ফ্লিনটফ ও এজবাস্টন: অনন্য বন্ধন

টিভি পর্দায় অ্যাশেজের ব্রডকাস্ট তর্ক সাপেক্ষে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের চেয়েও ঝঁকঝকে। আর মাঠের ক্রিকেট তারচেয়ে বেশি চাকচিক্য ও চমকে ভরপুর। পরিসংখ্যান ঘাঁটলে ২০০৫ অ্যাশেজের দ্বিতীয় টেস্টের নামটা সবার উপরেই স্থান করে নেবে। টেস্ট ক্রিকেটের ভক্ত হয়ে থাকলে — আপনিও নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। ভিন্ন ব্যাখ্যায় এজবাস্টনের সেই ম্যাচ — ‘ফ্লিনটফময় টেস্ট’।

টেস্ট ক্রিকেটে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের উত্তাপ, সাদা পোশাকের অন্যান্য ম্যাচের তুলনায় ঢের বেশি। টেস্ট ম্যাচের সর্বোচ্চ সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে এই দুই দলের মুখোমুখি লড়াই উপভোগ করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই।

বাইশ গজের সবুজ গালিচায় দু-দলের প্রাণপণ লড়াইয়ের আছে আদি ঐতিহ্য। আকর্ষণের মাত্রাটাও — এই কারণেই তীব্র। অ্যাশেজের বৈচিত্র‍্য পাঁচ দিনের খেলাকে বিস্বাদ হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে।

টিভি পর্দায় অ্যাশেজের ব্রডকাস্ট তর্ক সাপেক্ষে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের চেয়েও ঝঁকঝকে। আর মাঠের ক্রিকেট তারচেয়ে বেশি চাকচিক্য ও চমকে ভরপুর। পরিসংখ্যান ঘাঁটলে ২০০৫ অ্যাশেজের দ্বিতীয় টেস্টের নামটা সবার উপরেই স্থান করে নেবে। টেস্ট ক্রিকেটের ভক্ত হয়ে থাকলে — আপনিও নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। ভিন্ন ব্যাখ্যায় এজবাস্টনের সেই ম্যাচ — ‘ফ্লিনটফময় টেস্ট’।

সেদিন, ইংলিশদের ব্যাটিং ইনিংসের শুরুটা হয় অজি বোলারদের শাসনের মধ্য দিয়েই। উদ্বোধনী জুটিতে মার্কাস ট্রেসকোথিক আর স্ট্রস ১১২ রান যোগ করেন। ১৬৪ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারানোর পর বাকি ২৩ রান করতেই আরো দুই ব্যাটসম্যান অজি বোলারদের ফাঁদে পা দিলে — নিয়ন্ত্রণ অস্ট্রেলিয়ার দিকে মোড় নেয়।

পরের উইকেটে ফ্লিনটফ আর পিটারসেনের বুদ্ধিদীপ্ত জুটিতে ম্যাচের মোড় উল্টো ঘোরাতে শুরু করেন তারা। শেন ওয়ার্নকে এতোটা বেধড়ক কেউ পিটিয়েছে কিনা এর পূর্বে আমার জানা নেই।

ফ্লিনটফের ব্যাটেই ওয়ার্ন হজম করে তিন ছয়। ফ্লিনটফের ৬৮ রানের ইনিংসে পাঁচ ছয়ের তিনটিই ওয়ার্নের বলে। তবে ফ্লিনটফ সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছয়টা হাঁকায় স্কয়ার লেগে ব্রেটলিকে পুল করে। যা এখনও চোখে লেগে আছে বহু দর্শকের।

অন্যপ্রান্তে, বড় হচ্ছিল পিটারসেনের ব্যক্তিগত সংগ্রহ। ফ্লিনটফকে সঙ্গ দিতে গিয়ে কিছুটা মন্থর গতির ব্যাটিং করতে হয় তাকে। ক্যারিয়ারে ১৫ তম অর্ধশতকের পর ৬২ বলে ৬৮ রান করা ফ্লিনটফের লাগামে টান দেয় জেসন গিলেস্পি।

পিটারসেন মাঠে থাকায় ইংলিশদের সংগ্রহে বাড়াতে গিয়ে বিপদে বাড়েনি। নিজে ৭১ রানে বিদায় নিলেও বাকিদের ছোট কিছু সংগ্রহে চারশো’র কোটা পেরিয়ে স্বস্তির নি:শ্বাস নেয় ইংল্যান্ড।

ইংলিশ বোলারদের উপর দায়িত্বটা বেশি ছিল। ফ্লিনটফ বরাবরই বিপক্ষীয় ওপেনারদের জন্য ছিলো ত্রাসের নাম। তাই ফ্লিনটফে সকল হোমওয়ার্ক সেরে এসে — ফ্লিনটফে কাটা না পড়ে হোগার্ডে পরাস্ত হেইডেন। দলীয় স্কোরবোর্ড তখনও ফাঁকা। বুঝতে বাকি নেই হেইডেন কত করেছে।

পন্টিং আর ল্যাঙ্গারের অর্ধশতক যথেষ্ট হয়ে দাঁড়ায়নি অজিদের। ইংলিশরা লিড পায় ৯৯ রানের। সাইমন ক্যাটিচের উইকেট নিয়ে কোমড় ভাঙেন আর কাস্প্রোভিচ আর গিলেস্পির উইকেট আদায় করে অজিদের প্রথম ইনিংসের কফিনে শেষ পেরেকগুলো ঠিকে দেন ফ্লিনটফ।

প্রশান্ত মনে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে গিয়ে শেন ওয়ার্নের ঘূর্ণি আর ব্রেটলির গতিতে তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে ইলিংশ লাইনআপ। সাজঘরের মিছিলে যোগ দেয় একের পর এক।

আগের ম্যাচের পারফর্মার পিটারসেন ওয়ার্নকে পরপর দুই ছয় হাঁকিয়ে আবার তার ঘূর্ণিতেই কুপোকাত হয়ে ফিরে গেলেও, আরেক পারফর্মার দাঁড়িয়ে ছিলেন দাঁতে দাঁত চেপে। সাজঘরের মিছিলে যোগ না দিয়ে দায়িত্ব নিলেন ইনিংস মেরামতের।

তাতে, ফ্লিনটফকে  সফল বলার সুযোগ নেই। তবে নিজের ইনিংসে দলকে সামনে টেনেছে। তৃপ্ত করেছে গ্যালারির দর্শকদের। দলের সতীর্থদের আশার বীজ বুনতে সহযোগিতাও যে হয়েছে তা নির্দ্বিধায় বলা চলে। উইকেট পতিত হওয়ার ভীড়ে ফ্লিনটফের দুয়েকটা বড় শট ইংলিশদের নৌকার পালে হাওয়া যোগাতে থাকে।

স্ট্রেইটে ব্রেটলিকে হাঁকানো ছয়টা অনেকের কাছেই অন্যতম দৃষ্টিনন্দন ছয়। যা গিয়ে আছড়ে পড়ে মাঠের বাইরে। এ যাত্রায় ফ্লিনটফ নিজেও বোকা বনেছেন বটে। এবার আগের মতো ওয়ার্নের উপর চড়াও হতে পারেননি, তাই ওয়ার্নেই ইনিংসের শেষ দেখে মাঠ ছাড়েন।

চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করে তিনশো ছুঁই ছুঁই লক্ষ্য তাড়া করে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এমন নজির খুব একটা তখনও ছিল না, এখনও নেই। তবে অজিদের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না লম্বা ও অভিজ্ঞ ব্যাটিং লাইনআপের কারণে। তাই শুরুতেই ভিত শক্ত করতে শুরু করে দুই ওপেনার জাস্টিন ল্যাঙ্গার ও হেইডেন। লক্ষ্যমাত্রা তাদের ২৮২।

প্রথম ১২ ওভার স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাট চালানোর পর, ফ্লিনটফকেও স্বাভাবিকভাবেই সামলে নেওয়ার প্রস্তুতি সেরে নেন ল্যাঙ্গার। এর আগেই আবার হার্মিসনকে মোকাবেলা করে মাঠে জমে গেছে। এরপরও, ল্যাঙ্গারের কাছে বিপত্তি সাধে ফ্লিনটফের দ্বিতীয় বল। ল্যাঙ্গারের ব্যাট-প্যাড গলে বল গিয়ে আঘাত করে স্ট্যাম্পে।

প্রথম উইকেটের পতনে পন্টিং মাঠে এলেও ফ্লিনটফ তাকে দিশেহারা করে তোলেন। ফ্লিনটফের করা নো-বল মিলিয়ে মোট পাঁচ বল মোকাবেলা করে সবগুলোতেই পরাস্ত। দূর্দান্ত দুই ইনসুইং ঠেকাতে গিয়ে কোনোমতে বেঁচে গেলেও, ওভারের শেষ বলের নিখুঁত আউসুইংয়ে রানের খাতা না খুলেই উইকেটের পেছনে গ্লাভসে আটকা পড়েন। পাঁচ বলের ব্যবধানে দুই উইকেট নিয়ে পেছনে ঠেলে দেন অজিদের। পন্টিংয়ের ক্যারিয়ারের দুঃসময়ের সমকক্ষ ফ্লিনটফের সেই পাঁচটি বল।

টেস্ট ক্রিকেট যে চমকে ভরা তাঁর প্রমাণ দেন হার্মিসন। ফ্লিনটফের রাজত্ব করার দিনে অসাধারণ এক স্লোয়ার ইয়োর্কারে বোকা বানিয়ে ক্লার্ককে বোল্ড করে হার্মিসন। ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেলেও, ক্লার্ক বোধহয় এখনও এই বলের জবাব খুঁজে পাননি।

ইংলিশদের বোলিং তোপে কোমড় সোজা করে দাঁড়ানোই মুশকিল হয়ে যায়। ১৩৪-১৩৭ রানের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়া উইকেট হারায় তিনটা। দলের স্কোর ৭ উইকেট হারিয়ে ১৩৭ রান। ইংলিশদের টপ পারফর্মার ফ্লিনটফ হলে অজিদের বেলায় শেন ওয়ার্ন। ব্যাট হাতেও সেদিন নড়েচড়ে বসে ওয়ার্ন।

অন্যরা বোকা বনে গেলেও ইংলিশ বোলারদের ঘাম ছুটিয়ে ছাড়েন ওয়ার্ন। তার লড়াকু ব্যাটিংয়ে জয়ের ক্ষুধার প্রতিফলন ছিলো স্পষ্ট। কিন্তু, ফ্লিনটফের বলে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারেন হিট আউটে হয়ে।

জয় থেকে ১৫ রান দূরে থাকতে ফ্লিনটফের বাউন্সার আপার কাট করে থার্ড ম্যানে পাঠান কাস্প্রোভিচ। সেই সহজ ক্যাচ ফেলে দিয়ে পরিস্থিতি বিগড়ে দেন জন্স। ক্যাচ ফসকে গিয়ে একেবারে ম্যাচ ফসকে যাওয়ার উপক্রম তৈরি হয়।

বুকের ভেতর থেকে কলিজাটা প্রায় আলাদা হয়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার সাজঘরের। বাকি রানগুলোয় সিঙেল ও ইংলিশ বোলারদের উপহার করা বাই চারে ম্যাচ কাছে আসতে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার।

ম্যাচ জিততে মরিয়া ইংলিশ কাপ্তান মাইকেল ভন দু’প্রান্তে আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং সাজিয়ে একটানা চালিয়ে গিয়েছেন হার্মিসন ও ফ্লিনটফকে। শরীরে আঘাত সহ্য করেও মাটি কামড়ে পড়েছিলেন কাস্প্রোভিচ ও ব্রেটলি। ম্যাচ জিততে প্রাণপণ যুদ্ধ চালায় দু’জন।

জয় থেকে মাত্র তিন রান দূরে থাকতেই হার্মিসনের বাউন্সারের সঠিক জবাব দিতে না পেরে গ্লাভসে স্পর্শ করে ফেলে বল। ঝাঁপিয়ে পড়ে সে ক্যাচ লুফে নেয় উইকেটকিপার গো জন্স।

একনাগাড়ে আক্রমণাত্মক বোলিং করে অজিদের দিশেহারা বানিয়ে নার্ভ গেইমে জয়লাভ করে শেষ হাসিটা ইংলিশরা হাসলেও, অস্ট্রেলিয়ার লড়াকু মনোভাব ম্যাচে পূর্ণতা দিয়েছে অনেকাংশে।

সেশনে-সেশনে রূপ বদলায় বলেই রোমাঞ্চে ঠাসা টেস্ট ক্রিকেটকে মানদণ্ডে স্থান দেওয়া হয় উচ্চস্থানে। ম্যাচসেরা ফ্লিনটফের এই পারফরম্যান্সকে অনন্য উচ্চতায় মাপা হয়। একইভাবে এই টেস্টকে আখ্যায়িত করা হয় — ‘সর্বকালের সেরা টেস্ট হিসেবে।’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...