দ্য সেলফমেইড গলফ স্টার

চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সেই মুহূর্তটা এখনও চোখে ভাসে। বলটাকে আলতো করে ঠেলে হোলে পুরে দ্বিতীয়বারের মতো পেশাদার টুর্নামেন্ট জেতা সিদ্দিকুর ছিলেন অনেকটাই নির্লিপ্ত। শুধু দুই হাত উঁচিয়ে তোলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তাঁর উদযাপন। মূলত হিরো ইন্ডিয়ান ওপেন গলফ জেতার মাধ্যমেই পুরো দেশে একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে বেশি পরিচিতি লাভ করেন সিদ্দিকুর। তখন গ্রামীণফোনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হওয়ায় দেশের আনাচে-কানাচে বিভিন্ন জায়গায় বিলবোর্ডগুলাতে শোভা পায় তাঁর ছবি।

আমার জীবনে বেসিক তো দূরে থাক, আগামাথা কিছু না বুঝেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন দূরদর্শনে টানা যে খেলাটি দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার নাম গলফ। আর এই যে গলফের মাথামুণ্ডু না বুঝেও শুধু দেখা যাওয়া তার নেপথ্যে কেবল একজন- মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান।

সিদ্দিকুর রহমান নামটার সাথে আমার পরিচয় আরও এক দশক পূর্বে। সে বছর প্রথম বাংলাদেশি গলফার হিসেবে ব্রুনাই ওপেন জিতে পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন তিনি। এশিয়ান ট্যুরে যাত্রা শুরুর মাত্র দুবছরের মাথায় প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়ে সে বার দেশের ক্রীড়াঙ্গনে হইচই ফেলে দেন এ গলফার। স্মৃতি প্রতারণা না করে থাকলে বলতে পারি, তিনি যেদিন (২০১০ এর আগস্টের কোনো এক শুভ দিন) ব্রুনাই ওপেন জিতেন সেদিনই দূরদর্শনে একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো তাঁকে দেখা ও চেনা হয় আমার।

সময়টা ২০১৩! পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি হিরো ইন্ডিয়ান ওপেন গলফে অংশ নিতে যাচ্ছেন সিদ্দিকুর। সে সময় টেন ক্রিকেটে পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার ওয়ানডে সিরিজ দেখছিলাম। তো এই খেলা দেখতে দেখতে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানতে পারি ইন্ডিয়ান ওপেন গলফ সরাসরি সম্প্রচার করতে যাচ্ছে টেন স্পোর্টস।

তখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্টে অংশ নিলেও চ্যানেলের অভাবে সিদ্দিকুর রহমানের খেলা একটিবারের জন্যও সরাসরি দেখা হয়নি। তবে টেন স্পোর্টস সম্প্রচার করতে যাওয়ায় অবশেষে সে সুযোগটা মিললো।

এখনও মনে পড়ে, ওই টুর্নামেন্টের প্রতিটি দিন প্রতিটি রাউন্ডের খেলার কিয়দংশও মিস করিনি আমি। কোনোকিছু না বুঝে ধৈর্য সহকারে শুধু দেখে গিয়েছিলাম। আর একটা কথা বলতেই হয়। গলফের স্কোরকার্ডটা ছিল বড্ড বিভ্রান্তিকর। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের স্কোরের আগে একটা মাইনাস চিহ্ন থাকত। মাইনাস স্কোর যার সবচেয়ে বেশি তিনি পয়েন্ট টেবিলে সবার উপরে অবস্থান করতেন। এসব দেখে একটু ভড়কে যেতাম। মাথায় অনেক আজব আজব ভাবনাও খেলে যেত। আর বুঝতাম শুধু এটাই – যত কম শটে বল হোলে ফেলা যায় ততই মঙ্গল।

ইন্ডিয়ান ওপেন গলফ চলাকালীন প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে পত্রিকায় প্রতিবেদন পড়তাম। পড়ে যদি খেলাটা সম্পর্কে একটু ধারণা পাওয়া যায়৷ অবশ্য সে আশায় গুড়েবালি! তবে পত্রিকা পড়ার মাধ্যমে বোগি, বার্ডি, আন্ডারপার টার্মগুলার সাথে পরিচিত হই৷ যদিও এগুলা কী তা ঠিকমতো বুঝতেই পারিনি।

যা-ই হোক। এবার খেলায় ফেরা যাক। যতদূর মনে পড়ে ইন্ডিয়ান ওপেন গলফের শুরুর দিন থেকেই বেশ ভালো খেলতে থাকেন সিদ্দিকুর রহমান৷ প্রথম তিন রাউন্ডের খেলায় শিরোপার স্বপ্ন দেখাতে থাকেন বাংলাদেশকে৷ কিন্তু অন্যান্যদের চেয়ে এগিয়ে থেকেও ফাইনাল রাউন্ডের শুরুতে স্নায়ুচাপের কারণে একটু গড়বড় করে ফেলেন তিনি। ধারাভাষ্য শুনে বুঝতে পারি ফাইনাল রাউন্ডের একটা সময় টুর্নামেন্টটি সিদ্দিকুরসহ আরও দুইজনের জন্য ওপেন হয়ে যায়৷ তবে শেষদিকে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভুল করলে আর সিদ্দিকুর মাথা ঠাণ্ডা রেখে স্বাভাবিক খেলাটা খেলেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যান।

চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সেই মুহূর্তটা এখনও চোখে ভাসে। বলটাকে আলতো করে ঠেলে হোলে পুরে দ্বিতীয়বারের মতো পেশাদার টুর্নামেন্ট জেতা সিদ্দিকুর ছিলেন অনেকটাই নির্লিপ্ত। শুধু দুই হাত উঁচিয়ে তোলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তাঁর উদযাপন। মূলত হিরো ইন্ডিয়ান ওপেন গলফ জেতার মাধ্যমেই পুরো দেশে একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে বেশি পরিচিতি লাভ করেন সিদ্দিকুর। তখন গ্রামীণফোনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হওয়ায় দেশের আনাচে-কানাচে বিভিন্ন জায়গায় বিলবোর্ডগুলাতে শোভা পায় তাঁর ছবি।

যদিও সিদ্দিকুর রহমানের জীবনটা একটা রোলার কোস্টার যাত্রা। তাঁর দেশের বাড়ি মাদারীপুরে হলেও জন্ম ঢাকায়। বেড়ে ওঠা ভাষানটেকের ধামালকোট বস্তিতে। পরিবারে আর্থিক অনটন নিত্য লেগে থাকায় ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি কাজে লেগে যান সিদ্দিকুর। প্রথমে কুর্মিটোলায় বলবয় হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। বাকিটা ইতিহাস! সামান্য বলবয় থেকে যাত্রা শুরু করে ক্যাডি হয়ে আজ তিনি এদেশের গলফের পোস্টার বয়।

বাংলাদেশে গলফের মতো অখ্যাত ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল খেলাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়াটা খুবই দুঃসাহসিক ব্যাপার। সিদ্দিকুর রহমান সে দুঃসাহসটা দেখিয়েছেন। তাতে ধরা দিয়েছে সফলতা। একসময় এশিয়ান র‍্যাঙ্কিংয়ের সেরা দশে অবস্থান করা সিদ্দিকুর প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ২০১৩ গলফ বিশ্বকাপে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।

সেইসাথে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অলিম্পিকে সরাসরি অংশ নেওয়ার কৃতিত্বটাও তাঁর দখলে। ২০১৬ রিও অলিম্পিকের গলফ ডিসিপ্লিনে অংশ নেওয়া বিশ্বের সেরা ৬০ জন গলফারের মধ্যে তিনি অন্যতম৷ ২০০৭ সালে পেশাদার গলফের আঙিনায় প্রবেশ করার পূর্বে সার্কভুক্ত সকল দেশে অপেশাদার টুর্নামেন্ট জেতার কীর্তিও গড়েন তিনি। তাছাড়া ২০১৪ সালে ইউরোপ ও এশিয়ার গলফারদের নিয়ে মালয়েশিয়ায় আয়োজিত ইউরেশিয়া কাপ গলফে যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন হওয়া এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন সিদ্দিকুর। সবমিলিয়ে অদ্যাবধি ছয়টি পেশাদার ও বারোটি অপেশাদার টুর্নামেন্ট শিরোপা যোগ হয়েছে তাঁর ঝুলিতে৷

এই যে সিদ্দিকুরের এতসব অর্জন তার পেছনে অবশ্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, কষ্ট ও সংগ্রামের গল্প রয়েছে৷ গলফের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী লাল-সবুজের ঝান্ডা উড়িয়ে আমাদের গর্বিত করায় আপনাকে টুপি খোলা শ্রদ্ধা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...