‘কাল্ট হিরো’ ক্রেসপো

ধূর্ততা এবং সুদক্ষতার একটা কদর ফুটবল সব সময়ই দেয়। বিশেষ করে একজন স্ট্রাইকারের ক্ষেত্রে। আর তাতে রেকর্ড হতে দেখেছি আমরা বহুবার। তেমন এক রেকর্ড হয়েছিল একবিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে। ২০০০ সালে রেকর্ড ট্রান্সফার ফি-তে ইতালির ক্লাব লাজিওতে যুক্ত হয়েছিলেন আর্জেন্টাইন তারকা স্ট্রাইকার হারনান ক্রেসপো।

ধূর্ততা এবং সুদক্ষতার একটা কদর ফুটবল সব সময়ই দেয়। বিশেষ করে একজন স্ট্রাইকারের ক্ষেত্রে। আর তাতে রেকর্ড হতে দেখেছি আমরা বহুবার। তেমন এক রেকর্ড হয়েছিল একবিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে। ২০০০ সালে রেকর্ড ট্রান্সফার ফি-তে ইতালির ক্লাব লাজিওতে যুক্ত হয়েছিলেন আর্জেন্টাইন তারকা স্ট্রাইকার হারনান ক্রেসপো।

হারনান ক্রেসপো আর্জেন্টিনাতে যিনি জন্মেছিলেন ১৯৭৫ সালের পাঁচ জুলাই। ধূর্ত প্রকৃতির এই স্ট্রাইকার তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন স্বদেশি ক্লাব রিভার প্লেটের হয়ে। ১৯৯৩ সালে তিনি পেশাদার ফুটবলে পা রাখেন। ক্রমশ একজন সাদামাটা অতি সাধারণ ফুটবলার থেকে চাহিদার শীর্ষে থাকা একজন স্ট্রাইকারে পরিণত হন ক্রেসপো। রিভার প্লেটের সাথে নিজের ক্যারিয়ারটা শুরু করলেও তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়টা তিনি কাটিয়েছেন ইতালিয়ান ক্লাব পার্মাতে।

ইতালিয়ান সিরি আ-কে বলা হয় রক্ষণ শিল্পের আঁতুড়ঘর। সেখানটায় রক্ষণ শিল্পের থেকে বড় কিছু। সেখানটায় খুব যত্ন করা হয় ডিফেন্ডারদের। আলাদা পরিকল্পনা সাজানো হয় নিজেদের দূর্গ সামলাবার। আর কতশত তারকা ডিফেন্ডারদের যে ছড়াছড়ি। তবে রক্ষণের পুন্যভূমিতে বারবার বিদ্রোহ যেন করেন হারনান ক্রেসপোর মত স্ট্রাইকাররা। তাঁরা শত বাঁধা ডিঙিয়ে খুঁজে নেন জালের ঠিকানা।

পার্মাতে তাঁর অনবদ্য পারফরমেন্সই পরবর্তীতে বাধ্য করেছিল লাজিওকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ খরচে। পার্মার হয়ে তরুণ ক্রেসপো চার মৌসুমে ১৫১ ম্যাচে করেছিলেন ৮০ গোল। ইতালিয়ান ক্লাব ফুটবলের প্রেক্ষাপটে যা দুর্দান্ত এক পরিসংখ্যান। তাঁর গোল করার দক্ষতার প্রশংসা ছিল পুরো ইউরোপ জুড়েই। ডি-বক্সের আশেপাশে তিনি ছিলেন বেশ চতুর। প্রতিপক্ষে পদক্ষেপ পর্যালোচনা করা ছাড়াও সতীর্থকেও পড়তে পারতেন তিনি। সে অনুযায়ী মুহূর্তের মধ্যে নিজের অবস্থানের পরিবর্তন এনে গোলের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতেন বহুগুণে।

আর সুযোগ হাতছাড়া করার প্রবণতাও ছিল তাঁর বেশ কম। তিনি যেন ছিলেন একজন ‘কমপ্লিট স্টাইকার’। ‘ফক্স ইন দ্য বক্স’  বলতে যা বোঝায় আর কি। তাইতো দারুণ অর্থনৈতিক টানা পোড়েনের মাঝেও সে সময়ের রেকর্ড ৩৫ মিলিয়ন ইউরোতে তাঁকে দলে ভিড়িয়েছিল ইতালিয়ান আরেক ক্লাব লাজিও। গোটা ইউরোপিয়ান ফুটবল পাড়ায় রীতিমত শোরগোল পড়ে গেল।

প্রথম মৌসুমেই লাজিওর হয়ে ইতিলিয়ান সুপার কোপা জিতে যান হারনান ক্রেসপো। পাভেল নেদভেদ, ডিয়েগো সিমিওনি, অ্যালেসান্দ্রো নেস্তা, হুয়ান সেবাস্টিয়ান ভেরনদের মত সতীর্থদের পাশে পেয়েছিলেন ক্রেসপো। তাঁদের সহযোগিতায় তিনি ২৬ দফা প্রতিপক্ষের রক্ষণদূর্গে চিড় ধরিয়ে আদায় করে নিয়েছিলেন গোল। সেটা তাঁকে সেবারের মৌসুমে সিরি আ-র সর্বোচ্চ গোলদাতা হতে সহয়তা করেছিল।

তবে সে সুখের দিন আর বেশিদিন টেকেনি। অর্থনৈতিক নানান জটিলতায় লাজিও তাঁদের অধিকাংশ খেলোয়াড়দের বিক্রি করে দেয় মৌসুমের ব্যবধানে। পরের মৌসুমে আবার ক্রেসপোর ক্যারিয়ারের অন্যতম শত্রুর হানা দেওয়া শুরু হয়ে যায়। ইনজুরির থাবায় সেবার খুব বেশি ম্যাচে লাজিওর হয়ে নামা হয়নি তাঁর। তবুও তিনি ২০টি গোল করেছিলেন লাজিওর সাথে খেলা দ্বিতীয় মৌসুমে। এর থেকে খানিক আন্দাজ করে নেওয়া যায় যে ঠিক কতটা সুদক্ষ এবং কার্যকর একজন স্ট্রাইকার তিনি ছিলেন।

সেবারের মত ইতালিয়ান ক্লাব ফুটবলের পাট চুকিয়ে তিনি  পাড়ি জমিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। রোমান আব্রাহোমোভিচের চেলসি পুনঃগঠনের শুরুর দিকে ক্রেসপো ছিলেন সে দলের অংশ। তবে সেখানে খুব বেশি আলো তিনি ছড়াতে পারেননি। কারণটা সে ইনজুরি। থিতু হতে পারেননি দলে। হোসে মরিনহোর দলে ঠিক নিজের স্থান খুঁজে না পাওয়ায় ক্রেসপো চলে যান আবার ইতালিতে। তবে ধারে। এসি মিলানের হয়ে সুপার কোপা জেতেন তিনি। তবে সে দফায় তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছিলেন ভিন্ন কারণে।

মিলানের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে দুই গোল করেছিলেন তিনি। ইংলিশ ক্লাব লিভারপুলের বিপক্ষে করা সে দুই গোল অবশ্য খুব একটা কাজে আসেনি। দ্বিতীয়ার্ধের অল রেডদের অভাবনীয় প্রত্যাবর্তনে ম্যাচটি হেরে গিয়েছিল এসি মিলান। তাঁর আর ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের নিশানা হাত দিয়ে ছুঁয়ে ধরা হয়ে ওঠেনি। এক মৌসুম বাদেই তিনি ফেরেন লন্ডনে। আর ফিরেই বনে যান চেলসির ‘কাল্ট হিরো’।

তাঁর ম্যাচকে প্রভাবিত করার সক্ষমতা, গোল বারের সামনে চতুরতা আর তাঁর অ্যাটাকিং দক্ষতা সব মিলিয়ে তিনি চেলসির একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত হন। লন্ডনের ক্লাবটির হয়ে লিগ শিরোপা জেতা ছাড়াও এফ এ কমিউনিটি শিল্ড জিতেছিলেন হারনান ক্রেসপো। তবে এতসব কিছুর মাঝেও যেন ঠিক ‘লিথ্যাল স্ট্রাইকার’ হওয়ার যে সব গুণাবলি প্রয়োজন তা যেন স্তিমিত হতে শুরু করে ক্রেসপোর।

গোল করার সামর্থ্য সময়ের সাথে কমতে থাকে। বয়স যেমন একটা বড় বিষয় ছিল ঠিক তেমনি আরও বেশি যা প্রভাবিত করেছে তা হচ্ছে ইনজুরি। তবে এত কিছুর মাঝেও আর্জেন্টিনার হয়ে ৩৫ গোল করেছেন তিনি। তাছাড়া আলবেসেলেস্তাদের হয়ে তিনটি বিশ্বকাপেও অংশ নিয়েছিলেন হারনান ক্রেসপো। ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ এই তিন বিশ্বকাপে তিনি আকাশি নীলদের আক্রমণটা সামলে যাওয়ার  চেষ্টা করেছেন।

ক্লাব ফুটবলের চড়াই-উৎরাইয়ের মাঝেও তিনি জাতীয় দলে নিজের ছাপটা ঠিক রেখে যেতে পেরেছিলেন। আর্জেন্টিনার ফুটবলের ইতিহাসে তিনি চতুর্থ সর্বোচ্চ গোলদাতা। তাঁর উপরে রয়েছেন সার্জিও অ্যাগুয়েরো, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা ও লিওনেল মেসি। ২০০৭ এ শেষ তিনি জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ালেও ক্লাব ফুটবলটা খেলে গেছেন ২০১১ সাল অবধি।

যে ক্লাব থেকে তিনি হয়েছিলেন ইউরোপীয় ফুটবলে ‘হটকেক’ সে পার্মাতেই দ্বিতীয় দফা ফেরত যান। তাঁদের সাথে তিন মৌসুম কাটিয়ে তিনি বিদায় জানান খেলোয়াড়ি জীবনকে। ৩০০এর বেশি গোলের এক বণার্ঢ্য ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে। পরবর্তী জীবনে তিনি কোচিং ক্যারিয়ারকে বেছে নেন। বর্তমানে তিনি কাতারের ক্লাব আল-দুহাইলের কোচের দায়িত্ব পালন করছেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...