মহেন্দ্র সভ্যতা

কুলাসেকারার বলে শেষ ছয়টা হাঁকিয়ে একটা হালকা হাসি। বারো নম্বরী মৃত্যুঞ্জয়কে জড়িয়ে ধরা আর তারপর চিরাচরিত ট্রেডমার্ক বজায় রেখে একটা ভিক্টরি উইকেট তুলে নীরবে ত্যাগ করা একটা সবুজ মাঠ। এটাই তো পনেরো বছর ধরে ঘটে চলা ‘মহেন্দ্রনীতি’।

পপিং ক্রিজের একটু আগেই উপুর হয়ে শুয়ে রয়েছে একটা নীল জার্সি। বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরে পড়া এক চিমটে সিন্ধু মাটি অপেক্ষা করছে মেরিন ড্রাইভের ধারে। পাশ দিয়ে বয়ে চলা আরব সাগরের স্রোত জানান দিচ্ছে ইতিহাস আসন্ন। ইতিহাসের সম্মুখ সমরের লড়াইয়ে হঠাৎই ক্ষান্ত একজন।

পিঠে অসহ্য যন্ত্রণা। ন্যাশনাল মেডিকেল টিমের ফিজিও উপস্থিত। যন্ত্রণার ব্যাঞ্জনবর্ণ আর স্বরবর্ণ নেই, যন্ত্রণার আছে কিছু বিভক্তি যেটা উহ্য হয়ে বসে থাকে বর্ণ বা শব্দের শেষে, কিন্তু দেখেও দেখা হয় না তাকে। স্পাইনাল পেইনের ইতিহাস তার নতুন নয়।

সেই যে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৬ এ আউট, সেখানেও ছিল একটা কোমরের পেইন রিলিফিং ব্যান্ড। ইচ্ছা হলেই সেদিন ‘রিটায়ার্ড ইন হার্ট’ অপশনটা ক্লিক করতে পারতেন, যদিও ১৫ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে কবার সেটা করেছেন ঠিক জানি না। কিন্তু তাঁর দুই কাঁধে ছিল একটা সভ্যতার দায়িত্ব, একটা জাতির দায়িত্ব, একটা স্বাধীনতার দায়িত্ব।

পাশে দাঁড়িয়ে একটা কাদামাখা জার্সিতে লড়াইয়ের অপেক্ষায় প্রতীক্ষারত ‘মোহনলাল’ গৌতম। তাঁকে যে উঠতে হবেই। তখনও যে বাকি ছিল অনেকটা পথ। ইঞ্জিনের জন্য পেট্রোল লাগে, আর সিন্ধু সভ্যতার মহানায়কদের জন্য দরকার এক ফোঁটা সিন্ধু মাটি। তাই তো চোয়ালভেঙেও ব্যান্ডেজ বেঁধে ক্যারিবিয়ান ক্যালিপ্সোর রাগগুচ্ছ ভেঙে চুরমার করে দেন অনিল কুম্বলে, চোট পেয়েও উঠে দাঁড়িয়ে ওয়াকারকে চার হাঁকান শচীন টেন্ডুলকার।

আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় একটা সাত নম্বর নীল জার্সি। উঠে দাঁড়ায় একটা সভ্যতা। পিঠে কিছু ম্যাসাজ, হয়তো একটা বেল্ট, কিন্তু তাঁর থেকেও সেদিন বেশি যেটা ছিল সেটা বুকের মাঝে – ‘Bear The Pain, Bear The Pain’-এর বারংবার অনুরণন। সেদিন গাম্ভীরের কাদামাখা জার্সির পাশেও দাঁড়িয়েছিল একটা যন্ত্রণাক্লিষ্ট পিঠ।

আইপিএল থেকে বিশ্বকাপ,ক্যারিয়ারের প্রথম থেকে শেষ, বারেবারে একটাই শমণযন্ত্রণা ভুগিয়েছে তাঁকে – ‘ব্যাক পেইন’, আর বারেবারে কোনো এক দুর্দমনীয় মননের তেজে হুঙ্কার ফেলেছে সে – ‘আছে বাকি? শেষ বজ্রাঘাত?’

কুলাসেকারার বলে শেষ ছয়টা হাঁকিয়ে একটা হালকা হাসি। বারো নম্বরী মৃত্যুঞ্জয়কে জড়িয়ে ধরা আর তারপর চিরাচরিত ট্রেডমার্ক বজায় রেখে একটা ভিক্টরি উইকেট তুলে নীরবে ত্যাগ করা একটা সবুজ মাঠ। এটাই তো পনেরো বছর ধরে ঘটে চলা ‘মহেন্দ্রনীতি’।

সেলিব্রেশনে মত্ত কাঁধ গুলোতে চেপে তখন জাতীয় পতাকা ওড়াচ্ছে নব্যসিন্ধুর মহানায়ক সিরাজ। আর অদূরে হাসিমুখে জহির-শেবাগ-গম্ভীরের হাত ধরে মাঠ পরিক্রম করছেন মহেন্দ্রিক সভ্যতার পৃষ্ঠপোষক। তারপর বিশ্বকাপ তুলে দেওয়ার মঞ্চে আইসিসির কোহিনূর গ্রহণ, আর সাথে সাথেই সেটা দিয়ে দিলেন সতীর্থদের। আর শ্যাম্পেনের বিশ্ব জয়ের সেলিব্রেশনের অনেক পিছনের দিকে সবার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকল একটা ক্ষণ, একটা সময়, একটা সভ্যতা।

এ সভ্যতা আমাদের কাছে মহেন্দ্রিক সভ্যতা। এ সভ্যতার নীতিতে উচ্ছ্বাস নেই, সহনশীলতা আছে। সম্মান নেই, অপমান আছে। আর আছে হাজার বার সেই ট্রল নামক অপমানের সামনেও মুখবোজা এক কাঠিন্য। এটাই মহেন্দ্র নীতি। যন্ত্রণা আছে, কিন্তু আছে পশমীয় জার্সির মূল্যবোধ, যেটা বারবার যন্ত্রণাকে টিটকিরি মেরে বলে- ‘প্রিথ ব্যাথা, তাই তুমি চাইলেও কখনো এই নীল জার্সি ভেদ করতে পারবে না’।এটাই নীল জার্সির মূল্যবোধ। এটাই মহেন্দ্রিক সভ্যতা।

গাম্ভীর্যের একটা কাদামাখা দেশপ্রেমের পাশে সেদিন সবার অলক্ষ্যে, সবার অগোচরে  সমানভাবে দাঁড়িয়েছিল একটা যন্ত্রণাক্লিষ্ট সভ্যতা। মহেন্দ্রিক সভ্যতা।

যন্ত্রণা দেখা যায় না। সহ্য করতে হয়।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...