বিস্ময়কর রোমাঞ্চের বিশ্বকাপ

বৈশ্বিক আসরে এর আগে কখনোই এতগুলো আপসেটের সাক্ষী হয়নি ক্রিকেট। অস্ট্রেলিয়াতে হওয়া এবারের বিশ্বকাপটি ছিল ছোট দল গুলোর জন্য উত্থানের এক বিরাট মঞ্চ। তবে সেই উত্থানের পাশাপাশি এ বিশ্বকাপে দেখা মিলেছে বহু রোমাঞ্চকর মুহূর্তের। সেখানে হাসি ছিল, কান্না ছিল, আবেগীয় মুহূর্তের দৃশ্যায়নও ছিল।

জিলংয়ে প্রারম্ভিকা, আর মেলবোর্নে ক্রান্তিলগ্নের মঞ্চায়ন। মাঝখানে প্রায় এক মাস জুড়ে চলতে থাকল ক্রিকেটীয় এক মহাযজ্ঞ। আর সেই মহাযজ্ঞ শেষে চ্যাম্পিয়নের আসনে বসলো ইংল্যান্ড। নতুন কোনো চ্যাম্পিয়ন পায়নি ক্রিকেট ঠিকই, কিন্তু এবারে আসর বিশ্ব ক্রিকেটের জন্য একটা বার্তা হয়ে থাকল।

কারণ বৈশ্বিক আসরে এর আগে কখনোই এতগুলো আপসেটের সাক্ষী হয়নি ক্রিকেট। অস্ট্রেলিয়াতে হওয়া এবারের বিশ্বকাপটি ছিল ছোট দল গুলোর জন্য উত্থানের এক বিরাট মঞ্চ। তবে সেই উত্থানের পাশাপাশি এ বিশ্বকাপে দেখা মিলেছে বহু রোমাঞ্চকর মুহূর্তের। সেখানে হাসি ছিল, কান্না ছিল, আবেগীয় মুহূর্তের দৃশ্যায়নও ছিল। ঘটনাবহুল এ বিশ্বকাপের সেরা পাঁচ মুহূর্ত নিয়েই খেলা ৭১ এর আজকের আয়োজন। চলুন দেখে নেওয়া যাক। 

  • বাটলার-হেলস ধ্বংসলীলা

আগেই পাকিস্তানের ফাইনাল নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। তাই আরেক সেমিফাইনালে ভারত-ইংল্যান্ড মুখোমুখি হওয়ায় ভারত-পাকিস্তান ফাইনালেই চোখ ছিল উপমহাদেশের দর্শকদের। কিন্তু সে আশা, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষার পথে গুড়ে-বালি। ভারতের দেওয়া ১৬৯ রানের লক্ষ্য ইংলিশরা পৌঁছে যায় মাত্র ১৬ ওভারেই। ম্যাচ জয় পর্যন্ত ঠিক ছিল। 

কিন্তু এ দিনে ভারতের বোলাররা মিলে ইংলিশদের একটি উইকেটও তুলে নিতে পারেনি। ম্যাচটি তাঁরা হেরে যায় ১০ উইকেটে। বাটলার-হেলসের তাণ্ডবে রীতিমত সেদিন দিশেহারা হয়ে পড়ে শামি, ভূবিরা। ওপেনিংয়ে নিরবিচ্ছিন্ন ১৭০ রানের জুটিতে হেলস করেন ৮৬ আর অধিনায়ক বাটলার খেলেন ৮০ রানের ইনিংস।

  • আইরিশ রূপকথার প্রত্যাবর্তন

বড় আসরে এসেই আপসেট ঘটানোর দিক দিয়ে আয়ারল্যান্ডের নামই সবার আগে আসে। কিন্তু শেষ ক’বছরে আইসিসি’র বেশ কিছু নিয়মের গ্যাঁড়াকলে আইরিশরা ঠিক মত খেলার সুযোগই পাচ্ছিল না। বাছাই পর্বের বেড়াজালে ২০১৯ বিশ্বকাপই তাদের খেলা হয়েছিল না।

আর গত বারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তারা গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়েছিল। তবে অস্ট্রেলিয়ায় হওয়া এবারের বিশ্বকাপে আবারও স্বরূপে ফিরেছিল আয়ারল্যান্ড। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে পরাজয় দিয়ে শুরু করেছিল ঠিকই।

কিন্তু এরপরেই চমক দেখাতে শুরু করে এ দলটা। সুপার টুয়েলভে ওঠার লড়াইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাতেই হত তাদের। আর এমন ডু অর ডাই পরিস্থিতিতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাঁরা হারিয়ে দেয়। আইরিশদের কাছে হেরে গ্রুপ পর্বেই থেমে যায় ক্যারিবিয়ানদের বিশ্বকাপ যাত্রা।

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর পর সুপার টুয়েলভে এসেও চমক দেখায় আয়ারল্যান্ড। এবারের বিশ্বকাপজয়ী দল ইংল্যান্ড যে একটি ম্যাচ হেরেছিল তা হচ্ছে এই আইরিশদের বিপক্ষে। যদিও সে ম্যাচে আইরিশরা বৃষ্টিরও কিছুটা সহায়তা পেয়েছিল।

আয়ারল্যান্ডের দেওয়া ১৫৮ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমেই খেই হারিয়ে ফেলেছিল ইংলিশ ব্যাটাররা। তবে মঈন আলীর ব্যাটে এগিয়ে যাচ্ছিল তাঁরা। কিন্তু দলীয় স্কোর ১০৫/৫ থাকা অবস্থায় বাগড়া দেয় বৃষ্টি। ডাকওয়ার্থ লুইস মেথডে আয়ারল্যান্ডের তখন রান ছিল ১১০। তাই বৃষ্টির কারণে পরবর্তীতে খেলা মাঠে না গড়ানোতে জয়টা আসে আয়ারল্যান্ডেরই। 

  • অস্ট্রেলিয়ার ভরাডুবি 

আগের বারের চ্যাম্পিয়ন। খেলাটাও নিজের মাঠে। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের জন্য পথটা তাই অনুকূলেই ছিল। কিন্তু নিজেদের প্রথম ম্যাচেই নিউজিল্যান্ডের কাছে ৮৯ রানে হেরে ব্যাকফুটে চলে যায় অজিরা। এর উপর বৃষ্টির কারণে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের ম্যাচটি পরিত্যাক্ত হয়। সব মিলিয়ে নিজেদের মাটিতেই ভরাডুবি হয় অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ মিশন। রান রেটের মারপ্যাঁচে সুপার-১২ তেই আটকে যায় অ্যারন ফিঞ্চের দল। 

  • ডাচ রূপকথার রূপায়ন

সুপার-১২ এর শেষ দিন। সমীকরণ একদম স্পষ্ট। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জিতলেই দক্ষিণ আফ্রিকা সেমিফাইনালে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষ ডাচরা। তার উপর ডিক কক, রুশো, মিলারদের নিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ ব্যাটিং লাইন আপ। সেই সাথে নর্কিয়া, রাবাদের নিয়ে দুর্ধর্ষ বোলিং আক্রমণ। প্রোটিয়ারা তাই সেমির পথে এক পা দিয়েই রেখেছিল। তবে মাঠের ক্রিকেটে এসে অন্য এক নেদারল্যান্ডসকে দেখে ক্রিকেট। প্রথমে ব্যাটিং করতে নেমে ১৫৮ রানের পুঁজি পায় তাঁরা। 

আর ঐ সংগ্রহ নিয়েই প্রোটিয়া ব্যাটারদের উপর চড়াও হতে শুরু করেন ফ্রেড ক্লাসেন আর বাস ডি লিড। তাদের বোলিং তোপে রীতিমত খেই হারিয়ে ফেলে দক্ষিণ আফ্রিকার টপ অর্ডার। তারপরও প্রোটিয়াদের ব্যাটিং গভীরতা ছিল যথেষ্ঠ। মার্করাম, মিলারদের কাঁধে চেপে কোনো ভাবে ডাচ বাঁধা টপকে যাবে, এমনটাই অনেকের আশা ছিল।

কিন্তু, দিন শেষে জয়টা আসে নেদারল্যান্ডসেরই। প্রোটিয়ারা হেরে যায় ১৩ রানে। আর দক্ষিণ আফ্রিকার এমন হারের পরে অপ্রত্যাশিতভাবে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের জন্য সেমির রাস্তা খুলে যায়। বাংলাদেশকে হারিয়ে শেষ পর্যন্ত সেমিফাইনালে ওঠে পাকিস্তান। 

  • বিরাট কোহলি কাব্য

এবারের আসরে সেমিতেই নিজেদের বিশ্বকাপ যাত্রা শেষ হয়ে যায় ভারতের। সেমিতে গেলেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাজে হারে সমালোচনাই বেশি ধেয়ে এসেছে রোহিতদের উপর। তবে এর মাঝে ব্যতিক্রম বিরাট কোহলি। দলগত ব্যর্থতার মাঝেও তিনি ছিলেন উজ্জ্বল।

টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ রানের পাশাপাশি ৬ ম্যাচের ৪ টিতেই হাঁকিয়েছেন ফিফটি। এর মধ্যে পাকিস্তানের বিপক্ষে তাঁর খেলা ৮২ রানের ইনিংসটি নিয়ে কথা হয়েছে অনেকদিন। অনেকের মতে, এটাই বিরাট কোহলির ক্যারিয়ারে সেরা টি-টোয়েন্টি ইনিংস। 

পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ বলেই কিনা, বিরাটের কাছেও এ ইনিংসটির গুরুত্ব ছিল অনেক। তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী, এ ইনিংসটিকে বিশ্বের অন্যতম একটা সেরা ইনিংসই বলা যায়। কারণ ম্যাচটা ভারতের কাছ থেকে প্রায় ফসকেই গিয়েছিল। ম্যাচের এক পর্যায়ে ৮ বলে ২৮ রানের প্রয়োজন ছিল ভারতের। আর সেই সমীকরণেই বিরাট কোহলি হারিস রউফের করা শেষ দুই বলে মারেন দুই ছক্কা। এমনকি শেষ ওভারে গিয়ে ভারতের জয়ের ভিত্তিটাও তিনিই গড়ে দেন।

মেলবোর্নের ৯০ হাজার দর্শকের সামনে তাই বিরাটের এ ইনিংসটি সত্যিকার অর্থেই ছিল অন্যরকম। এ ছাড়া, এ বিশ্বকাপেই বিরাট টপকে গিয়েছেন মাহেলা জয়াবর্ধনের ১০১৬ রানের রেকর্ডটিকে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এখন সর্বোচ্চ রানের মালিক কোহলি। একই সাথে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত চার হাজার রান করা একমাত্র ব্যাটারও তিনিই।       

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...