গৌরশিখরে তুহিন ভেদিয়া জাগিছে সব্যসাচী!

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে কোচ গ্রেগ শিপার্ডের ধরতে পেরেছিলেন ওয়াটসনের প্রতিভা, পরিচর্যার কোনো কমতি রাখেননি।তাই তো ২০২০ সালে এসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসে ওয়াটসন যখন সব রকম ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন, তখন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে তো বটেই গোটা বিশ্ব ক্রিকেটেই একটা বেদনার সুর বয়ে গেল। আধুনিক ক্রিকেটে ওয়াটসনের মত দানবীয় আর আকর্ষণীয় অলরাউন্ডার আর ক’জনই বা এসেছেন।

১১ এপ্রিল ২০১১, মিরপুর!

বাংলাদেশ বনাম অস্ট্রেলিয়া ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ। টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ দলের ইনিংস শেষ হয় ৫০ ওভারে মাত্র ২২৯ রানে। আর সে লক্ষ্য তাড়া করতে অস্ট্রেলিয়ার লাগলো মাত্র ২৬ ওভার। সমান পনেরটি করে ছক্কা-চারে ৯৬ বলে ১৮৫ রানের অতিমানবীয় ও অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান এক বিধ্বংসী ওপেনার । সেই ওপেনারের নাম শেন রবার্ট ওয়াটসন। মিরপুরে এমন ব্যাটিং ঝড় এর আগে-পরে ওয়ানডে ক্রিকেটে আর দেখা যায়নি।

১৯৮১ সালের ১৭ জুন কুইন্সল্যান্ডের ইপসুইচে জন্মগ্রহণ করেন এই বিখ্যাত অলরাউন্ডার। কুইন্সল্যান্ডেই তাঁর বেড়ে ওঠা, সেখানকার বয়সভিত্তিক দলেই শুরু করেন ক্যারিয়ার। ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম ডাক পান তাসমানিয়া থেকে। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে কোচ গ্রেগ শিপার্ডের ধরতে পেরেছিলেন ওয়াটসনের প্রতিভা, পরিচর্যার কোনো কমতি রাখেননি।

তাই তো ২০২০ সালে এসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসে ওয়াটসন যখন সব রকম ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন, তখন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে তো বটেই গোটা বিশ্ব ক্রিকেটেই একটা বেদনার সুর বয়ে গেল। আধুনিক ক্রিকেটে ওয়াটসনের মত দানবীয় আর আকর্ষণীয় অলরাউন্ডার আর ক’জনই বা এসেছেন।

২০০২ সালের ২৪ মার্চ সেঞ্চুরিয়ানে ওয়ানডে অভিষেক হওয়া শেন ওয়াটসন ১৯০টি ওয়ানডে খেলে রান করেছেন ৫৭৫৭ এবং উইকেট নিয়েছেন ১৬৮ টি। ২০০৫ সালের ২ জানুয়ারি সিডনিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক ঘটে তার। ২০১৫ সালের ৮ জুলাই কার্ডিফে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট থেকে অবসরের আগপর্যন্ত  করেছেন ৩৭৩১ রান আর উইকেট নিয়েছেন ৭৫ টি।

২০০৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জোহানেসবার্গে টি-টোয়েন্টি অভিষেকের পর রান করেছেন ১৪৬২ এবং উইকেট নিয়েছেন ৪৮টি।

বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডেতে শেন ওয়াটসন অপরাজিত ১৮৫ রান করেন, যেটি তার ওয়ানডে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।  যেটিতে তিনি রেকর্ড ১৫টি ছয় হাঁকান। তার এই স্কোর দিয়ে তিনি কোনো অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাথু হেইডেনের করা ১৮১ রানকে কে অতিক্রম করে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়েন।

তিনি এই ম্যাচে ১৫টি ছক্কা হাঁকিয়ে ২০০৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জ্যাভিয়ার মার্শালের কানাডার বিপক্ষে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছয় (১২ ছয়) মারার আগের রেকর্ড ভেঙে তৎকালীন রেকর্ড গড়েন। পরে সেই রেকর্ড ভেঙেছিলেন রোহিত শর্মা।

এই ম্যাচে তিনি সমান ১৫ টি করে চার-ছয় হাঁকিয়ে  বাউন্ডারি দিয়ে ১৫০ রান করেন ওয়াটসন। ২০০৬ সালে হার্শেল গিবসের  বাউন্ডারি থেকে করা ১২৬ রানের রেকর্ড ভাঙেন। দলীয় স্কোরে সেদিন ওয়াটসন রেকর্ড অনুপাতে রান করেন। তিনি দলীয় স্কোরের ৭৯.৭৪% রান একাই করেন।  এটাও অনন্য এক রেকর্ড

দ্বিতীয় অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে ৫০০০ এর ওপর আন্তর্জাতিক রান এবং ১৫০-এর বেশি উইকেট নেওয়ার ডাবল অর্জন করেছেন তিনি।  প্রথম ও একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে তিন ফরম্যাটেই এক ইনিংসে সেঞ্চুরি আর চার উইকেটের রেকর্ড আছে শেন ওয়াটসনের।

টি -টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসে অজিদের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি । টানা দুটি  আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ম্যাচ অফ দ্যা ফাইনাল (২০০৬ ও ২০০৯) হয়েছিলেন তিনি।

শেন ওয়াটসন ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বর্ষসেরা পুরস্কার অ্যালান বর্ডার পদক পান। ২০১১ সালে আবারও অ্যালান বর্ডার পদক লাভ করেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সফল অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের পর  দ্বিতীয় খেলোয়াড হিসেবে় তিনি পরপর দুইবার এ পদক লাভ করেছেন।

২০১১ সালে যিনি বর্ষসেরা ওয়ানডে খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। ওই বছরই বছরের দ্বিতীয় সেরা  টেস্ট খেলোয়াড়ের পুরস্কার লাভ করেছিলেন। একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে তিন ফরম্যাটেই বর্ষসেরা ক্রিকেটার হওয়ার  রেকর্ড  তার। একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে রেকর্ড সাতবার বর্ষসেরা ক্রিকেটার হয়েছেন তিনি।

২০১২ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে তিনি ৪৯.৮০ গড়ে ২৪৯ রান সংগ্রহের পাশাপাশি বল হাতে ১১ উইকেট পান। এরফলে তাকে ম্যান অব দ্য সিরিজ ঘোষণা করা হয়। বিশ্বমঞ্চে  একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ধারাবাহিকভাবে চারবার ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার পান তিনি। ২০০৭ ও ২০১৫ অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন ওয়াটসন। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার বলা হতো ওয়াটসনকে।

২০১৬ সালে এক ঝাঁক সাফল্য কে পুঁজি করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন ওয়াটসন। এরপর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে না দেখা গেলেও বিশ্বের বড় বড় ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক টি-টোয়েন্টি আসরগুলোতে  ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ।

আর সেখানে তিনি রীতিমত হট কেক ছিলেন। সাফল্যও পেয়েছেন অনেক। ২০০৮ ও ২০১৩ সালে আইপিএলের টুর্নামেন্ট সেরা হন। ২০১৮ সালে পিএসএলেও একই সম্মান পান। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) অসংখ্যবার খেলার গুঞ্জন থাকলেও কখনো ব্যাটে বলে হচ্ছিল না অনেকদিন। ক্যারিয়ারের শেষ বেলায় অবশ্য একটা আসর তাঁকে দেখা গেছে রংপুর রেঞ্জার্সের হয়ে। সমর্থকদের চোখ জুড়িয়ে গেছেন।

শেন ওয়াটসন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সোনালী প্রজন্মের সদস্য। ২০০০ সালে তিনি শ্রীলঙ্কায় অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ খেলেছিলেন মাইকেল ক্লার্কের নেতৃত্বে। দলটাতে আরো ছিলেন শন মার্শ, নাথান হরিজ, এড কাওয়ান, অ্যান্ড্রু ম্যাকডোনাল্ড ও মিশেল জনসনরা। ভবিষ্যতে এরা এক সাথে জাতীয় দলেও খেলেছেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...