একটি ছক্কা ও হাজারো হৃদয়ক্ষরণ

মিয়াঁদাদ জানতেন, চেতন ইয়র্কারই করবেন। আত্মজীবনী ‘কাটিং এজ: মাই অটোবায়োগ্রাফি’-তে তিনি লিখেছেন, ‘আমি জানতাম ও ইয়র্কার করারই চেষ্টা করবে, তাই আমি একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। পুওর চেতন শর্মা।’

ক্রিকেট মাঠে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে রাজত্ব জয়ের মত যুদ্ধের ইতিহাস বেশ পুরনো। যদিও আইসিসি ইভেন্টে জয়ের হিসেবে পাকিস্তানের চেয়ে আজো বিরাট এগিয়ে ভারত – আরব আমিরাতের মরুর বুকে শারজাহর মাঠে ভারতীয় দলকে গভীর ক্ষত উপহার দিয়েছিল পাকিস্তান। যখনই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কোনও ক্রিকেট ম্যাচের প্রসঙ্গ আসে তখন অবশ্যই জাভেদ মিয়াঁদাদ ও তাঁর সেই ঐতিহাসিক ছক্কার প্রসঙ্গ আসবে।

দিনটা ছিল ১৯৮৬ সালের ১৮ এপ্রিল। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শারজাহতে অস্ট্রালশিয়া কাপের ফাইনাল ম্যাচের দিনি। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ভারত সাত উইকেটে ২৪৫ রান করেছিল। সুনীল গাভাস্কার ৯৯, কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্ত ৭৫ এবং দিলীপ ভেঙসরকার ৫০ রান করেছিন। ওয়াসিম আকরাম তিনটি এবং পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দুটি উইকেট নিয়েছিলেন।

এরপরে পাকিস্তানের ব্যাটিং এসেছিল। ভারতীয় দল ভাল বোলিং করেছিল ভালই। ২৪১ রান পর্যন্ত যেতে পাকিস্তানের নয় উইকেট নিয়েছিলেন ভারতের বোলারার। তবে জাভেদ মিয়াঁদাদ ছিলেন শক্তিশালী ভূমিকায়, এক প্রান্ত আগলে রেখেছিলেন।

তাঁর ইনিংসটা ঐতিহাসিক। ম্যাচের শেষ ওভারটি আরো।

পাকিস্তান ৪৯.৫ ওভারে ২৪২ রান করেছিল। জয়ের জন্য ম্যাচের শেষ বলে তার চার রান দরকার ছিল। চেতন শর্মা ভারতের হয়ে বোলিং করছিলেন। মিয়াঁদাদ তার শেষ বলে ছক্কা দিয়ে পাকিস্তানকে জয় দিয়েছিলেন। ১১৪ বলে ১১৬ রান করে অপরাজিত থাকেন তিনি। বড় কোনো আসরে সেবারই প্রথম শিরোপা জিতে পাকিস্তান।

মিয়াঁদাদ জানতেন, চেতন ইয়র্কারই করবেন। আত্মজীবনী ‘কাটিং এজ: মাই অটোবায়োগ্রাফি’-তে তিনি লিখেছেন, ‘আমি জানতাম ও ইয়র্কার করারই চেষ্টা করবে, তাই আমি একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। পুওর চেতন শর্মা।’

এই ছয়ের পরে মিয়াঁদাদের জীবন যেন বদলে গেল এক নিমিষেই। তিনি হাবিব ব্যাংকে পদোন্নতি পেয়েছিলেন, তিনি পেয়েছিলেন ৮০ হাজার ডলারের ডায়মন্ড ব্রেসলেট। এখানেই শেষ নয়, মিয়াঁদাদ একটি মার্সিডিজ গাড়ি উপহার পেয়েছিলেন।

অন্যদিকে, এই সময় ২০ বছর বয়সী চেতন শর্মাকে এই ম্যাচ খলনায়ক হিসেবে মনে রেখেছে। ভারতের ইতিহাসে অনেক বড় মাপের তারকা নন চেতন। তাই, যতবার এরপর যেখানেই সাক্ষাৎকার দিয়েছেন এই অলরাউন্ডার, তখনই শেষ বলে ওই ছক্কা হজমের স্মৃতিচারণা করতে হয়েছে তাঁকে।

তবে, এটা ঠিক যে – চেতন শর্মা সেদিনের দু:স্বপ্ন ভুলতে পেরেছিলেন। এর পরের বছরই তিনি হ্যাটট্রিক করেন বিশ্বকাপে। সেটা বিশ্বকাপের ইতিহাসেরই প্রথম হ্যাটট্রিক। ম্যাচটি ছিল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।

চেতন শর্মা তার ১০ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৬৫ ওয়ানডে এবং ২৩ টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন। এই বোলার ওয়ানডেতে ৬৭ উইকেট এবং টেস্টে ৬১ উইকেট নিয়েছেন। ওয়ানডেতেও তার নামে একটি সেঞ্চুরি রেকর্ড রয়েছে। যদিও, সব ছাপিয়ে ওই ছক্কাটাই তাঁর ক্যারিয়ারের হাইলাইটস।

অন্যদিকে, মিয়াঁদাদ পাকিস্তানের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। দেশটির হয়ে তিনি ১২৪ টি টেস্ট এবং ২৩৩ ওয়ানডে খেলেছেন। টেস্ট ক্রিকেটে ৫২.৫৭ গড়ে তিনি ৮৮৩২ রান করেছেন। অন্যদিকে ওয়ানডেতে ব্যাট হাতে ৪১.৭০ গড়ে তিনি ৭৩৮১ রান করেছেন। মিয়াঁদাদ ২৩ টেস্ট এবং ৮ টি ওয়ানডে সেঞ্চুরি করেছিলেন। একই সাথে, তিনি প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ারে ৮০ টি এবং লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ১৩ টি সেঞ্চুরি করেছিলেন। ওই ছক্কাটি তাঁর ক্যারিয়ারের ‍মুকুটে আরেকটি পালক মাত্র।

ছক্কাটি নিয়ে অনেক চর্চা হয়। শহীদ আফ্রিদি তাঁর আত্মজীবনী গেম চেঞ্জারে লিখেছিলেন, এই সংক্রান্ত ছড়া নাকি আশির দশকের শেষে পাকিস্তানি শিশুদের মুখে মুখে ঘুরতো। সেই দু:স্বপ্ন ভারত ভুলেছে। তবে, ঘটনাটা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে টিকে আছে ক্রিকেটের পাতায়। কোটি কোটি ক্রিকেট ভক্তের কাছে সেই দৃশ্য আজো অমলিন!

মজার ব্যাপার হল, সেদিন মিয়াঁদাদ নিজের ব্যাট নিয়ে খেলতে নামেননি। খেলেছিলেন স্বয়ং ওয়াসিম আকরামের ব্যাট দিয়ে!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...