বৃদ্ধ সিংহের সামনে উদ্যত ফণা

৩৬ বছরের একটি সুগঠিত শরীর, ধীর পদক্ষেপে, মুচকি হাসি নিয়ে, হেঁটে আসছেন। মাথায় আলগোছে টুপি পরা। হেলমেট নেই, ভিভ পরেন না। প্রায় এক দশক হতে চলল, সারা পৃথিবীতে হেলমেট পরার চল শুরু হয়েছে। কিন্তু ভিভ অবিচল।

১৯৮৮ সালে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ অস্ট্রেলিয়াতে খেলতে এসেছে, বেন্সন অ্যান্ড হেজেস কাপ। পার্থ শহরের ক্রিকেট স্টেডিয়ামে, একটি ষোলো বছরের কিশোর নেটে বল করছে। পেস বোলিং। বিপক্ষে তাবড় তাবড় ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটাররা – তাঁদেরকে প্র্যাক্টিস দিতে বাচ্চা বোলারদের ডেকে আনা হয়েছে। অপসৃয়মান ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান আধিপত্যের শেষ যুগ, গতবছর বিশ্বকাপে তো গ্রুপ লিগের বাধাই টপকাতে পারে নি। অবশ্য ১৯৮৭ সালে, প্রথমবার, স্পিনসহায়ক উপমহাদেশের পিচে, বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঐতিহাসিকভাবে ফাস্ট পিচে বেশি সফল, ফলে মুখ থুবড়ে পরার একটা কারণ সেটাও হতে পারে। সে যাই হোক, ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমে এখনো সম্ভ্রম জাগানো কিছু ব্যাটার আছেন। ভিভ রিচার্ডস, ল্যারি গোমস, গাস লোগি, ডেসমন্ড হেইন্স, জেফ দুঁজো, গর্ডন গ্রিনিজ, রিচি রিচার্ডসন। এতগুলো নামের মাঝে, কিশোরের পাখির চোখ অবশ্য একটি বিশেষ নামের ওপরেই নিবদ্ধ, কালো পাথরে কোঁদা মূর্তির ভিভ রিচার্ডস। বাকিরা ভালো, কিন্তু ভিভ সম্রাট।

কিশোর নিজে তাই মনে করে। তার শোয়ার ঘরে তিনটে ছবি লাগানো রয়েছে। ভিভ, লিলি, মার্শাল। ক্যারিয়ারের একদম শুরুর দিকে সে ব্যাটিং করার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু কোচেরা সবাই মিলে বলে দিয়েছেন, ব্যাটিং করছো করো। কিন্তু বোলিং তোমার আসল অস্ত্র। এই গতিতে বল সবাই করতে পারে না। চেষ্টা করে দ্যাখো, যদি কিছু হয়। ছোকরার নাম স্পেনসার, ডানকান স্পেনসার।

স্পেনসার সকাল থেকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে নেটের পাশে ঘুরঘুর করলো। বেশ কয়েক ওভার বল’ও করে ফেললো। অতিরিক্ত উদ্যমে, দুরন্ত গতিতে, বল করতে গিয়ে, বেশ হাঁপিয়ে পড়েছে সে। বয়েস কম, এখনো সে বুঝছে না, কিন্তু শরীর প্রতিটি হিসেব মেপে নিচ্ছে। কিন্তু সে বল করছে চঞ্চল মন নিয়ে – একটাই প্রশ্ন, ভিভ কই? এতো কাছে এসেও, ভিভকে বল করতে পারবো না?

ভিতরের সমস্ত অবদমিত কষ্ট জমিয়ে রেখে, সে বলের চকচকে দিকটা ট্রাউজারে ঘসতে ঘসতে, ফের বোলিং রানআপে গিয়ে দাঁড়ালো। হঠাৎ কী মনে হলো, পেরিফেরাল ভিশনে, বাম দিকে চোখ পড়তেই, তার হাত মন্ত্রমুগ্ধের মতো থেমে গেলো। বল যেমনকার তেমন হাতেই রয়ে গালো। যেনো সাপের চোখে পাঁচ ব্যাটারির টর্চের আলো পরেছে। ঐ তো সম্রাট মঞ্চে প্রবেশ করেছেন।

৩৬ বছরের একটি সুগঠিত শরীর, ধীর পদক্ষেপে, মুচকি হাসি নিয়ে, হেঁটে আসছেন। মাথায় আলগোছে টুপি পরা। হেলমেট নেই, ভিভ পরেন না। প্রায় এক দশক হতে চলল, সারা পৃথিবীতে হেলমেট পরার চল শুরু হয়েছে। কিন্তু ভিভ অবিচল। ইন্টারভিউতে ঘোষণা করে দিয়েছেন, গায়ে ঐ লাল বলের মার খেয়ে চাকা চাকা দাগ পরে না গেলে তার ব্যাটিং খোলে না। বোলার তাঁকে মারবে তবেই না ভিভের প্রচণ্ড রাগ হবে যে যাই, অ্যাতো সাহস, আমার গায়ে বল ছোঁড়ে, তবে রে ব্যাটা। যাই, এই ব্যাটাকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিই। হেলমেট পরে নামলে তো সেই ভয়টাই থাকে না। ভিভ প্রাঞ্জল করে এই যুক্তি, টিভি ক্যামেরার সামনেই, বলে দিয়েছেন।

বোলার চেঞ্জ প্লিজ। হঠাৎ ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কোচের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো স্পেনসার। ক্লান্ত বোলার নয়, কোচ ভিভকে তাজা বোলার দিতে চাইছেন। সঙ্গত কারণেই। ঘামে ভেজা স্পেনসার, তাও এগিয়ে গিয়ে, কোচের কাছে, খানিক গাঁইগুঁই করলো, প্রায় ঝুলোঝুলিই করলো বলা চলে। সারা সকাল এই মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলো সে। কিন্তু ভবি ভোলার নয়। এরকম ভিভের হাজার হাজার ফ্যান প্রতিটি উপমহাদেশে ছড়িয়ে আছে। তাদের সবাইকে খুশী করা সম্ভব নয়। আর সেটা কোচের কাজ’ও নয়। কোচ ভালোই জানেন, বল করার সুযোগ না পেলেও, ভিভের একটি অমূল্য অটোগ্রাফ, এই কিশোরের মান-অভিমান সব মুছে দেবে। অতএব সই সংগ্রহ করেই সেবারের মত ভিভ দর্শন শেষ করতে হলো স্পেনসারকে।

পাঁচ বছর জাম্প কাট। ক্রিকেটের দুনিয়ার পাঁচ বছর অনেক সময়। এখন ১৯৯৩। না, ভিভ রিচার্ডস ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ খেলতে পারেন নি। খেলতে চেয়েছিলেন। অস্তগামী ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের ভার যে নবীন হাতে ভিভ নিজে হাতে, অতি নির্ভরতার সাথে ন্যস্ত করেছিলেন, সেই রিচি রিচার্ডসন উদ্যোগ নিয়ে ভিভ’কে বাদ দিয়েছেন। এবং স্ট্যাটবুক বলছে সঙ্গত কারণেই বাদ পরেছেন ভিভ। ১৯৯২ বিশ্বকাপের আগের তিন বছরে তাঁর গড় ৩৩, ২০ এবং ৩১।

এমনকি যে স্ট্রাইক রেট তাঁকে সমসাময়িক সকলের থেকে আলাদা করে রাখতো, সেটিও নিভে এসেছে। সত্তর আর আশির দশকে, বাকি ব্যাটারদের স্ট্রাইক রেট ৬০ এর ঘরে থাকতো, সেই একই সময়ে ভিভের বরাবর ৯০ এর ঘরে। কিন্তু শেষ দু বছরে স্ট্রাইক রেট মাত্র ৬৬ আর ৭৯। বাকী পৃথিবীর সমস্ত ব্যাটারদের জন্য এটা যথেষ্ট হলেও, ভিভের নিজের স্ট্যাটের সাথে তুলনায় এই স্ট্রাইক রেট নগণ্য। সিংহ বৃদ্ধ হয়েছেন। ক্ষিপ্রতা বয়েসের সাথে কমছে। কিন্তু!

কিন্তু এভাবে রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে চলে যাওয়া তাঁকে মানায় না। একটা শেষ রণহুঙ্কার দিয়ে, শেষ হাসি হেসে তিনি হেলমেট, থুরি তাঁর টুপিটা খুলে রাখতে চান। দেখিয়ে দিতে চান যে একেবারে ফুরিয়ে যান নি।

বিশকাপ থেকে বাদ পরে, ভগ্নমনোরথ ভিভ, ক্যারিয়ারের শেষ প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটের মঞ্চ হিসেবে বেছে নিলেন কাউন্টি ক্রিকেট – বিখ্যাত সানডে লিগ। ১৯৯৩ সালে, কাউন্টি ক্রিকেট পালটাচ্ছে। দ্রুত। এই প্রথমবার আঠেরোটা কাউন্টির সবাই রঙিন জামা পরে খেলবে, ধবধবে সাদা জমানার অবসান। জজমাট লড়াই হবে। অনেককিছুই প্রথমবারের মতো চালু করা হচ্ছে। যেমন, কালো সাইটস্ক্রীন পেছনে রেখে, সাদা বল নিয়ে ছুটে আসবেন বোলাররা। অ্যালান স্মিথ, টেস্ট ও কাউন্টি ক্রিকেটের চীফ এক্সিকিউটিভ, খুবই উত্তেজিত।

খুব স্বাভাবিক। এরকম একটা প্ল্যান যদি দর্শকের মনে ধরে যায়, তাহলে আবার সেই সোনালী দিন ফেরত আসবে। রবিবারগুলোয় সানডে লীগের খেলায়, মাঠ উপচে পড়বে। প্লাস টিভিতে লাইভ দেখানো হচ্ছে, সেটাও প্রথমবার। সব মিলিয়ে মার্কেটিং আর কমার্সিয়াল সাফল্যের তুমুল হাতছানি। আশু কাঞ্চনস্রোতের বেপরোয়া ঝনঝনানি অ্যালানের কানে বেজেই চলেছে। টেরী ব্লেক, মার্কেটিং ম্যানেজার এরমধ্যেই আঠেরো রকম রঙিন জার্সির ডিজাইন নিয়ে জাস্ট হাবুডুবু খাচ্ছেন। ক্লোদিং কোম্পানি, স্পন্সরেরা – সবাই চরম উত্তেজিত।

একমাত্র শান্ত মানুষ ভিভ। গ্ল্যামারগন শিবিরে যোগ দিয়েছেন চল্লিশোর্ধ বৃদ্ধটি। আঠেরোটি কাউন্টি খেলবে এই সানডে লিগে। গ্ল্যামারগন সেগুলির মধ্যে একটি। গত ২৪ বছরে চলা টুর্নামেন্টে গ্ল্যামারগন কখনো জেতে নি। বুকীদের মতে এবারো জেতার বিশেষ আশা নেই। গ্ল্যামারগনের জেতার পক্ষে দর যাচ্ছে ৫০০ঃ১, মানে আপনি ১ টাকা লাগালে এবং গ্ল্যামারগন জিতলে, আপনি ৫০০ টাকা ফেরত পাবেন। অংকের ভাষায় বললে গ্ল্যামারগনের জেতার সম্ভাবনা = ১/৫০০ = ০.০০২। নি:সন্দেহে, দুর্দান্ত টিম বেছে নিয়েছেন ভিভ!

ওদিকে কেন্টের শিবিরে রয়েছেন স্পেনসার – এখন তিনি কুড়ি বছরের এর চনমনে সদ্য যুবক। টিমে অনিয়মিত। কিন্তু হাতে মারাত্মক লুকোনো গতি। চেহারা দেখে বোঝা যায় না। সব বলই প্রায় ১০০ মাইল/ঘন্টা গতিতে মুখের কাছে লাফিয়ে ওঠে।

সানডে লিগ বড় টুর্নামেন্ট। ক্রিকেট দেবতা সব ছকে রাখেন – সাধে কী আর বলা হয় ক্রিকেট খেলাটি আসলে গ্রেট লেভেলার। গ্রুপের একটি বাদে, সব খেলা হয়ে যাবার পরে দেখা গ্যালো – দুটি কাউন্টি সমসংখ্যক পয়েন্ট নিয়ে যুগ্মশীর্ষে। কেন্ট এবং গ্ল্যামারগন। আর তাদের মধ্যেই কীনা শেষ ম্যাচ।

স্পেনসার উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছেন। এ কী শুনলেন তিনি? স্পেনসার নিজে নগ্ন। পাশে ভিভ। ভিভ নিজেও নগ্ন। তখনকার দিনে ওপেন শাওয়ার ব্যবহার করতে হতো দুটিমের সদস্যকেই। স্পেন্সার কিছুক্ষণ আগেই স্নান করতে ঢুকেছেন। ভিভ এই ঢুকলেন। স্পেনসারকে দেখেই সহাস্যে বললেন, আরে ডানকান যে? আগের সপ্তায় ন’থ্যান্টসের সাথে ব্যাটিং করছিলে দেখলাম। বেশ চমৎকার। চালিয়ে যাও, গুড লাক।

১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৩। ফাইনাল ম্যাচ শুরু হলো। মাঠ উপচে পড়েছে। বারো হাজার লোক। মাত্র বারো? ওটাই অনেক ওদেশের কাউন্টিতে। দর্শক আঁটছিলো না বলে বাউন্ডারির দড়ি ছোট করে ৩০ ফুট ছোট করে দিতে হলো যাতে আরো কিছু দর্শক মাঠে বসেই খেলা দেখতে পারে। কাউন্টির কর্তারা খুব খুশী। ছোট মাঠে কেন্ট প্রথমে ব্যাট করে ৫০ ওভারে ২০০ রান করলো। ১৯৯৩ সালে ২০০ মানে ধরে নিন সেটা আজকের যুগের ৩০০ রানের সমান। কেন্টের হয়ে কার্ল হুপার সর্বোচ্চ ৬০ রান করলেন। দ্বিতীয় ইনিগসে, বেশ চাপের মধ্যে ব্যাট করতে নামলো গ্ল্যামারগন – লক্ষ্য ২০১।

প্রথমদিকে বেশ ভালোই এগোচ্ছিলো গ্ল্যামারগন। ২৪ ওভারের শেষে ৮১ রানে ১ উইকেট। উইকেট বাঁচিয়ে খেলাই তখনকার দিনের রীতি। এখনকার মতো, ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন জাতীয় কোনো সুবিধে নেই। গ্ল্যামারগনকে ২৬ ওভারে ১২০ রান করতে হবে – ১৯৯৩ সালের হিসেবে বেশ কঠিন আস্কিং রেট। কিন্তু হাতে ন উইকেট আছে। অতএব, অ্যাডভান্টেজ গ্ল্যামারগন। কেন্টের অধিনায়ক (এবং উইকেটকীপার) মার্শ মাথা চুলকাচ্ছিলেন, নতুন কী করা যায়। ম্যাচে ফিরতে গেলে যেভাবেই হোক উইকেট ফেলতে হবে। হঠাৎ করে মাথায় এলো স্পেনসারকে বল দিয়ে দেখি। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। স্পেনসার আক্রমণে এলেন।

এসেই প্রথম বলটাই প্রচন্ড জোরে মাথা লক্ষ্য করে… না বীমার নয়, বাউন্সার। ব্যাটার ডেল সরে যাচ্ছিলেন কিন্তু শেষ মুহূর্তে খেয়াল করলেন যে বল তাঁকে ফলো করছে। অতএব, তিনি স্থানুবৎ দাঁড়িয়েই মাথা নিচু করে ফেললেন। বল তাঁর মাথার ঠিক ওপর দিয়ে, কানের পেছনের চুল উড়িয়ে দিয়ে, উইকেটকীপারের দস্তানায় গিয়ে জমা হলো। লাইভ টিভিতে বিবিসির ধারাভাষ্যকর বললেন, “Dale ducked almost posthumously.” বাকী ওভারটিও প্রায় এরকম’ই চললো।

একটা ওয়াইড ইউররকার যেটা ডেল পেসে বিট খেলেন। আরেকটা নিঁখিত ইউর্কার, যেটা ডেল কোনোরকমে ব্যাট নামিয়ে ঠেকালেন। মাঝে শুধু একটা ফুল লেংথ ডেলিভারি লাফিয়ে কীপারের মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। কীপার আরো দশ গজ পিছিয়ে দাঁড়ালেন। শেষ বলটা, বাতাসে শিস কেটে এসে ডেলের পাঁজর ভেঙে দিলো। নন-স্ট্রাইকার মরিস শুশ্রুষা করতে এগিয়ে এলেন। পাঁজরের শুশ্রুষা না হয় করা যায়, কিন্তু মনের?

কেন্টের সমর্থকেরা অবশেষে আশা ফিরে পেয়েছেন। ছেলেটার পেস আছে। ভয় পাইয়ে দিয়েছে। একটা ওভারেই খেলার গতি পাল্টে দিয়েছে। ব্যাটার-কীপার দুজনেই পিছিয়ে দাঁড়িয়েছে। কার্যক্ষেত্রে দেখা গ্যালো, অত্যধিক পেস হজম করতে পারেন নি ডেল। একপ্রকার বাধ্য হয়ে, অন্যপ্রান্তের বোলারকে চালাতে গিয়ে নিজের উইকেট খোয়ালেন।

এদিকে আস্কিং রেট ওভারপিছু পাঁচ। ১৯৯৩ সালে সেটা পাহাড়প্রমাণ। ডেলের বদলে নামলেন নতুন ব্যাটার ম্যানরাড। সকালেও যে বোলারের ম্যাচ খেলার কথা ছিলো না, সেই স্পেনসার স্রেফ অমানুষিক পেসে বিট করে দিলো ম্যানরাডকে। প্লাম্ব এল বি। ম্যানরাড পরে বলেছেন, আরে দূর, অত জোরে বল খেলা যায় নাকী? অরকম বল ১০ বার আমায় করলে ১০বারই আমি আউট হবো।

টিমের সবাই ছুটে এসেছে একুশের তরুণকে অভিনন্দন জানাতে। ঝপাঝপ দু উইকেট পরে গিয়ে, ম্যাচ কেন্টের দিকে ঝুঁকে পরেছে। স্পেন্সার’ও হাসছে। তবে স্পেন্সারের হাসির কারণ আলাদা। ম্যানরাড আউট হয়েছেন, তার থেকেও বড় কথা, ঘন নীল রঙের জার্সি আর টুপি চাপিয়ে ক্রিজে আসছেন বৃদ্ধ সিংহ। বোলার কুড়ি, ব্যাটার একচল্লিশ – একুশ বছরের তফাত। নেটে যাঁকে বল করার সুযোগ কপালে জোটে নি, সানডে লিগের এই ডিসাইডার ম্যাচে, স্পেনসার প্রথমবারের মতো বল করবে, তাঁর আজন্মলালিত হিরোকে।

এই পরিস্থিতিতে অনেকেই নার্ভাস হয়ে যায়। ভিক্টর ট্রাম্পারকে আউট করে গুণমুগ্ধ ভক্ত আর্থার মেইলি ভেঙে পরেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিলো তিনি সেই কিশোরের মতো অপরাধী যে টিপ অভ্যাস করতে গিয়ে, গুলতি ছুঁড়ে, অপাপবিদ্ধ পায়রার প্রাণহানি করেছে। স্পেনসারের মধ্যে অবশ্য বিন্দুমাত্র সম্ভ্রমের লক্ষ্মণ দেখা গ্যালো না। তাঁর প্রথম বলটাই প্রচন্ড গতিতে ভিভের পাঁজরে আছড়ে পরলো। তার পরের বলটা ভিভের গ্লাভসে। কোনোরকমে বলটাকে ঠেকিয়ে মাটিতে নামালেন সম্রাট।

তার পরের বল আবার শর্ট। রাজকীয় রক্ত আর মেনে নিতে পারলো না। ক্যারাবিয়ান মুলুকে, অসভ্য সাদা মালিকেরা, শত শত বছর ধরে যেভাবে অবলীলায় ক্রীতদাসেদের ওপরে নির্দয় চাবুক চালাতো, ভিভ ঠিক সেইভাবে, বাম পা অফের বাইরে নিয়ে গিয়ে, সপাটে ব্যাট চালালেন। কিন্তু হায়! ধার কমে যাওয়া রিফ্লেক্সে ১০০ মাইলের বল গায়ে উঠে এসেছিলো, খেলতে দেরী হয়ে গেলো, ব্যাটে লেগে সোজা লোপ্পা ক্যাচ উঠে গ্যালো। স্পেনসার সোজা দৌড়লেন, চোখ আকাশে, বলের দিকে নিবদ্ধ। নিজে হাতেই বন্দী করবেন ভিভের প্রাণভোমরা।

অন্যদিক থেকে আরেকজন ফিল্ডার আসছেন, একদম খেয়াল করেন নি। দুজনের ধাক্কা লাগলেও, স্পেন্সার ক্যাচ ধরে নিলেন। এ ক্যাচ ধরার জন্য তিনি ছোট্টবেলা থেকে নিরন্তর অভ্যাস করেছেন। এ ভিভের ব্যাটের স্পর্শ পাওয়া ক্যাচ। এবার? উল্লাস না বিষাদ? স্পেনসার কী করবেন? সমাধান করে দিলেন আম্পায়ার ডেভিড কন্সট্যান্ট। অনেক পরে, প্রায় লোপ্পা ক্যাচ ওঠার পরে, উনি নো বল ডেকেছেন। স্পেন্সার শূন্য চোখে ফিরে এসে বোলিং মার্ক দেখলেন। নাহ, যেখানে পায়ের দাগ পরার কথা সেখানেই আছে। আর বলটাও তো কাঁধের ওপরে ওঠে নি। কেনো নো বল ডাকা হয়েছে সেটা আম্পায়ারকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থমকে গেলেন স্পেন্সার। নাহ, আর কী হবে জেনে। নাই বা জানলেন।

কেন্টের অনেক সমর্থক আজো বলেন, ওটা সিম্প্যাথি নো বল। ভিভের শেষ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে প্রথম ওভারে আউট হয়ে গেলে দর্শকদের খারাপ লাগতো। আম্পায়ার ডেভিড অবশ্য পরে বলেছেন, আরে নাহ। ফ্রন্ট ফুট বাইরে ছিলো তাই নো বল। কিন্তু দেরিতে ডাকলেন যে? নাহ, আমি ওরকম টেম্পোতেই নো বল ডাকি।

ভিভ ওদিকে ভদ্র সভ্য ভাবে, ব্যাট গুছিয়ে হাঁটা দিয়েছিলেন সাজ ঘরের দিকে। তাঁকে ডেকে টেকে ফেরানো হলো। ভিভ তারপরের বলেও ব্যাট লাগাতে পারলেন না, পেসে বিট হলেন। প্যাডে লেগে লেগবাই হলো। ক্রিজের এপাশে এসে, ভিভ সস্নেহে হাত দিয়ে স্পেন্সারের চুল ঘেঁটে দিলেন।

তারপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। বৃদ্ধ সিংহ ঠিক করলেন, ফিরে পাওয়া জীবন তিনি কাজে লাগাবেন। জাস্ট প্যাঁদাতে শুরু করলেন। বিবিসি বলেছে এই ম্যাচে ভিভ স্কিল দিয়ে খেলেন নি, উইল দিয়ে খেলেছেন। স্রেফ ইচ্ছা শক্তির জোরে ২৪ ওভারে ৮১, থেকে ৪৭ ওভারে ২০১ করে ফেললেন ভিভ। স্পেন্সার দ্বিতীয় স্পেল করতে এসে বুঝতে পারলেন – তাঁর আর কিছু দেবার নেই।

চরম অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ প্রথম ছয় ওভারের স্পেলে তার ভেতর হেকে সমস্ত শক্তি শুষে টেনে নিয়েছে। ম্যাচ শেষ হলো। স্পেনসারের ম্যাচ ফিগার দাঁড়ালো ৮.৪-১-৪৩-১ – প্রথম দু ওভারে যে বোলার বিপক্ষের শিরদাঁড়ায় বরফ শীতল আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিলো, শেষ ৬ ওভারে সে যথেচ্ছ পিটুনি খেয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে মিড অফের ওপর দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া, সম্রাটের একটি রাজসিক শট।

ম্যাচ শেষে স্পেন্সার গুটিগুটি পায়ে হাজির ভিভকে অভিনন্দন জানাতে। ভিভ, স্পেনসারকে দেখে বেজায় খুশি। বস্তুত, এই ম্যাচ আর লিগ জিতে ভিভ একটু বেশিই খুশি। শেষ ঝলক দেখানো গেছে। ফিটিং রিটায়ারমেন্ট হয়েছে। একথা সেকথার মাজহে, হঠাৎ বলে বসলেন, এই যে ছোকরা, তোমার ঐ ওভারটা আমার জীবনে খেলা দ্রুততম বোলিং।

স্পেনসার ভেবেছিলেন, ভিভ হয়তো দয়াপরবশ হয়ে বলছেন। কিন্তু এর কয়েক বছর পরে একই কথা বলে বসলেন আরেকজন ব্যাটার – নাম রিকি পন্টিং।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...