ্ব ফুটবলারের সংখ্যা অগণিত। দেশের হয়ে না হোক, অন্তত ক্লাব ফুটবল দাপিয়ে বেড়ান অনেকেই। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই পেশাদার ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে দিলেন ওয়েলসের ফুটবলার গ্যারেথ বেল।

১৯৫৮ সালের পর এই গ্যারেথ বেলের হাত ধরেই এবারের বিশ্বকাপে জায়গা পেয়েছিল ওয়েলস। ওয়েলসের ফুটবল ইতিহাসেও ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে নিজেকে নিয়ে গেছেন একদম শীর্ষে। ওয়েলসের হয়ে সর্বোচ্চ ১১১ টি ম্যাচ খেলার রেকর্ড তাঁর। একই সাথে ওয়েলসের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলের কীর্তিও বেলের(৪১)।

গ্যারেথ বেলের ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল সাউদাম্পটনের হয়ে। এরপর আরেক ইংলিশ ক্লাব টটেনহ্যামে তিনি যোগ দেন। তবে বিশ্ব ফুটবলে গ্যারেথ বেল প্রথম লাইম লাইটে আসেন ২০১৩ সালে। সে বছর রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদে। আর সেই রিয়াল মাদ্রিদের হয়েই ক্লাব ফুটবলে সর্বজয়ীদের দলে নাম লেখান তিনি।

২০১৩ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৫ বার উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতেছেন তিনি। আর রিয়াল মাদ্রিদের সোনালি সময়ে বেনজেমা, বেল, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে নিয়ে মাদ্রিদের আক্রমণ ভাগের ‘বিবিসি’ ত্রয়ীর অন্যতম ফ্রন্টম্যান ছিলেন এই বেল।

অবাক করা ব্যাপার হল, যে গ্যারেথ বেল প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে তাঁর গতি দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে দিতেন সেই বেলই কিনা ক্যারিয়ারের প্রথমদিকে একজন ডিফেন্ডার ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি উইঙ্গার বনে গিয়ে প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে রীতিমত ভীতি ছড়িয়েছেন।

গ্যারেথ বেলকে বরাবরই বড় ম্যাচের খেলোয়াড় বলা হয়ে থাকে। একটু পেছন ফিরে তাকালে চোখে ভেসে উঠবে, কোপা দেল রে’র ফাইনালে বার্সেলোনার বিপক্ষে সেই স্প্রিন্ট গতিতে গোল কিংবা লিভারপুলের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে বাইসাইকেল কিকে সেই দুর্দান্ত গোলের দৃশ্য। এ ছাড়া গ্যালাতাসারের বিপক্ষে প্রায় ২৫ গজ থেকে ফ্রি-কিক থেকে করা গোল তো এখনও চোখের প্রশান্তি জোগায়।

সে সময়ে বার্সেলোনার আধিপত্যে রীতিমত কোণঠাঁসা রিয়াল মাদ্রিদ। লা লিগা থেকে শুরু করে কোপা দেল রে, চ্যাম্পিয়নস লিগ- সব খানেই বার্সা সাম্রাজ্য চলছিল। তো ২০১৪ কোপা দেল রে’র ফাইনালে উঠেছিল বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদ।

সে সময়ের বিবেচনায় ম্যাচের আগে পরিস্কার ফেবারিট বার্সা। কিন্তু রিয়াল-বার্সা এল ক্লাসিকো। একপেশে ম্যাচ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সেই আপ্ত বাণীকে সত্যি করে ঠিকই দারুণ এক লড়াইয়ের রেশ দেখা গেল ম্যাচে। দুই দলই মিনিট চল্লিশের মধ্যে গোলের দেখা পেল।

তবে ব্যবধানটা বাড়িয়ে দেওয়ার কাজটা করলেন সেই গ্যারেথ বেল। নিজেদের অর্ধে বল পেয়ে বাঁ প্রান্ত থেকে দৌড় শুরু করলেন। কিন্তু সেই স্প্রিন্ট গতি যেন থামারই নয়। বার্সা ডিফেন্ডার মার্ক বাত্রা তাঁর সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেয়ে একবার ধাক্কা দেওয়ারও চেষ্টা করলেন। কিন্তু বেল সেখানে থামলেন না। তাঁর দৌড়টা থামলো বার্সার জালে বল জড়ানোর পর। ক্যারিয়ারে অনেক দৃষ্টিনন্দন গোল করেছেন বেল। তবে তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা গোল হিসেবে বার্সার বিপক্ষে এই গোলটাই ধরা হয়।

দারুণ প্রতিভা থাকা স্বত্ত্বেও গ্যারেথ বেলের ক্যারিয়ার ঠিক সেভাবে পরে আর এগোয়নি। এগোয়নি বললে কিছুটা অবশ্য ভুল বলা হবে। মূলত ইনজুরি তাঁকে এগিয়ে যেতে দেয়নি। রিয়ালের হয়ে শেষের দিনগুলো বলতে গেলে এক প্রকার বেঞ্চে বসেই কাটিয়েছেন। মাঝে নিজের পুরনো ক্লাব টটেনহ্যামে ফিরে গিয়েছিলেন।

তবে, সেখানেও জেঁকে বসে ইনজুরি। এরপর আবার রিয়ালে ফিরে যান। কিন্তু নিজের ভাগ্য আর বদলায়নি। ব্রাত্য হয়েই চলতে থাকে ক্লাব ক্যারিয়ার। গত বছর মেজল লিগ সকার লস অ্যাঞ্জেলস এফসিতে যোগ দিয়েছিলেন।  তবে সেখানেও খুব একটা আলো ছড়াতে পারেননি তিনি। ১২ ম্যাচে করেছিলেন ২ টি গোল।

বিশ্বকাপের পর আর মাঠে নামা হয়নি গ্যারেথ বেলের। হয়তো এই ৩৩ বছর বয়সেই নিজের শেষ দেখে ফেলেছিলেন তিনি। টেনে হিঁচড়ে আর লম্বা করতে চাননি ক্যারিয়ার। তাই পুরো ফুটবলটাকেই বিদায় বলে দিলেন গ্যারেথ বেল।

ক্যারিয়ারে ৬৪৭ ম্যাচে ২২৭ গোল করেছেন। এর মধ্যে রিয়ালের হয়েই করেছেন ১০৬ টি গোল। সংখ্যা তত্ত্বের হিসেবে এই সংখ্যাটা হয়তো বেশি না। কিন্তু ক্যারিয়ারের সেরা সময়ের গ্যারেথ রীতিমত ডিফেন্ডারদের নাভিশ্বাসের কারণ হয়ে ছিলেন। সে সময়ের গ্যারেথ বেল নামটাই যেন ছিল বিদ্যুৎ গতির স্ট্রাইকার। আরেকটু বাড়িয়ে বললে, ফুলটাইম ফুটবলার, পার্ট টাইম স্প্রিন্টার।

ফুটবল মানচিত্রে ওয়েলসের ইতিহাস তেমন সমৃদ্ধ কখনোই ছিল না। বেল আসার আগে ওয়েলস কালেভদ্রে ইউরোতে সুযোগ পেত। আর বিশ্বকাপ তো অনেক দূরের পথ। কিন্তু বেলস সেই ওয়েলসকে নিয়ে রীতিমত উত্থানের এক কাব্য লিখেছেন। ২০১৬ ইউরো ফুটবলে বলতে গেলে ওয়েলসকে একাই নিয়ে গিয়েছিলেন সেমিফাইনালে। এরপর আক্ষেপ বলতে ছিল শুধু একবারও বিশ্বকাপ না খেলা। ২০২২-এ এসে সেই আক্ষেপও তিনি মিটিয়েছেন। ওয়েলসকে নিয়ে গিয়েছিলেন কাতার বিশ্বকাপে।

ছোট দলের বড় তারকা- এই কথাটা গ্যারেথ বেলের ক্ষেত্রে একদম যথোপযুক্ত। দিনশেষে, খর্বশক্তির দলের হয়ে হয়তো ব্যক্তি অর্জনটাকে খুব বেশি ভারি করা যায় না। কিন্তু খর্বশক্তি দলের মধ্যমণি হয়ে প্রতিকূলতায় ভরা পথ ডিঙানোর সাহসই বা কে দেখায়। কিংবা সফলই বা কজন হন। গ্যারেথ বেল সেই বিবেচনায় নিশ্চিতভাবেই সফলদের কাতারেই থাকবেন। বিদায় বেলায় তাই পরম তৃপ্তিবোধ নিয়ে ‘গুডবাই’ বলতেই পারেন গ্যারেথ বেল।

সাউদাম্পটন থেকে লস অ্যাঞ্জেলস- যাত্রাটা তো আর কম দিনের নয়। অনেক গুলো দিন, মাস পেরিয়ে ১৭ টা বছর। এত গুলো বছরে কতশত কীর্তি, স্মৃতি, চোখ আটকে থাকার মত জাদুকরী সব মুহূর্ত। পড়ন্ত বেলায় গ্যারেথ বেলকে তাই একটা ধন্যবাদ জানাতেই হয়। ধন্যবাদ গ্যারেথ বেল।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...