জাভেদ-ইমরান: কিংবদন্তিতুল্য দ্বৈরথের গভীরে

পরবর্তীকালে সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে ক্রিকেট মাঠে ইমরানকে সহায়তা করলেও, ব্যক্তিগত জীবনে দুজন কোনোদিনই বন্ধু হতে পারেননি। এরপর দুটি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে হারতে হয় পাকিস্তানকে। বিশেষ করে ঘরের মাঠে ৮৭ সালের সেমিতে হার খুবই যন্ত্রণাদায়ক ছিল।

১৯৭৬ সাল। পাকিস্তান ক্রিকেটে জাভেদ মিয়াঁদাদের অভিষেক হয়েছিল উল্কার মত। তৎকালীন সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন। আগের বছরেই ওয়ান ডে ডেব্যু হয়েছিল। অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিমান এশিয়ান ব্যাটার হিসেবে অল্পদিনেই তাঁর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে।

অন্যদিকে ইমরান ৭১ সালে ডেব্যু করলেও প্রায় তিন বছর অপেক্ষা করতে হয় দ্বিতীয় টেস্ট খেলার। জাভেদের মত খ্যাতি শুরুতে তিনি পাননি। মূলত ফাস্ট বোলার যিনি ব্যাটটাও করতে পারেন এই ভূমিকায় এই সুদর্শন লম্বাচুলের যুবক দলে ঢুকেছিলেন।

দুজনের অগ্রগতি একভাবে হয়নি। জাভেদ নাম যশের সাথে সাথে অধিনায়কত্ব পেয়ে যান ইমরানের আগেই। কিন্তু দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি তাঁর এই অধিনায়কত্ব। ১৯৮১ সালের শেষদিকে দলের অধিকাংশ সদস্য জাভেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং অনেকেই মনে করেন এর পেছনে ছিলেন ইমরান। যদিও বিদ্রোহের মুখ ছিলেন জাহির আব্বাস এবং মজিদ খান ( ইমরানের কাজিন)। নানাবিধ বিতর্কের মাঝে ১৯৮২ সালের ইংল্যান্ড সফরের আগে ইমরান অধিনায়কত্ব পান।

ইংল্যান্ড সফরে ইমরান বেশ ভাল পারফর্ম করেন এবং বছরের শেষে শুরু হওয়া ৬ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ভারতকে ৩-০ হারিয়ে নিজেকে অধিনায়ক হিসেবে বেশ ভালভাবেই প্রতিষ্ঠা করেন। প্রসঙ্গত, ভারত সিরিজে ইমরান ৪০ উইকেট পান। ভারতের পক্ষে কপিল পান ২৪ উইকেট। রানের দিক থেকে ভারতের মহিন্দর অমরনাথ (৫৮৪) ও পাকিস্তানের মুদাসসার নজর (৭৮১) এগিয়ে ছিলেন। যদিও জাহির আব্বাস দুটি সেঞ্চুরি ও একটি ডাবল সেঞ্চুরি করে নজর কাড়েন। এই সিরিজেই এমন একটি ঘটনা ঘটে যা চিরকালের মত জাভেদ ও ইমরানের মধ্যে তিক্ততা তৈরি করে দেয়।

বর্তমানে বিভিন্ন অ্যামেচার ক্রিকেট প্রেমীরা ভারতের সৌরভ – শচীন ( শচীনের ক্যাপ্টেন থাকাকালীন সৌরভের ব্যাটিং অর্ডারে নেমে আসা, কাম্বলী কে অঙ্কুরেই বিনাশ না করা), দ্রাবিড় – শচীন ( ১৯৪* ডিক্লেয়ার) বা সৌরভ – দ্রাবিড় ( চ্যাপেল এপিসোড) কনফ্লিক্ট নিয়ে চায়ের আসরে তুফান তোলেন। তাঁরা সম্ভবত জাভেদ ইমরানের শত্রুতা নিয়ে আস্ত একটা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারবেন।

যাক, মূল কথায় আসি। চতুর্থ টেস্টে সিরিজে ২-০ এগিয়ে থাকা অবস্থায় টস জিতে পাকিস্তান ব্যাটিং নেয় এবং ৬০ রানের মাথায় বালবিন্দর সাধু পরপর মহসিন খান এবং হারুন রশিদকে আউট করায় মুদাসসর নজর আর জাভেদ মিয়াঁদাদ জুটি বাঁধেন। দিনের শেষ অবধি এই জুটি অবিচ্ছিন্ন থাকে, দলের রান পৌঁছায় ২২৪/২, নজর ৯২ ও জাভেদ ৯৪ রানে অপরাজিত।

উল্লেখ্য যে, এই সিরিজে জাভেদ ও জাহির আব্বাস কপিলের আউটসুইং বলে যথেচ্ছ স্কোয়ার কাট মেরে অনেক রান করেন। এই সিরিজের পরে কপিল তাঁর ন্যাচারাল আউটস্যুইং এর পাশাপাশি ইনসুইং এও জোর দেন।

যাক, মূল কথায় ফিরি। দ্বিতীয় দিনের শেষ ভাগে নজর ২৩১ করে আউট হন, জাভেদের সঙ্গে এক মহাকাব্যিক ৪৫১ রানের পার্টনারশিপ করার পরে। জাভেদ ২৩৮* এবং আব্বাস ৪ রানে অপরাজিত থাকেন। পাকিস্তানের রান তখন ৫১৫/৩!

তৃতীয় দিনেও পাকিস্তান ব্যাটিং চালিয়ে যায়। কিন্তু দলের ৫৮১ রানের মাথায় যখন জাভেদ মিয়াঁদাদ ২৮০* রানে খেলছেন (৪৬০ বলে), ইমরান ডিক্লেয়ার দেবার সিদ্ধান্ত নেন। দলের জয়ের জন্য যথেষ্ট সময় ও রান হাতে রাখার ক্ষেত্রে হয়তো সময়টা ঠিকই নির্বাচন করেছিলেন ইমরান (কেননা ভারত তৃতীয় দিনে ১৮৯ রানে প্রথম ইনিংসে আর পঞ্চম দিনে ২৭৩ রানে দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট হয়ে ইনিংসে হেরে যায়)।

কিন্তু জাভেদ ট্রিপল সেঞ্চুরি এবং সোবার্সের ৩৬৫* রানের বিশ্বরেকর্ড দুয়েরই আগে থেমে যেতে হওয়া মন থেকে মেনে নিতে পারেননি (জাভেদকে ট্রিপল সেঞ্চুরি হয়তো করতে দেওয়া যেত, কিন্তু সোবার্সের রেকর্ড ভাঙতে গেলে সম্ভবত ম্যাচ ড্র হতো)। ব্যক্তিগত মাইলস্টোন যথেষ্ট গুরুত্ব পেত জাভেদের কাছে। ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায় এই ডিক্লেয়ারেশনের জন্য কোনোদিনই ইমরানকে ক্ষমা করেননি জাভেদ। বরং এই সিদ্ধান্তকে তাঁকে অধিনায়কত্ব থেকে সরানোর বিদ্রোহ এবং পেছনে ইমরানের কলকাঠি নাড়ার একটা কন্টিনিউয়েশন হিসেবেই দেখেছিলেন।

পরবর্তীকালে সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে ক্রিকেট মাঠে ইমরানকে সহায়তা করলেও, ব্যক্তিগত জীবনে দুজন কোনোদিনই বন্ধু হতে পারেননি। এরপর দুটি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে হারতে হয় পাকিস্তানকে। বিশেষ করে ঘরের মাঠে ৮৭ সালের সেমিতে হার খুবই যন্ত্রণাদায়ক ছিল।

যদিও ৯২ বিশ্বকাপে দুজন একসাথে শেষবার খেলার সময় সব না পাওয়া সুদে আসলে মিটিয়ে নেন। জাভেদ ইমরান দুজনেই ভাল পারফর্ম করেন এবং দুজনের ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারের শেষ পার্টনারশিপ, ৯২ ফাইনালে ইমরান ৭২ ও জাভেদ ৫৮ রান করে দলকে সম্মানজনক স্কোরে পৌঁছে দেন, পরে যা উইনিং স্কোর হয়ে দাঁড়ায়।

যদিও ব্যক্তিগত জীবনের তিক্ততা এর পরেও কাটেনি পুরোপুরি। ইমরান মন্ত্রীত্ব পাওয়ার পরেও অনেকবার জাভেদ তাঁকে আক্রমণ করেছেন বিভিন্ন কারণে। পাকিস্তানের ক্রিকেটকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন ইমরান এমন অভিযোগও করেছেন। কিছু কিছু ভার বোধ হয় কখনোই লাঘব হয় না!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...