অজি বোলিংয়ের নীরব নেতা

প্যাট কামিন্স কিংবা জোফরা আর্চারের গতি নেই তাঁর বোলিংয়ে। নেই শাহীন আফ্রিদি কিংবা ট্রেন্ট বোল্টের সুইং। হ্যাজলউডের ক্যারিয়ারের মূলমন্ত্র একটানা ভাল জায়গায় বল করে যাওয়া। সাদাসিধে এক অ্যাকশনে প্রতিপক্ষের ব্যাটারদের ভুল করতে বাধ্য করেছেন। অ্যাকশনের পাশাপাশি বোলিংয়ের ধরনেও কি দারুণ মিল গ্লেন ম্যাকগ্রার সাথে!

প্যাট কামিন্সের গতি কিংবা মিচেল স্টার্কের দুর্ধর্ষ ইয়র্কার তাঁর বোলিংয়ে খুঁজে পাবেন না আপনি। তারকা খ্যাতিতেও ভীষণ পিছিয়ে। অথচ নিজের কাজে তিনি দক্ষ। মুনির ন্যায় ধ্যানমগ্ন মনে একটানা একই লাইন লেংথে বল করে যান। গ্লেন ম্যাকগ্রার অভাবটা মোটেও বুঝতে দেননি অজিদের। শুরুতে টেস্টের বোলার হিসেবে আবির্ভাব হলেও ক্রমেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সাদা বলের ক্রিকেটে। তিনি জশ হ্যাজলউড, অজি বোলিংয়ের নেতা। 

ট্রেভর এবং অ্যান হ্যাজলউড দম্পতির বসবাস নিউ সাউথ ওয়েলসের ছোট গ্রাম বেন্ডেমিরে। কাছের বড় শহর বলতে ৪০ কিমি উত্তরের ট্যামওর্থ। ছিমছাম ছবির মতো সুন্দর সেই শহরেই জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এই দম্পতির ছোট ছেলে জশ হ্যাজলউডের। সবার ছোট জশকে নিয়ে বাড়ির সবার আনন্দের শেষ নেই। বাড়ির উঠানে বড় ভাই এবং বাবার সাথে ক্রিকেট খেলতে খেলতেই বেড়ে ওঠা তাঁর। 

ডানহাতি পেসার জশ মাত্র ১৭ বছর বয়সেই রাজ্য দলের হয়ে অভিষিক্ত গড়েন দারুণ এক রেকর্ড। তাঁর চেয়ে কম বয়সে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে খেলার সুযোগ পাননি আর কেউই। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট পাড়ায় রীতিমতো হইচই পড়ে যায় তাঁকে নিয়ে। দেশের হয়ে অনুর্ধব-১৯ বিশ্বকাপেও অংশ নেন তিনি। ২০০৮ সালের সেই ছোটদের বিশ্বকাপের দলেও সবার ছোট তিনিই।

ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে ভাল খেলার সুবাদে ডাক পেয়ে যান জাতীয় দলেও। যদিও ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচটা ভাল কাটেনি। এক দিনের সেই ম্যাচে সাত ওভারে ৪১ রান দিয়ে তুলে নেন মোটে এক উইকেট। টি-টোয়েন্টি অভিষেকটাও মন মত হয়নি, ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে চার ওভারে হজম করেন ৩৬ রান। 

ভাগ্যের কি অমোঘ লীলাখেলা! পরবর্তী এক দশক তিনি রাজত্ব করবেন যেই ফরম্যাটে, সেই টেস্টেই কিনা তাঁর অভিষেক হয় পরে। ব্রিসবেনে ভারতের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসেই শিকার করেন পাঁচ উইকেট। মূলত এই ম্যাচের সুবাদেই ২০১৫ বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত দলে জায়গা পেয়ে যান হ্যাজলউড। 

বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে প্রথম বারের মত গোটা বিশ্ববাসীর নজরে আসেন তিনি। সেদিন তাঁর বিধ্বংসী বোলিংয়ের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি পাকিস্তানি ব্যাটাররা। চার উইকেট তুলে নিয়ে গুঁড়িয়ে দেন পাকিস্তানের ব্যাটিং মেরুদন্ড। এরপর তো মেলবোর্নের ফাইনাল জিতে বনে যান বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য। 

সাদা বলের ক্রিকেটে মানিয়ে নিতে সমস্যা হলেও লাল বলের ক্রিকেটে পারফর্ম করেছেন সমানতালে। কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ইনজুরি বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বারবার। প্রতিবারই তিনি ফিরে এসেছেন প্রবলভাবে। মাত্র ১২ টেস্টেই পেরিয়ে যান ৫০ উইকেটের মাইলফলক। শেন ওয়ার্ন, গ্লেন ম্যাকগ্রা, মিচেল জনসনের মতো বোলাররাও এই তালিকায় তাঁর চেয়ে পিছিয়ে আছেন। ২০১৯ সালে স্বপ্নের মত এক অ্যাশেজ কাটান ডানহাতি এই পেসার। চার টেস্ট খেলেই তুলে নেন ২০ উইকেট। 

২০১৭ সালের পর থেকে সাদা বলের ক্রিকেটে উত্থান ঘটে হ্যাজলউডের। সেবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নয় উইকেট নিয়ে নির্বাচিত হন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। প্রথম বারের মত উঠে আসেন আইসিসি বোলিং র‍্যাংকিংয়ের এক নম্বরে। 

তবে হ্যাজলউড তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা কাটান ২০২১ সালে। বছরের শুরুতেই আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে জিতে নেন শিরোপা। পাওয়ার প্লে কিংবা ডেথ ওভারে দুই জায়গাতেই বল হাতে ছিলেন সমান উজ্জ্বল। অস্ট্রেলিয়ার ট্রফি ক্যাবিনেটের একমাত্র মিসিং ট্রফি – টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপাও জিতেছেন সেই বছরেই।

আরব আমিরাতের মরা পিচে যেন আগুন ঝরিয়েছেন, তাঁর বোলিংয়ের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি কোনো ব্যাটার। সতীর্থ প্যাট কামিন্স এবং মিচেল স্টার্কদের ছাপিয়ে বনে যান অজি বোলিং লাইন আপের নেতা। তাঁর উপর ভর করেই নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথম বারের মত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় অস্ট্রেলিয়া। ইতিহাসের প্রথম বোলার হিসেবে তিনি টেস্ট, ওডিয়াই এবং টি-টোয়েন্টি তিন ফরম্যাটেই একসাথে ছিলেন আইসিসি বোলিং র‍্যাংকিংয়ের সেরা দশে। 

প্যাট কামিন্স কিংবা জোফরা আর্চারের গতি নেই তাঁর বোলিংয়ে। নেই শাহীন আফ্রিদি কিংবা ট্রেন্ট বোল্টের সুইং। হ্যাজলউডের ক্যারিয়ারের মূলমন্ত্র একটানা ভাল জায়গায় বল করে যাওয়া। সাদাসিধে এক অ্যাকশনে প্রতিপক্ষের ব্যাটারদের ভুল করতে বাধ্য করেছেন। অ্যাকশনের পাশাপাশি বোলিংয়ের ধরণেও কি দারুণ মিল গ্লেন ম্যাকগ্রার সাথে!

সতীর্থ প্যাট কামিন্স এবং মিচেল স্টার্ককে নিয়ে গড়ে তুলেছেন সময়ের সেরা বোলিং ট্রায়ো। এখনো পর্যন্ত ৫৯ টেস্ট ম্যাচ খেলে তাঁর শিকার ২২২ উইকেট। অন্যদিকে, ৬৯ ওডিয়াইতে ১০৮ উইকেটের পাশাপাশি ৪১ টি-টোয়েন্টিতে নিয়েছেন ৫৮ উইকেট। ইকোনমিটাও ঈর্ষণীয়, মাত্র ৭.৬৮! 

অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট পাড়ায় একটা কথা প্রচলিত আছে হ্যাজলউড ভাল করলে ম্যাচ জিতে অস্ট্রেলিয়া। প্রচারের আলোয় না এসেও তাই নিয়মিত ভাল খেলে যান হ্যাজলউড, অজিরাও মেতে ওঠে ম্যাচ জয়ের আনন্দে।  

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...