ভারতের সর্বকালের সেরা টেস্ট একাদশ

পরিসংখ্যান নয়, শেবাগকে দলে নেবার মূল কারণ তার ভয়ডরহীন ব্যাটিং। পারফেক্ট টেস্ট ওপেনারের সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছেন তিনি। নিজের দিনে প্রতিপক্ষের বোলারদের নিয়ে রীতিমত ছেলেখেলা করতেন। শেবাগই প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটার যিনি পাকিস্তানের বিখ্যাত বোলিং লাইন আপের বিরুদ্ধে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন। এছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলেন ২৭৮ বলে ৩১৯ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস।

শতবর্ষের বেশি সময় ধরে টেস্ট ক্রিকেটকে ভারত উপহার দিয়েছে অসাধারণ সব ক্রিকেটার। শচীন-বিরাটের মত ব্যাটসম্যান যেমন উঠে এসেছেন, তেমনি বল হাতে রাজত্ব করেছেন অনিল কুম্বলের মত বোলার। এত এত প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের ভিড়ে সেরা একাদশ বানানো খুবই দু:সাধ্য। তবুও ভারতের ইতিহাসের সেরা টেস্ট একাদশ বেছে নেয়ার একটা প্রচেষ্টা করাই যায়। আপনি চাইলে মিলিয়ে নিতে পারেন আপনার পছন্দের একাদশের সাথে।

  • ওপেনার

ভারতের সর্বকালের সেরা টেস্ট একাদশে সবচেয়ে কঠিন কাজ বোধহয় দুইজন ওপেনার বাছাই করা। যুগে যুগে অসাধারণ সব ব্যাটসম্যানরা ভারতের হয়ে ইনিংসের উদ্বোধন করেছেন। তবে সবাইকে ছাপিয়ে এই দলে জায়গা করে নিয়েছেন নজফরগড়ের নবাব, বীরেন্দ্র শেবাগ। ভারতের ইতিহাসে টেস্টে সর্বাধিক রান সংগ্রহকারীদের তালিকায় শেবাগের অবস্থান পঞ্চম। তবে পরিসংখ্যান নয়, শেবাগকে দলে নেবার মূল কারণ তাঁর ভয়ডরহীন ব্যাটিং।

পারফেক্ট টেস্ট ওপেনারের সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছেন তিনি। নিজের দিনে প্রতিপক্ষের বোলারদের নিয়ে রীতিমত ছেলেখেলা করতেন। শেবাগই প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটার যিনি পাকিস্তানের বিখ্যাত বোলিং লাইন আপের বিরুদ্ধে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন। এছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলেন ২৭৮ বলে ৩১৯ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস।

এক পাশে যখন মারমুখী শুরু করবেন, তখন অন্য পাশের ব্যাটসম্যানকে হতে হবে কিছুটা মৌন, শান্তশিষ্ট। আর এই কাজটা সুনীল গাভাস্কারের চাইতে ভাল বোধহয় আর কেউই পারবেন না। অসাধারণ টেকনিক আর ক্রিকেটীয় ব্যাকরণ মেনে অসাধারণ সব শটে আশির দশকে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন তিনি। টেস্ট ক্যারিয়ারে ৫১.১২ গড়ে সংগ্রহ করেছেন ১০,১২২ রান। ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম দশহাজারী ক্লাবে প্রবেশ করা ব্যাটসম্যান তিনি। ভারতের সর্বকালের সেরা একাদশে আমাদের পছন্দের ওপেনিং জুটি তাই বীরেন্দর শেবাগ আর সুনীল গাভাস্কার।

  • মিডল অর্ডার

ভারত থেকে অসাধারণ সব ব্যাটসম্যান উঠে এলেও তিন নম্বর পজিশনে বোধহয় রাহুল দ্রাবিড়কে নিয়ে কেউই প্রশ্ন তোলার সাহস করবেন না। তাঁর ক্লাস, নিয়মানুবর্তিতা, আত্নত্যাগ, ক্রিকেটের প্রতি অনুরাগ তাকে পরিণত করেছে ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা রূপে। উইকেটে যেন আসন গেঁড়ে বসতেন, এজন্যই তাকে বলা হত “দ্য ওয়াল অফ ইন্ডিয়া”। এক পাশ আগলে রেখে প্রতিপক্ষের বোলারদের হতাশ করতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।

তাঁর উইকেট পেতে প্রতিপক্ষ বোলারদের রীতিমত সাধনা করতে হত। এছাড়া স্লিপ ফিল্ডার হিসেবেও দারুণ ছিলেন দ্রাবিড়। টেস্ট ক্যারিয়ারে ২১০ টি ক্যাচ, উইকেটকিপার বাদে যে কোনো ফিল্ডারের জন্য যা সর্বোচ্চ। পেস কিংবা স্পিন দুই ধরনের বোলিংয়ের বিপক্ষে সমান স্বাছন্দ্যবোধ করা দ্রাবিড় ১৬৪ টেস্টে সংগ্রহ করেছেন ১৩,২৮৮ রান। ৩৬ শতকের পাশাপাশি ৬৩টি অর্ধ-শতক রয়েছে এই ব্যাটসম্যানের।

চার নম্বর পজিশনে নামবেন শচীন টেন্ডুলকার। শচীনকে কেন নেয়া হল সেই ব্যাখ্যা দেয়া আসলে নিষ্প্রয়োজন, কারণ তিনিই যে ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’। ২৪ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে অসাধারণ সব মূহুর্তের জন্ম দিয়েছেন তিনি। বিশ্বের যে কোনো পিচে, যেকোনো পরিস্থিতিতে, যেকোনো বোলিং লাইন আপের বিরুদ্ধে রান করেছেন নির্দ্বিধায়। ইনিংস গড়তে কিংবা সময়ের প্রয়োজনে আক্রমণাত্নক ব্যাটিং করতে তাঁর তুলনা কেবল তিনিই। তাঁর কাভার ড্রাইভ ছিল দর্শকদের চোখের প্রশান্তি। ২০০ টেস্ট খেলে ৫১ শতক আর ৬৮ অর্ধ-শতকে ৫৩.৭৯ শচীনের সংগ্রহ ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বোচ্চ ১৫,৯২১ রান। ব্যাটিং এর পাশাপাশি খন্ডকালীন ডানহাতি স্পিনার হিসেবেও শচীনের ঝুলিতে আছে ৪৬ উইকেট।

পাঁচ নম্বরে নামবেন শচীন টেন্ডুলকারের পর ভারতকে ব্যাটিং লাইন আপকে সামনে পথ দেখানো বিরাট কোহলি। এই পজিশন নিয়ে ভিভিএস লক্ষণের সাথে তাঁর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে, তবে বিদেশের মাটিতে অসাধারণ পারফর্ম করায় দলে জায়গা পেয়েছেন বিরাট। তাছাড়া তাঁর ক্রিকেট মস্তিষ্কটাও অসাধারণ, আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অধিনায়ক তিনি। ২০১৭ সালে ভারতকে এনে দেন আইসিসি টেস্ট র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থান। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথম সিরিজ জয়ী অধিনায়ক তিনি। আমাদের এই দলের অধিনায়ক হিসেবে তাই থাকবেন বিরাট কোহলি।

ছয় নম্বরে উইকেটরক্ষক হিসেবে মহেন্দ্র সিং ধোনির জায়গাটা অবধারিত। সাদা বলের ক্রিকেটে ভারতকে বিশ্বকাপ জেতালেও লাল বলের ক্রিকেটেও ছিলেন সমান কার্যকরী। মিডল অর্ডার ব্যর্থ হলে শেষের দিকের ব্যাটসম্যানদের নিয়ে গড়েছেন ম্যাচ বাঁচানো সব জুটি। ভারতের হয়ে টেস্ট দ্বি-শতক হাঁকানো একমাত্র উইকেটরক্ষক তিনি। ভারতের হয়ে ৯০ টেস্টে উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে ছয় শতকের সাহায্যে তাঁর সংগ্রহ ৪৮৭৬ রান। তাঁর চেয়ে বেশি রান করতে পারেননি ভারতের অন্য কোনো উইকেটরক্ষক। এছাড়া জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ ডিসমিসালের রেকর্ডও তাঁর দখলে- ২৯৪ ডিসমিসাল।

  • অলরাউন্ডার

পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে দলে সুযোগ পেয়েছেন কিংবদন্তি কপিল দেব। তাঁর অবসরের চার দশক পেরিয়ে গেলেও এখনো তাঁর সমমানের কাউকে পায়নি ভার‍ত। ১৩১ টেস্ট খেলে প্রায় ৩৫ গড়ে তার সংগ্রহ ৫২৪৮ রান। লেট মিডল অর্ডারের নামলেও তাঁর নামের পাশে আছে আট সেঞ্চুরি। তবে বল হাতেই বেশি বিধবংসী ছিলেন কপিল, ৪৩৪ উইকেট নিয়েছেন মাত্র ২৯ গড়ে। ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন ২৩ বার। নিজের সময়ে তিনিই ছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। পরবর্তীতে অবশ্য অনিল কুম্বলে সেই রেকর্ড ভেঙে দেন।

স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে এই তালিকায় জায়গা পাচ্ছেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। স্পিন বোলিংকে রীতিমত শিল্পে পরিণত করেছেন এই স্পিনার, হুমকিতে ফেলে দিয়েছেন অনিল কুম্বলের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের রেকর্ড। উপমহাদেশের বাইরেও দারুণ কার্যকরী অফস্পিনার অশ্বিন। ৭৮ টেস্টে মাত্র ২৪ গড়ে ইতোমধ্যেই সংগ্রহ করেছেন ৪০৯ উইকেট। ব্যাটিংটাও মন্দ জানেন না, পাঁচ টেস্ট সেঞ্চুরিতে ২৬৫৬ রান জানান দেয় সুযোগ পেলে ভালো ব্যাটসম্যান হবার সকল গুণাবলীই আছে তাঁর মাঝে।

  • বোলার

স্পিনার হিসেবে অনিল কুম্বলের জায়গাটা শচীন টেন্ডুলকারের মতোই অবধারিত। এখনও পর্যন্ত ভারতের হয়ে টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী তিনি। ১৩২ টেস্টে লেগস্পিনের মায়ায় ব্যাটসম্যানদের সাজ ঘরে ফেরত পাঠিয়েছেন ৬১৯ বার। ক্রিকেট ইতিহাসের এক বিরলতম রেকর্ডের অধিকারী কুম্বলে, দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে এক ইনিংসে নেন দশ উইকেট। স্পিনার হিসেবে তাঁর দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে তাই কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

এবার পালা দুই পেস বোলার বেছে নেবার। বাঁ-হাতি পেসার হিসেবে জহির খান থাকছেন এই একাদশে। এমনিতেই ভারতের ইতিহাসে বাঁ-হাতি পেসার আসেননি, যারা এসেছেন তাদের মাঝে জহির খানই ছিলেন সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। সাদা বলের ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জেতাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেও লাল বলের ক্রিকেটেও পারফর্ম করেছেন সমানতালে। ভারতের ইতিহাসে মাত্র তিনজন পেসার তিনশো উইকেটের ল্যান্ডমার্ক স্পর্শ করতে পেরেছেন জহির তাদের একজন। জাতীয় দলের হয়ে ৯২ ম্যাচ খেলে তাঁর সংগ্রহে আছে ৩১১ উইকেট।

একাদশ ক্রিকেটার বাছাই করতে গিয়ে পড়তে হয়েছে মধুর সমস্যায়। ভারতের বাকি পেসারদের সবারই কিছুটা দুর্বলতা, সবমিলিয়ে প্রতিভা বিবেচনায় বেছে নেয়া হয়েছে ইশান্ত শর্মাকে। ছয় ফুটের উপর লম্বা আর দারুণ গতি সবমিলিয়ে আলোচনা ছড়িয়েই ভারতীয় ক্রিকেটে আর্বিভাব ইশান্তের। ক্যারিয়ারের শুরুতে তাকে খেলতে বেগ পেতে হয়েছে রিকি পন্টিংয়ের মতো ব্যাটসম্যানের। কিন্তু ইনজুরির কারণে কখনোই তাঁর পুরোটা পায়নি ভারত। তবে যখনই সুযোগ পেয়েছেন নিজের সেরাটা দিয়েছেন। বিশেষ করে ২০১৭ পরবর্তী সময়ে টেস্টে ভারতের যে আধিপত্য, সেই বোলিং লাইন আপকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...