আমার ঈশ্বর বেঁচে আছেন

অন্যান্য অনেক আর্জেন্টাইনের মত আমার পক্ষেও ম্যারডোনাহীন একটি বিশ্ব কল্পনা করা খুব কঠিন। আমি জন্মলগ্ন থেকেই তাকে দেখছি, তিনি সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে তার খেলা দেখার সময় আমাদের ও দুনিয়ার মাঝে তার অনন্য গুরুত্বের কথা ভেবেছিলাম। তিনি ফুটবল সম্পর্কে আমার ধারণা পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছিলেন।

দু’বছর আগের কথা। আমি মেক্সিকোর পাচুকা থেকে কোচিং শেষে বাড়ি ফেরার পরে সর্বশেষ ম্যারাডোনার সাথে আমার কথা হয়েছিলো। ফোনে রিং বাজার সময় আমি নাম দেখে সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। কারণ আমার একদমই মনে হয় নি যে ঠিক ঐ সময়ে ম্যারাডোনার হাতে আমাকে ফোন করে কুশল জানানোর মত সময় যথেষ্ঠ সময় আছে।

তাছাড়া ঐসময়ে  তিনি আর্জেন্টিনার জিমনেশিয়া দে লা প্লাটা ক্লাবে কোচিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন। যদিও আমি জানতাম যে তিনি অনেক বড় মনের মানুষ। কিন্তু এত গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভিড়ে তার আমাকে ফোন করার কথা না।

তিনি আসলেই অনেক ব্যস্ত থাকতেন। তার ব্যস্ততার কথা বলে বুঝানো সম্ভব  নয়। শুধুমাত্র ম্যারাডোনা হবার কারণেই তাকে দিনরাত ২৪ ঘন্টা ব্যস্ত থাকতে হতো। তার ভক্তরা ও সাংবাদিকরা সারাজীবন ধরে তাকে সবজায়গায় অনুসরণ করতো। এতে জীবনে একধরণের বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা সাক্ষী হবার কথা।

কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিলো। তিনি আমাকে ফোন করার মত সময় বের করে নিয়েছিলেন। যদিও আমরা দুজনে বহু বছর ধরে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। কিন্তু দীর্ঘ একযুগেরও বেশি হয়েছে আমরা একসাথে কখনো কাজ করি নি। কিন্তু ম্যারাডোনার কাছে সবসময় আমার সাথে কাজের সম্পর্কের চেয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।

তিনি ফোনে বললেন, ‘কি খবর মার্টিন, দিনকাল কেমন চলছে? বাসার সবাই কেমন আছে? আমার এখানে বারবিকিউ পার্টি করতে কবে আসছো?’

সত্যি বলতে ম্যারাডোনার এমনই।

তিনি তার ঘনিষ্ঠ মানুষের কাছে তার গুরুত্ব সম্পর্কে বেশ ভালো অবগত ছিলেন। আমার কোন কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা তা জানতে তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি সবসময়ই এমন ছিলেন, সর্বদা যত্নশীল ছিলেন, সবময় সকলের খোঁজখবর নিতেন। এবং যখন তার সাথে আপনার দেখা হবার সম্ভাবনা প্রায় শূণ্যের কোটায় দেখেবন ঠিক তখনই তিনি আপনার সাথে সাক্ষাৎ করবেন।

একটা জিনিস আপনাকে জানতে হবে যে ম্যারাডোনা শুধুমাত্র আমার সাথেই এমন সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহার করতেন, এমন না। তিনি যাদের পছন্দ করতেন তাদের সবার সাথেই তার এমন সম্পর্ক ছিলো। তার মহিমান্বিত ব্যক্তিত্বের কারণেই আপনি তার কথা সবসময় মনে করবেন, তাকে চাইলেও ভুলতে পারবেন না।

তাই আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না যে তিনি আমাদের মাঝে আর নেই। আজ কয়েকমাস ধরে ম্যারাডোনা আমাদের মাঝে নেই। তার মৃত্যুর খবর শোনার সাথে সাথে এর সত্যতা যাচাই করতে আমি তার সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এমন একজন সাংবাদিককে মেসেজ দিয়েছিলাম, ‘যা শুনছি তা আসলেই সত্যি কিনা?’

তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘হ্যা…।’

আসলে এটি এমন এক মুহুর্ত যা আপনি কখনো বিশ্বাস করতে চাইবেন না। কারণ ম্যারাডোনার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে অসংখ্যবার গুঁজব ছড়িয়েছে। তিনি হাসপাতালে গিয়েছিলেন কিন্তু গুঁজব ছড়িয়েছিলো যে তিনি মারা গিয়েছেন। কিন্তু এসকল গুঁজব বরাবরই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং তিনি বরংবার আমাদের মাঝে স্বমহিমায় ফিরে এসেছেন। এমন গুঁজব যেহেতু অনেকবার ছড়িয়েছে তাই এবারও এই মৃত্যু সংবাদকে আপনার গুঁজব মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু এবারের গুঁজবকে তিনি পরাজিত করতে পারলেন না। তিনি চিরতরে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

এই খবর যেনো মিথ্যা হয় তার জন্য আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি। এমনকি আমি তার সাবেক স্ত্রী ক্লাউদিয়াকে পর্যন্ত মেসেজ দিয়েছি তার মৃত্যুর খবর সত্যি কিনা তা জানতে। কিন্তু তিনিও জানালেন যে যা শুনছি আসলেই সত্যি। কিন্তু তারপরও একথা বিশ্বাস করার মত না। আপনার মন কখনোই এ খবর মেনে নিতে চাইবে না। ম্যারাডোনাকে নিয়ে এতবার এত গুঁজব শুনার কারণে আমি ভাবতাম যে তিনি হয়তো শতায়ু লাভ করবেন।

তাই তার মৃত্যুর এতদিন বাদেও আমার মনে হচ্ছে যে তিনি এখনো আমাদের মাঝে আছেন।

অবশ্যই তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন। জীবনে কখনো না কখনো ঠিকই আপনার তার কথা মনে হবে।

অন্যান্য অনেক আর্জেন্টাইনের মত আমার পক্ষেও ম্যারডোনাহীন একটি বিশ্ব কল্পনা করা খুব কঠিন। আমি জন্মলগ্ন থেকেই তাকে দেখছি, তিনি সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে তার খেলা দেখার সময় আমাদের ও দুনিয়ার মাঝে তার অনন্য গুরুত্বের কথা ভেবেছিলাম। তিনি ফুটবল সম্পর্কে আমার ধারণা পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছিলেন।

ফুটবল নিয়ে আমার যে আবেগ তার প্রতিনিধি হিসেবে এখনো আমি ম্যারাডোনাকেই ভাবি। যদিও আমার কথাকে পাগলের প্রলাপ মনে হতে পারে। কিন্তু আমি এর ব্যাখ্যা দিচ্ছি। ১৯৮৬ বিশ্বাকাপের সময় আমি ছিলাম বারো বছরের এক বালক। আমি বাড়ির সামনের উঠানে আমার বন্ধুদের সাথে সবসময় ফুটবল খেলতাম। মজার কথা হচ্ছে আমার শৈশবের একটি ছবি আছে, যখন আমি প্রথম হাঁটতে শিখি তখন আমি প্রথম যা করেছিলাম তা হচ্ছে একটি ফুটবলে লাথি দিয়েছিলাম। তখন আমি নিজেকে সবসময় কিছুটা গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করতান।

আমি আমার বাবার সাথে ফুটবল নিয়ে তেমন কথা বলতাম না, সত্যি বলতে তার সাথে আমি কোনকিছু নিয়েই তেমন কথা বলতাম না। খেলা শেষে বাসায় ফেরার পরে তিনি জিজ্ঞেস করতেন, ‘কেমন খেললে?’

আমি বলতাম, ‘ভালো, ২-০ গোলে জিতেছি।’

তিনি বলতেন, ‘ভালোই, তুমি কি গোল দিয়েছো?’

আমি উত্তরে বলতাম, ‘হ্যা, আমি একটি দিয়েছি।’

বাবার সাথে আমার এরচেয়ে বেশি কথা হতো না। আমি কখনোই জোরে জোরে চিৎকার করে বলতাম না যে, “আমরা জিতছিইইইইইইইইইই! এবং আমি একটি গোল দিছিইইইইইইইইইই!” এ অনুভূতিগুলো আমি মনে মনে রাখতাম। কিন্তু এই অনুভুতিগুলো আমি এখনো অনুভব করি।

১৯৮৬ তে ম্যারাডোনার খেলা দেখার পরে আমার অনুভূতিগুলোর মাত্রা আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিলো। আমি আমার ভাই ও বাবা মার সাথে খেলা দেখেছিলাম এবং আমি দেখেছি যে ম্যারাডোনা ফুটবলকে আমার কল্পনাতীত এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। গোল, মহত্ব, আবেগ! এগুলোই হলো ফুটবল।

রাস্তায় বিশ্বকাপ জয় উদযাপন করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিলো একমাত্র ফুটবলের পক্ষেই মনকে এমন পরিতৃপ্তি দেয়া সম্ভব। এবং এই পরিতৃপ্তির যোগানদাতা ছিলেন দিয়াগো ম্যারাডোনা।

ফুটবল একইসাথে বেদনার কারণও হতে পারে তা আমি অবশ্য পরে বুঝেছি। শৈশবে আপনি ফুটবল খেলে অনেক মজা পাবেন কারণ কেউ আপনাকে জোর করে কিছু করাবে না। কিন্তু পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে কোন ক্লাবে যোগ দেবার পরে একজন ফুটবলারের জীবন সম্পর্কে আপনার ধারণাই পাল্টে যাবে। আমার আজন্ম লা প্লাটা ক্লাবের হয়ে খেলার স্বপ্ন ছিলো। আমি ছোটবেলা থেকে লা প্লাটার সমর্থক ছিলাম। আমার বাবা ও ভাইও লা প্লাটার সমর্থক ছিলেন। আমার পুরো পরিবার লা প্লাটার শহরের বাসিন্দা ছিলো। ক্লাবে যোগ দেবার পরে আমি বারবার ইনজুরিতে পড়ে পিছিয়ে পড়ছিলাম ও দিনে দিনে হতাশ হওয়া শুরু করেছিলাম। কিন্তু এখানে ম্যারাডোনাই আমাকে সাহায্য করেছিলেন।

ম্যারাডোনার সাথে সাক্ষাৎ না করেও আমি ম্যারাদোনার নৈকট্যে এসেছিলাম ১৯৯৪ সালের আমেরিকা বিশ্বকাপের সময়ে। যখন তাকে বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো তিনি বলেছিলেন যে, ওরা আসলে তার পা দুটিই কেটে নিয়েছে। তখন আমার বয়স ছিলো ২০ বছর, মাত্র বছর দুয়েক আগেই পেশাদার ফুটবলার হিসেবে আমার অভিষেক ঘটেছিলো। তখন তার বেদনা দেখে তার প্রতি আমার এক ধরণের নতুন আবেগ সৃষ্টি হয়েছিলো।

তাকে কাঁদতে দেখার সময়ে আমিও কাঁদতে চেয়েছিলাম। এটি আসলেই খুব কষ্টের অনুভূতি ছিলো, সত্যি বলতে সে কথা এখন বলে বুঝানো সম্ভব না। আমি শুধু বলতে পারি যে তখন আমি যেকোন সময়ের চেয়ে তাকে অনেক আপন মানুষ হিসেবে ভেবেছি। তিনি ছিলেন ম্যারাডোনা, ঈশ্বর কিন্তু একই সাথে একজন সাধারণ মানুষও বটে!

তার সাথে আমার এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হবে সে কথা আমি কখনোই ভাবি না। তার সাথে সামনাসামনি দেখা হবার পরে আমার একটি স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছিলো। ১৯৯৬ সালে বোকা জুনিয়রর্সের বিপক্ষে লা প্লাটার খেলার সময় তার সাথে আমার প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছিলো। আমরা দুজনেই অধিনায়ক ছিলাম বিধায় খেলার আগে মাঠের মাঝখানে একসাথে হয়েছিলাম। টসের পরে আমি সাহস করে তাকে বলেছিলাম যে, ‘খেলার পরে আপনি আপনার জার্সিটা কি আমাকে দিবেন?’

আমার কথার ধরণ তার একজন ভক্তের মতই মনে হয়েছিলো। সত্যি বলতে আমি পাগলের মত তার ভক্ত ছিলাম! খেলা শেষে তিনি আমাকে জার্সি দিয়েছিলেন। ম্যাচটি আমরা জিতেছিলাম ও আমি দুই গোল করেছিলাম। আমি পরে জার্সির লোককে তার কাছে পাঠিয়েছিলাম এবং তিনি তার জার্সিটি আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন।

কয়েকমাস পরেই ম্যারাডোনা বোকা জুনিয়রর্সের প্রেসিডেন্ট মারিসিও ম্যাকরিকে লা প্লাটা থেকে আমাকে তার ক্লাবে নিয়ে আসার কথা বলেছিলেন। ১৯৯৭ সালে আমি বোকা জুনিয়রর্সে যোগ দেয়। এটি আমার জন্য একধরণের সম্মানের মত ব্যাপার ছিলো। সে দলটি ছিলো চমৎকার একটি দল। সেখানে ম্যারাডোনা ছিলেন, ছিলেন কানিজিয়া, লাটোরে, নাভারো মনোটয়া, নেস্তর ফ্যাব্রি। কিন্তু দলটির শিরোপা খরা চলছিলো। সমর্থকরা মনে মনে বেশ ক্ষুব্ধ ছিলো। কিন্তু ম্যারাডোনা থাকায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিলো। সবকিছু তার ছায়ায় ঢাকা পড়েছিলো।

তার ক্যারিয়ারের শেষ কয়েকমাস আমি তার সাথে খেলতে পেরে নিজেকে এখনো ধন্য মনে করি। যদিও আমি আশির দশকে তার স্বর্ণালি সময়ের সাক্ষী হতে পারি নাই। সত্যি বলতে নাপোলির ম্যারাডোনা ছিলেন এক অন্য ম্যারাডোনা। কিন্তু শেষদিকেও তিনি সমীহ করার মত খেলোয়াড় ছিলেন। ট্রেনিংয়ে আসার পরে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম যে তিনি আসলে বল নিয়ে কি কি করছেন, কীভাবে বাতাসে বল ঘুরিয়ে ফ্রি-কিক নিচ্ছেন। আমার কথা অতিরঞ্জিত মনে হলেও সত্য যে, তিনি যেখানে চাইতেন সেখানেই বলটি ফেলতে পারতেন!

ম্যারাডোনা শুধুমাত্রই একজন প্রতিভাসম্পন্ন খেলোয়াড়ই ছিলেন না। তার সাথে খেললে বা তার কাছে থাকলে আপনার নিজেকে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হবে। তার সর্বশেষ ম্যাচ ছিলোটি ছিলো রিভার প্লেটের বিপক্ষে ‘সুপারক্লাসিকো’। দুর্ভাগ্যবশত প্রথমার্ধেই ইনজুরির কারণে তাকে উঠে যেতে বাধ্য হয়েছিলো কিন্তু আমি ম্যাচের জয়সূচক গোলটি করেছিলাম। তাই আমরা একইসাথে দুইটি অনুষ্ঠান উদযাপন করেছিলামঃ একটি হলো ম্যাচ জয়ের, অপরটি তার বিদায় অনুষ্ঠানের। আমরা একসাথে নেচেছি, গেয়েছি, একসাথে খেয়েছি। এমন এক মুহুর্তের সাক্ষী হওয়া যেকারও জীবনের জন্য সবচেয়ে ঘটনাবহুল একটি মুহুর্ত হিসেবে থেকে যাবে। ম্যারাডোনার সাথে এই মুহুর্ত উদযাপন আসলেই জীবনের বিশেষ একটি ঘটনা!

তার সাথে মাত্র কয়েকমাস ছিলাম। ঐ সময়টি বেশ দ্রুত চলে গিয়েছিলো। কিন্তু তারপরও আমার মনে হয় আমরা আরও বেশি উপভোগ করতে পারতাম। ম্যারাডোনা জানতেন যে তিনি অবসরের খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন কিন্তু তিনি খেলার চালিয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। তিনি দলকে সবকিছু উজাড় করে দিতেন। এমনকি অবসরের আগ আগ যখন তার শরীরে কুলাচ্ছিলো না তখনো তিনি মাঠে তার সবটুকু দিতে চেষ্টা করতেন।

যোদ্ধাদের নিয়ে বানানো সিনেমা আমি বেশ পছন্দ করি। যোদ্ধারা নিজের জন্য নয় বরং  সকলের জন্য সব প্রতিকূলতার বিপক্ষে যুদ্ধ করেন। তিনি অপরের মঙ্গলের জন্য কাজ করেন। ম্যারাডোনাকেও আমি একজন যোদ্ধার চোখেই দেখি। খেলোয়াড়া হিসেবে তিনি ছিলেন শিল্পী কিন্তু দলের একজন সতীর্থ হিসেবে তিনি ছিলেন যোদ্ধা, গ্ল্যাডিয়েটর!

ম্যারাডোনা অবসর নিয়েছিলেন কারণ তিনি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। নিজ শরীরের বিপক্ষে খেলা চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হচ্ছিলো না। তিনি তার সবটুকু মাঠে নিঙরে দিয়েছেন।

অবসরের পরে তার সাথে আমার অন্যধরণের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো। বোকা জুনিয়রর্সে আমাদের পথচলা শুরু হয়েছিলো এবং আমি খেলাবস্থায়ই তিনি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট মনোনীত হয়েছিলেন। তখনই ব্যক্তিজীবনে আমাদের পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়া শুরু হয়েছিলো। আমাদের মাঝে আবেগের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো। তিনি আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। আমার নজাতক ছেলে মারা যাবার সময়ও তিনি আমার পাশে ছিলেন। এবং যখন তিনি কঠিন সময় পার করতেন আমিও তার পাশে থাকতাম।

আমি এরপরে কখনো ভাবি নাই যে আমরা আবার একসাথে কাজ করবো। এমনকি আমি কখনো ভাবি নাই যে তারসাথে কোন বিশ্বকাপে খেলার চান্স পাবো। ১৯৯৯ সালের পর থেকে আমি আর আর্জেন্টিনার জার্সিতে খেলেনি। এবং ২০০৮ সালে আমার বামপায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাবার পরে আমি কখনো ফুটবল খেলতে পারবো কিনা তা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম। কারণ তখন আমার বয়স হয়ে গিয়েছিলো ৩৪!

কিন্তু ২০০৯ সালের শুরুতেই আমি সুস্থ হয়ে উঠি। কিন্তু তখনি ভাগ্যের কোন এক খেলে তিনি আর্জেন্টিনার কোচ হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি তখন শুধুমাত্র ইউরোপে খেলা খেলোয়াড় নয় আর্জেন্টিনার লিগে খেলা প্লেয়ারদের উপরও ভরসা করা শুরু করেছিলেন। একদিন হঠাৎ করে তিনি আমাকে দলে ডাকলেন। আমি একযুগেরও বেশি সময় ধরে আর্জেন্টিনার হয়ে কোন ম্যাচ খেলিনি কিন্তু ম্যারাডোনা আমাকে দলে ডেকেছেন!

বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব কাছে আসার সময় আমি বুঝতে পেরেছিলেম যে আমিও দলের অংশ হবো। কিন্তু আমরা বাছাইপর্ব বেশ বাজেভাবে শেষ করি এবং বিশ্বকাপে যেতে হলে আমাদের পেরুর সাথে কোয়ালিংফাইংয় ম্যাচ জিতে বিশ্বকাপ খেলতে যেতে হতে। আর্জেন্টিনায় তখন এ নিয়ে প্রচুর কথা হচ্ছিলো। বিশ্বকাপ না জেতা এক কথা কিন্তু বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ না পাওয়াটা অচিন্তনীয় ব্যাপার। আমাদের মনে হচ্ছিলো খেলার সময় কেউ আমাদের গলায় ছুড়ি ধরে বসে আছে।

পেরুর বিপক্ষের ম্যাচটি ছিলো বুয়েন্স আয়ার্সে। তখন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিলো এবং চারপাশে থমথমে আবহাওয়া বিরাজ করছিলো। খেলার শুরুতে আমরা গোল করেছিলাম এবং ১-০ গোলেই আমরা ম্যাচটি জিততে চলছিলাম কিন্তু শেষ বাঁশি বাজার একটু আগেই পেরু সমতাসূচক একটি গোল করলে কেলেঙ্কারি ঘটে যায়। আমরা তখন শেষ, সবাই তখন খেলা শেষ বলেও ধরে নিয়েছিলো! অনেক দর্শক রাগে গরগর করে বিরক্ত হয়ে মাঠ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো। ম্যারাডোনার একজন ফুরিয়ে যাওয়া বয়ষ্ক স্ট্রাইকারকে দলে নেয়ায় তার খেলার ধরণের জন্য সাংবাদিকদের কাছে সমালোচিত হচ্ছিলেন। এই ম্যাচ হারলে তাকে তুলোধুনো করা হবে।

তবে অতিরিক্ত সময়ে আমরা একটি কর্ণার পেয়েছিলাম। বলটি বক্সের ভেতর কোনক্রমে আমার সামনে এসেই পড়েছিলো এবং আমি বলটিকে জালে পাঠাই! গোলের পরপরই বৃষ্টির ভেতর আমি পাগলের মত দৌড়াতে থাকি এবং দলের সবাই আমার পেছনে দৌড়াতে থাকে। গ্যালারিতে সবাই আনন্দে ফেটে পড়েছিলো। ম্যারাডোনা দৌড়ে এসে মাঠে ঝাপ দিয়ে ঘাসের সাথে বুক লাগিয়ে স্লাইড করা শুরু করলো। সে অন্যরকম এক মুহুর্ত। অন্যরকম একটি রাত!

আমি মনে মনে ভাবি যে আমার জীবন যদি একটি সিনেমা হতো তাহলে তার শুরুর দৃশ্য হতো শৈশবে প্রথম আমার ফুটবলে লাথি দেবার মুহুর্তটা এবং শেষ দৃশ্য হতো বৃষ্টির ভেতরে এই গোল উদযাপনের মুহুর্তটি।

এই গোলটি বেশকিছু জিনিসকে আরও মজবুত করেছিলো। যেমন, ম্যারাডোনারর সাথে আমার বন্ধুত্ব এবং তিনি আমার উপর যে বিশ্বাস রেখেছিলেন সেটি। একটি কথা বলা উচিত যে ১৯৮৬ বিশ্বকাপেও আর্জেন্টিনা পেরুর বিপক্ষে এমন একটি লোমহর্ষক ম্যাচে শেষ মুহুর্তে গোল করে বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছিলো।

এটি কি কেবলই একটি কাকতালীয় ঘটনা। আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি এর মধ্যে অবশ্যই সম্পর্ক আছে। জয়সূচক এমন একটি গোল করলে আপনি মনে মনে মূল বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখেবন। ম্যারাডোনা তখন বিশ্বকাপের চূড়ান্ত দল নির্বাচন করছেন এবং আমার মাঝে কয়েকমাস ধরেই একধরণের অনিশ্চয়তার জন্ম হয়েছিলো। তিনি আমাকে দলে রাখবেন কিনা সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই নেই। তিনি যখনতখন ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন যে আমি কি করছি। পরে দল ঘোষণার আগে তিনি আমাকে ফোন দিয়ে  বললেন, ‘মার্টিন, সোমবারে আমার সাথে দেখা করো। তুমি বিশ্বকাপ দলে আছো।’

সেই ফোনের কথা আমার এখনো হুবহু মনে আছে। আমার মনে হয় এটি তো এই সেদিনের ঘটনা! তখন আমার তাকে কৃতজ্ঞতা দেয়া ছাড়া আর কোন কিছুই করার ছিলো না, ‘আমাকে এই সুযোগ দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।’

আমি তাকে যেমন ধন্যবাদ দিয়েছিলাম তিনিও পেরুর বিপক্ষে গোল করার পরে আমাকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন।

আমি জানতাম যে আমি দলের মূল একাদশে থাকতে পারবো না। দক্ষিণ আফ্রিকায় যাবার সময় আমার বয়স হয়েছিলো ৩৬ এবং আমাদের মেসি ও তেভেজের মতো খেলোয়াড় ছিলো। তাই তার সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান করি। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ড আগেই নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় গ্রুপের পর্বের শেষ ম্যাচে গ্রীসের বিপক্ষে আমাকে দশ মিনিটের জন্য মাঠে নামিয়েছিলেন। এটি ছিলো বিশ্বকাপে আমার জীবনের প্রথম ম্যাচ এবং আমি গোল করেছিলাম। গ্যালারিতে আমার পরিবারের সবাই ছিলোঃ আমার বড় ভাই, বড় ছেলে ও আমার স্ত্রী। বিশ্বকাপে আমার একমাত্র গোল আমার পরিবারের সবাই মাঠে বসে দেখেছে। এটি ছিলো আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা। আমার মনে হয়েছিলো যে এতে করে আমার জীবন হয়তো আমি পুরোপুরি স্বার্থক করতে পেরেছি।

ম্যারাডোনার জন্য খেলা এক ধরণের অন্যরকম অভিজ্ঞতা ছিলো। তিনি যেভাবে আমাদের প্রতিনিধিত্ব করতেন, যেভাবে আমাদের স্বপ্ন দেখাতেন, সেগুলো ছিলো প্রবল পরাক্রশালী। এগুলো খেলার কৌশলের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। তিনি আপনাকে আত্মবিশ্বাস দিয়ে পরিপূর্ণ করে তুলবে। শেষ ষোলতে যাবার পরে আমরা সত্যিই ভেবেছিলাম যে আমরা হয়তো বিশ্বকাপটা জিতবো। কারণ ম্যারাডোনার সাথে থাকলে এমন মনে হবেই। তিনি খেলোয়াড় হিসেবেও বিশ্বকাপ জিতেছেন। শুধু কোচ হিসেবে তার এটি জেতা বাকি ছিলো এবং আমাদের সাথে তিনি এর দ্বারপ্রান্তে ছিলেন। তাই এমন ভাবা দোষের কিছু না। তখন নিয়তি হিসেবে শুধু একেই দেখতে পাওয়া যায়।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ঐ বিশ্বকাপের ব্যর্থতা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় হতাশাগুলোর একটি। আমার নিজের জীবন ও ম্যারাডোনার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক দুটো মিলিয়েই এই হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।

জাতীয় দলের ঐ সময়ের মুহুর্তগুলো আমাকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায়। আসলে আমার মনে করার কিছু কারণও আছে। ম্যারাডোনা সবসময় চকচকে কানের দুল পড়তেন এবং মনে হতো যে তিনি তারা আশপাশ দুলের আলোয় আলোকিত করে রাখেন। একটি ম্যাচের আগেরদিন তাই আমি তাকে বলেছিলাম, ‘আগামীকাল আমি গোল করতে পারলে আপনি আমাকে আপনার কানের দুলটা দিবেন।’

সত্যি বলতে আমি কথাটি কেবল মজা করার জন্যই বলেছিলাম কিন্তু পরদিন গোল করার পরে তিনি সত্যি সত্যি সেটি আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন!

সেই দুলটি আমার কাছে এখনো আছে। আমি এটি গুপ্তধনের মত সযত্নে গোপন একজায়গায় রেখে দিয়েছি।

বিশ্বকাপের পরে দিয়াগোর জীবনে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। মানুষকে বুঝতে হবে যে একজন পেশাদার খেলোয়াড় বা কোচ হওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এবং ম্যারাডোনার জন্য তা আরও বেশি কষ্টকর। তিনি যখনই একজন সাধারণ মানুষ হতে চেষ্ঠা করেছেন, তার চেষ্টা ভেস্তে গিয়েছে। মানুষ দিনরাত ২৪ ঘন্টা তার পেছনে লেগে থাকতো, তাকে পূজা করতো, হয়রানি করতো ও তার মনে আঘাত দিতো। তিনি শান্তিতে একটু রাস্তায়ও বের হতে পারতেন না। এভাবে চললে আপনি কীভাবে সাধারণভাবে জীবন করতে পারবেন?

যদি আমি সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম তবে আমি অতীতে গিয়ে তার জীবনের শেষ সময়গুলোতে তাকে সাহায্য করার সর্বাত্মক চেষ্টা করতাম। আমি তাকে কিছুটা স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসতে চেষ্টা করতাম। আমি তাকে বৃদ্ধ হতে দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সাহায্য করা বেশ কঠিন এবং অনেকেই চেষ্টা করেছেন। তার আসলে কি হয়েছিলো তা জানা মুশকিল। তার শেষ দুবছর তিনি যেভাবে কাটিয়েছেন আমার তা একদম পছন্দ হয় নাই। তিনি মানসিক ও শারীরিক দুদিক দিয়েই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। যে ম্যারাডোনাকে আমি দেখতে চাইতাম তিনি তা ছিলেন না।

সবচেয়ে অনুতাপের কথা হচ্ছে যে তিনি সম্পূর্ণ একা ছিলেন। তাকে সেভাবে দেখভাল করা হয়নি। তিনি যে জীবনের যোগ্য সে জীবন তিনি পান নি।

আমি তাকে নিয়ে কখনোই সমালোচনা করবো। আমরা সবাই জানি যে তিনি কিছু ভুল করেছিলেন  কিন্তু তিনি তারমত জীবন কাটাচ্ছিলেন। আমি শুধু জানি তিনি আমার কে ছিলেন এবং তিনি আমাকে কি দিয়েছেন। তার গুরুত্ব আসলে বলে বোঝানো যাবে না, বিশেষকরে ফুটবল জগতে তার গুরুত্ব। যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন এবং আমি বিশ্বাস করি তিনি ম্যারাডোনাকে ফুটবলের ঈশ্বর ভাবেন। ঈশ্বর যেমন তার সৃষ্টির মাঝে বিরাজ করেন। আমার কাছে ম্যারাডনা ফুটবল জগতে এই কাজই করেন।

এক সময় আমি হয়তো মেনে নিবো যে তিনি আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন, যেমন আমি আমার বাচ্চার মৃত্যু মেনে নিয়েছিলাম। আমি জানি না যে আমি কখন বাস্তবতার মুখোমুখি হবো। আমাকে মেনে নিতে হবে যে তিনি আমাদের মাঝে আর নেই, আমি তাকে আর কখনোই আমার সামনে দেখতে পাবো না। কিন্তু এটি মেনে নেয়া খুব বেদনাদায়ক, পরাবাস্তব একটি ব্যাপার।

আমার কাছে ম্যারাডোনা এখনো বেঁচে আছেন। ঈশ্বর এখনো বেঁচে আছেন এবং সবসময় আমাদের মাঝে থাকবেন।

– প্লেয়ার্স ট্রিবিউন অবলম্বনে

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...