হোবার্ট মহাকাব্যের রচয়িতা গিলক্রিস্ট

পঞ্চম দিনেও একই অবস্থা। গিলক্রিস্ট-ল্যাঙ্গার জুটিকে যেন থামানোই যাচ্ছিল না। ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে দুজনে মিলে যোগ করলেন ২৩৮ রান! সর্বকালের অন্যতম সেরা, ক্লাসিক এক জুটি! একদিকে লক্ষ্যপূরণে অবিচল ল্যাঙ্গারের প্রতিরোধ আর অন্যদিকে জয়ের নেশায় উন্মত্ত গিলক্রিস্টের আগ্রাসী স্ট্রোকপ্লে!টার্গেট থেকে মাত্র পাঁচ রান দূরে থাকতে ল্যাঙ্গারকে আউট করে শেষমেশ জুটিটা ভেঙেছিলেন সাকলাইন মুশতাক। আর উইনিং শটটা এসেছিল গিলক্রিস্টের ব্যাট থেকে।

টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে সর্বকালের সেরা ইনিংস কোনটি? এ প্রসঙ্গে বেশ তর্ক-বিতর্ক চলছে গত কয়েকদিন ধরে। প্রায় সবার আলোচনাতেই ঘুরেফিরে আসছে কেবল তিনটি নাম। ব্রায়ান লারা (১৫৩*), কুশল পেরেরা (১৫৩*) এবং বেন স্টোকস (১৩৫*)।

এখন এই তিনটি ইনিংসকে যদি ‘টপ থ্রি’ ধরে নিই, তাহলে চতুর্থ সেরা ইনিংস বলবেন কোনটিকে? আপনাদের কাছে হয়ত এই প্রশ্নের অনেক উত্তর পাওয়া যাবে কিন্তু আমার কাছে উত্তর একটাই। গিলক্রিস্টের ১৪৯*, পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৯৯৯ সালে হোবার্টে।

শুরুতেই বলে রাখি, প্রায় এক ‍যুগ আগে ওয়াসিম, ওয়াকার, শোয়েব, সাকলাইন আর আজহার মেহমুদকে নিয়ে গড়া বিশ্বের সেরা বোলিং আক্রমণ ছিল পাকিস্তানের। তো এরকম দুর্ধর্ষ বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে চতুর্থ ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার টার্গেট দাঁড়িয়েছিল ৩৬৯ রান। তখনকার দিনে ফোর্থ-ফিফথ ডে’র পিচে এই রান তাড়া করে জেতা অনেকটা হিমালয় পর্বত জয় করার মতই ব্যাপার ছিল।

গ্রেগ ব্লিউয়েট (২৯) আর মাইকেল স্ল্যাটারের (২৭) উদ্বোধনী জুটি অস্ট্রেলিয়াকে একটা ‘মোটামুটি’ শুরু এনে দিলেও একসময় নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে তারা। অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ করেছিলেন ২৮ রান; মার্ক ওয়াহ আর রিকি পন্টিং দুজনেই ফিরে যান ০ রানে! ফলে মাত্র ১২৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। অথচ জয়ের জন্য তখনও লাগে ২৪৩ রান।

এমন সময় ক্রিজে আসেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। বলে রাখি, এটা ছিল গিলক্রিস্টের ক্যারিয়ারের মাত্র দ্বিতীয় টেস্ট! নিয়মিত উইকেটরক্ষক ইয়ান হিলিকে সরিয়ে আগের টেস্টেই তাঁর অভিষেক হয়েছে।

তো গিলক্রিস্ট সেদিন নেমেই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে শুরু করলেন কাউন্টার অ্যাটাক। বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে পাশে পেলেন জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে। বলে রাখা উচিত, অস্ট্রেলিয়া দলে ল্যাঙ্গারের জায়গাটা কিন্তু তখন বেশ নড়বড়ে ছিল। ল্যাঙ্গার আসলে তখনও ঠিক ‘ল্যাঙ্গার’ হয়ে ওঠেন নি। ব্যাট করতেন তিন নম্বরে; চার বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে টেস্ট খেলেছেন সাকুল্যে আটটি!

গিলক্রিস্ট নামার পর চতুর্থ দিনের শেষ সেশনটা ডমিনেট করেছিল অস্ট্রেলিয়ানরাই। দিনশেষে স্বাগতিকদের স্কোর দাঁড়াল ১৮৮/৫। ল্যাঙ্গার ৪৫* এবং গিলক্রিস্ট অপরাজিত ছিলেন ৫২ রানে।

পঞ্চম দিনেও একই অবস্থা। গিলক্রিস্ট-ল্যাঙ্গার জুটিকে যেন থামানোই যাচ্ছিল না। ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে দুজনে মিলে যোগ করলেন ২৩৮ রান! সর্বকালের অন্যতম সেরা, ক্লাসিক এক জুটি! একদিকে লক্ষ্যপূরণে অবিচল ল্যাঙ্গারের প্রতিরোধ আর অন্যদিকে জয়ের নেশায় উন্মত্ত গিলক্রিস্টের আগ্রাসী স্ট্রোকপ্লে!

টার্গেট থেকে মাত্র পাঁচ রান দূরে থাকতে ল্যাঙ্গারকে আউট করে শেষমেশ জুটিটা ভেঙেছিলেন সাকলাইন মুশতাক। আর উইনিং শটটা এসেছিল গিলক্রিস্টের ব্যাট থেকে।

১২ বাউন্ডারিতে ল্যাঙ্গার করেছিলেন ২৯৫ বলে ১২৮ রান। আর ১৮ টি চার ও একটি ছক্কার সাহায্যে গিলক্রিস্ট খেলেছিলেন ১৬৩ বলে ১৪৯ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি হাঁকানোর জন্য এর চাইতে ভালো উপলক্ষ বোধ হয় আর হতে পারত না!

গিলক্রিস্টের ১৪৯* নিঃসন্দেহে একটি কালজয়ী ইনিংস। সর্বকালের অন্যতম সেরা বোলিং আক্রমণকে নিয়ে গিলক্রিস্ট যেভাবে ছেলেখেলা করেছিলেন, বিশেষ করে ফিফথ ডে’র উইকেটে সাকলাইনের মত অফ স্পিনারকে তিনি যেভাবে সামলেছিলেন তা ছিল বলার বাইরে।

এ প্রসঙ্গে উইজডেন লিখেছিল, ‘The way he (Gilchrist) took apart Saqlain with his booming cover drives, clockwork sweeps and massive pulls over mid-wicket gave the world one of the first glimpses of what Adam Gilchrist was capable of.’

অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে এর আগে সর্বোচ্চ তাড়া করা ছিল ৩৩২ রান। প্রায় ৭১ বছরের পুরনো রেকর্ড ভেঙে নতুন ইতিহাস গড়া ‘মনুমেন্টাল’ এই রান চেজে গিলির ইনিংসের ইম্প্যাক্ট ছিল সবচেয়ে বেশি। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় ল্যাঙ্গারের ২৯৫ বলে ১২৮ রানের ইনিংসটাও কোন অংশে কম তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...