বাড়তি ‘সহিষ্ণুতা’য় কর লাগবে না

কোহলি দক্ষিণ আফ্রিকায় রঙিন পোশাকে মঞ্চ রাঙাবেন নাকি ছুটি নেবেন, তা সময় বলবে। কিন্তু এই লেখাটা থাক। আরেকবার। নিজের লেখাকে কখনও দরকারি মনে হয়নি, এটা ব্যতিক্রম। বেন স্টোকস মাঝখানে অনির্দিষ্ট কাল ছুটি নিয়েছিলেন। সেটা নিয়েই লিখেছিলাম মাস ছয়েক আগে। ক্রিকেটারদের মানবিক দিকটা আমাদেরও ভাবা দরকার। লেখাটা কিছুটা সেটা মনে করিয়ে দেবার জন্যেই।

হঠাৎ একটা খবর দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বেন স্টোকস অনির্দিষ্ট কালের জন্যে ক্রিকেট থেকে বিরতি নিচ্ছেন। অনেকেই হয়তো নাক কুঁচকাবেন। কেউ কেউ আবার দায়িত্ববোধের প্রশ্ন তুলবেন। কিন্তু একটা কথা বোধহয় আমরা সবাই ভুলে যাবো। দিনের শেষে স্টোকস একজন মানুষ। ক্রিকেট তাঁর চাকরি। সৌভাগ্যক্রমে, তিনি যে জিনিসটা ভালোবাসেন, সেটাই পেশা হিসাবে বেছে নিতে পেরেছেন। এবং তার পিছনে রয়েছে তাঁর অপ্রতুল প্রতিভা।

গত অস্ট্রেলিয়া সফরে বিরাট কোহলি যখন পিতৃত্বকালীন ছুটিতে গেছিলেন, তখন তাঁকে নিয়ে হাহাকার শুরু হয়ে গেছিলো। কিন্তু তখন আমরা একটা কথা স্বচ্ছন্দে ভুলে গেছিলাম, যে ক্রিকেট টাও একটা খেলাই। দেশের ঝান্ডা, দায়িত্ববোধ ইত্যাদি একজন ক্রিকেটারের পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলে নিয়ে আসছি আমরা-অর্থাৎ ক্রিকেট দর্শক। ধোনি বা বিরাট যদি বিশ্বকাপে পাকিস্তান ম্যাচের আগে ফেবু বা টুইটার জনতার মতো চেগে থাকেন, তাহলে তো ইমোশনের গ্রাসেই তাঁদের ক্রিকেট ছড়িয়ে ছেচল্লিশ।

ধরুন আপনি রোজ সকালে অফিস যাচ্ছেন, আর আপনাকে আপনার পরিবার বললো, শোনো আজ আপিসে ঠিকঠাক কাজ না পারলে কিন্তু বাড়িতে এসে চরম ঝার খাবে। কাজে আপনার মন বসবে? জানিনা। আমার বোধহয় বসবে না। ক্রিকেটারদের ব্যাপারটাও এক। তাই তাঁরা বড়ো ম্যাচ ট্যাচের আগে মানসিক ভাবে একটা নির্জন দ্বীপে অবস্থান করেন। নিজেদের খেলাটা নিয়ে ভাবেন।

এবার অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাশেজ। অস্ট্রেলিয়ার উদ্ভট নিভৃতবাস নিয়ম বলছে ইংরেজ খেলোয়াড়রা নিজেদের পরিবারকে সঙ্গে রাখতে পারবে না। বড়দিন, নববর্ষ কাটাতে হবে পরিবারকে ছেড়ে। সেই কারণে অনেক ইংরেজ ক্রিকেটার সিরিজ ছেড়ে দেবেন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। সেই নিয়ে অনেকেই ঠাস-ঠাস দ্রুম-দ্রাম চালু করে দিয়েছেন, যে, ধুর আজকালকার ক্রিকেটাররা কি মিনমিনে। কিন্তু আপনি ভাবুন, আপনি একদিন আপিসে হাফ-ডে নিতে পারেন।

বাড়িতে আত্মীয় এসেছে বলে একদিন বিনা নোটিসে কাটও বোধহয় মেরেছেন। আর সেখানে একজন ক্রিকেটারের ম্যাচের মাঝখানে, ‘ধুর আজ আর ব্যাট করতে ভালো লাগছে না’ বলে বেরিয়ে যাওয়ার যো নেই। একজন ক্রিকেটারের পারিশ্রমিক আর একজন সাধারণ চাকুরের মাইনের আকাশ পাতাল পার্থক্য, কিন্তু চাপটারও বোধহয় ঠিক ততটাই পার্থক্য। আপনি একটা ডেডলাইন মিস করলে বড়োজোর বসের ধ্যাতানি খাবেন। আর একজন ব্যাটসম্যান একটা বলের লাইন মিস করলে ক্রিকেট জীবনেই ইয়েল লক লেগে যাবে। সে তালা খোলার কম্বিনেশন খুঁজতে খুঁজতে জীবন কাবার।

কোভিড-১৯ বিশেষ করে ক্রিকেটের জন্যে একটা সুখকর কাজ করেছে। ক্রিকেটারদের মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাপারটাকে স্টোর রুম থেকে ধুলো ঝেড়ে বার করেছে। জনাথন ট্রটের ক্রিকেট জীবন এই সচেতনতার অভাবে শেষ হয়ে যায়। কাজেই আজ বেন স্টোকস যদি ক্রিকেট থেকে মানসিক কারণে অনির্দিষ্টকাল বিরতি নেন, তাহলে আদতে ক্রিকেটেরই লাভ।

তাজা হয়ে ফিরে আসবেন। যদি নাও আসেন, কোনো ক্ষতি নেই। তাঁর নিজের জীবন তিনি কিভাবে অতিবাহিত করবেন সেটা তাঁর ব্যাপার। তিনি ও পাড়ার বাবাইয়ের রোল মডেল হবার ঠিকা নিতে যাননি। জানেন, যতদিন ব্যাট চলবে, লোকে তাঁকে নিয়ে নাচবে। কিন্তু ওই ঘন সবুজ আর বিস্কিট রংয়ের বাইরেও মানুষ স্টোকস একটু নিজের মতো বাঁচুন না। কোহলিও না হয় পিতৃত্বকালীন ছুটি নিন। আমরা ক্রিকেট বা যেকোনো খেলার মানসিক দিক গুলো নিয়ে একটু সহিষ্ণু হই। হলে তো আর আমাদের বাড়তি ‘সহিষ্ণুতা’য় কর লাগবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link