ট্রু জেন্টেলমেন অব ক্রিকেট
তাদের অনেক মিল। একসাথে জাতীয় দলে লড়েছেন। একসাথে বাংলাদেশের বড় হয়ে ওঠার সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন। একসাথে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন এবং আজ অত্যন্ত কাকতালীয়ভাবে একসাথেই খেলাটিকে বিদায় বলে দিলেন।
ছোটবেলায় আমরা একটা কথা খুব শুনতাম-ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা।
কেউ কোনো আনফেয়ার কাজ করলে লোকেরা চোখ পাকিয়ে বলতো, ইটস নট ক্রিকেট। মানে, অভদ্র কোনো কাজই ক্রিকেট নয়; এতোটাই ভদ্রতার প্রতিমূর্তি মনে করা হতো খেলাটিকে।
কিন্তু কালক্রমে বোঝা গেলো, আদিকাল থেকেই এই খেলাটিতে যথেষ্ট অভদ্রতা ছিলো, আছে এবং থাকবে। এখানে বডি লাইন সিরিজ হয়েছে, ফিক্সিং কেলেঙ্কারি হয়েছে, আন্ডার আর্ম বোলিং কান্ড হয়েছে; আরও অনেক কিছু হবে। তারপরও খেলাটিতে দু চার জন নিরেট ভদ্রলোক টিকে থাকেন। তারাই ওই ফেযার গেমের ঝান্ডাটা বহন করে চলেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের সেই সত্যিকারের দুই ভদ্রতার বাহক ছিলেন শাহরিয়ার নাফিস ও আব্দুর রাজ্জাক। তাদের অনেক মিল। একসাথে জাতীয় দলে লড়েছেন। একসাথে বাংলাদেশের বড় হয়ে ওঠার সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন। একসাথে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন এবং আজ অত্যন্ত কাকতালীয়ভাবে একসাথেই খেলাটিকে বিদায় বলে দিলেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে অবশ্য রাজ্জাক ও নাফিসকে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে স্মরণে রাখা হবে।
রাজ্জাক বাংলাদেশের ক্রিকেটে জীবনের বড় একটা সময় বঞ্চিত হওয়ার পরও যা করতে পেরেছেন, তাতে একজন কিংবদন্তী বলে বিবেচিত হবেন।
মজাটা হলো, রাজ্জাক মূলত ছিলেন লংগার ভার্শনের উপযুক্ত স্পিনার। তার বলে ছিলো বিরাট টার্ন, অনেক বৈচিত্র। কিন্তু রাজ্জাকের যখন ওয়ানডে অভিষেক হলো, তারপরও দলের চাহিদায় তিনি খুব দ্রুত নিজেকে বদলে ফেলে খুবই সীমিত ওভার উপযোগী করে ফেললেন। তাতে একটা উপকার তো হলো। রাজ্জাক রাতারাতি বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় অস্ত্রে পরিণত হলেন।
ওয়ানডেতে পরিসংখ্যান তার হয়ে কথা বলে।
বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বোলার হিসেবে ওয়ানডেতে দুই শ উইকেট শিকার করেন রাজ। ওয়ানডেতে ৪ বার ৫ উইকেট নিয়েছেন। ওয়ানডে ইতিহাসেই কোনো বাঁহাতি স্পিনারের জন্য এটা সর্বোচ্চ। ওয়ানডেতে শত উইকেট ও দুই শ উইকেট বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে কম ম্যাচে শিকার করেছেন। ওয়ানডে ইতিহাসের দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবে হ্যাটট্রিক করেছেন।
সমস্যাটা হলো ওয়ানডেতে তার এই প্রবল সাফল্য বোলার হিসেবে রাজ্জাককে ফরম্যাটের মতো লিমিটেড করে ফেলেছিলো। তিনি তার মূল শক্তির জায়গাটা নিয়ে চর্চা কমিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে টেস্টে সাফল্য পাচ্ছিলেন না। ১৩ টেস্টে মাত্র ২৮টি উইকেট।
এখানে একটা ঘটনা পরিসংখ্যান একেবারেই বুঝতে পারলো না। রাজ্জাক জাতীয় দল থেকে ছিটকে পড়ার পর নিজের সেরা সময়টা ফিরে পেলেন। বোলিং বৈচিত্রে হয়ে উঠলেন অতুলনীয় এক সম্পদ। দেশের প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে ঝুলি ভরে ভরে উইকেট সংগ্রহ শুরু করলেন। এই সময়ের রাজ্জাক হতে পারতেন দেশের সব ফরম্যাটের জন্য সেরা বোলার। কিন্তু বিচিত্র এক কারণে শেষ ৭-৮ বছরে জাতীয় দলে ব্রাত্য হয়ে রইলেন। ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটা টেস্টে হঠাৎ করে ডাকা হলেই ৪ উইকেটও তুলে নিয়েছিলেন। গল্পটা ওখানেই শেষ।
না, গল্পের যে চ্যাপ্টারটা আমরা টিভিতে দেখি, সেটার শেষ বলতে পারেন। ভেতরে ভেতরে একটা মহাকাব্য লিখে গেছেন রাজ্জাক। দেশের প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে প্রথম বাংলাদেশী বোলার হিসেবে ৫০০ উইকেট শিকার করেছেন। এরপর সেই মাইলফলককে ৬০০ পার করে ৬৩৪ পর্যন্ত নিয়ে গেছেন।
৪১ বার প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে ৫ উইকেট শিকার করেছেন। বলাই বাহুল্য, এটা বাংলাদেশের রেকর্ড। ১১ বার রেকর্ড ১০ উইকেট নিয়েছেন ম্যাচে। ৮৪ রানে ৯ উইকেট; তার ও বাংলাদেশী কোনো বোলারের সেরা প্রথম শ্রেনীর বোলিং।
এইসব পরিসংখ্যানই আপনাকে বলে দেবে যে, ২০১৪ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত কী অসাধারণ এক সম্পদকে কেবল ইগোর কারণে জাতীয় দলের বাইরে রাখা হয়েছিলো।
আর এখানেই শাহরিয়ার নাফিসের সাথে রাজ্জাকের প্রবল মিল।
নাফিসকে ঠিক আর্ন্তজাতিক পরিসংখ্যান দেখে বাংলাদেশের কিংবদন্তী বলা যাবে না। তবে সেটা হয়ে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিলেন তিনি। রাজ্জাকের এক বছর পর, ২০০৫ সালে অভিষেক হয় নাফিসের। আর পরের বছর প্রথম ও একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে এক হাজারের ওপর ওয়ানডে রান করে ফেলেন। সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করে রানের বন্যা বইয়ে দিতে থাকেন।
অনেকের স্মৃতি প্রতারণা করে বলে মনে হয়, তার রানবন্যা কেবল জিম্বাবুয়ের মতো ছোটদলের বিপক্ষে। শেন ওয়ার্ন, ম্যাকগিল, ব্রেট লি, গিলেস্পিদের তুলোধুনো করে ১৩৮ ও ৭৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। এরপর খুব সামান্য কারণেই দল থেকে বাদ পড়েন এবং তাকে নিয়মিত করার কোনো চেষ্টা দলের ছিলো না। দূরন্ত সব ইনিংস খেলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও।
আইসিএলে গিয়ে ক্যারিয়ারের অনেকটাই ক্ষতি করে ফেলেন। তারপর নিষেধাজ্ঞামুক্ত হওয়ার পরও নিজেকে ফিরে পাচ্ছিলেন না ঠিক। ২০১১ সালের দিকে একবার জাতীয় দলে ফিরেছিলেন। সে সময় তিনি নিজের ছায়া ছিলেন।
আর এরপরই নাফিস নিজের সেরা সময়ে পৌছান। ঘরোয়া ক্রিকেটে একের পর এক সফল মৌসুম কাটাতে থাকেন। রানের স্রোত ছিলো তখন তার ব্যাটে। কিন্তু এই সময়টায় আবার তার দিকে ফিরেও তাকায়নি ম্যানেজমেন্ট।
অবশেষে এই দুই আফসোসে মোড়ানো ক্যারিয়ার নীরবেই শেষ হলো।
অবশ্য এটা গত কয়েক মাস ধরেই বোঝা যাচ্ছিলো। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন দুটো পদে নিয়োগ দিয়েছে রাজ্জাক ও নাফিসকে। রাজ্জাক জাতীয় দলের নির্বাচক হয়েছেন। আর নাফিস ক্রিকেট অপারেশন্সে দায়িত্ব পেয়েছেন। আর এই কাজে যোগ দিতে হলে খেলা ছাড়তেই হতো। বিসিবির আয়োজনে বেশ ঘটনা করেই সেই কাজটা করেছেন তারা।
সারাটা ক্যারিয়ার জুড়ে ক্রিকেটের জন্যই কিছু করতে চেয়েছেন। এখন সময় হয়েছে একটু ভিন্ন ভূমিকায় ক্রিকেটের জন্য কিছু করার। ব্যাটে-বলে যা পূরণ করতে পারেননি, এখন রাজ্জাক-নাফিসের সামনে মাঠের বাইরে সেই স্বপ্ন পূরণের সুযোগ।
দু জন ভদ্রলোক নিশ্চয়ই বঞ্চিত করবেন না আমাদের।