আজিঙ্কা ‘স্পেশাল’ রাহানে

শুরুটা ছিল একাদশ বাছাই থেকে। একাদশে চার পরিবর্তনের তিনটি একরকম অনুমিতই ছিল। বিরাট কোহলির জায়গায় লোকেশ রাহুল ফিরবেন বলেই নিশ্চিত ছিলেন অনেকে। বিশেষ করে ‘৩৬’ বিপর্যয়ের পর স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান কমানোর কথা চিন্তাও করার কথা নয় বেশির ভাগ অধিনায়কের। কিন্তু কোহলির জায়গায় রাহানে নিলেন রবীন্দ্র জাদেজাকে। একজন অলরাউন্ডার, বাড়তি একজন বোলার নিয়ে রাহানে শক্ত বার্তাটি দিলেন। পাল্টা আক্রমণের ঘোষণা, যেখানে মিশে থাকল, অ্যাডিলেডে ব্যাটিং ধসে পড়লেও তাদের মনোবল নুয়ে পড়েনি।

  • ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে তিন টেস্টে নেতৃত্ব, তিনটিতেই জয়
  • ক্যারিয়ারে ১২ টেস্ট সেঞ্চুরি, একটিতেও হার নয়, নয়টিতে জয়, তিন ড্র
  • দেশের বাইরে ৮ সেঞ্চুরি, পাঁচটিতেই জয়

ভারতের মেলবোর্ন জয় অনেক দিক থেকেই অসাধারণ।

ভারতীয় ক্রিকেটের তো বটেই, টেস্ট ইতিহাসেই ধ্বংসস্তুপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর আখ্যানগুলোয় রোমাঞ্চকর আরেকটি সংযোজন হয়ে থাকবে এটি। প্রচণ্ড মানসিক শক্তি, চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা, দুর্দান্ত স্কিল আর মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রবল তাড়না ফুটে উঠেছে ভারতের পারফরম্যান্সে।

তবে শুরুতে রাহানের কথা বলেছি, কারণ এই জয় রাহানেময়। ভারতের বোলাররা দারুণ করেছে, পরিকল্পনার বাস্তবায়ন যথেষ্ট ভালো হয়েছে, অস্ট্রেলিয়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্যাচ ছেড়েছে ও বাজে ব্যাটি করেছে। তার পরও সব ছাপিয়ে ভারতের এই জয়ের মোড়ে মোড়ে সব ছাপিয়ে রাহানের ছাপ বেশি ফুটে ওঠে।

শুরুটা ছিল একাদশ বাছাই থেকে। একাদশে চার পরিবর্তনের তিনটি একরকম অনুমিতই ছিল। বিরাট কোহলির জায়গায় লোকেশ রাহুল ফিরবেন বলেই নিশ্চিত ছিলেন অনেকে। বিশেষ করে ‘৩৬’ বিপর্যয়ের পর স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান কমানোর কথা চিন্তাও করার কথা নয় বেশির ভাগ অধিনায়কের। কিন্তু কোহলির জায়গায় রাহানে নিলেন রবীন্দ্র জাদেজাকে। একজন অলরাউন্ডার, বাড়তি একজন বোলার নিয়ে রাহানে শক্ত বার্তাটি দিলেন। পাল্টা আক্রমণের ঘোষণা, যেখানে মিশে থাকল, অ্যাডিলেডে ব্যাটিং ধসে পড়লেও তাদের মনোবল নুয়ে পড়েনি।

টসে হারা, আমার মতে, ভারতের জন্য ভালোই হয়েছে। টস জিতলেই আগে ব্যাটিং করতে হতো, ‘৩৬’ তখন ধাওয়া করতে পারত মন-মস্তিষ্কের কোনো কোনো কোণে। সেটি করতে না হওয়ায় সম্ভাব্য শঙ্কার থাবা এড়ানো গেছে। বোলিং-ফিল্ডিংয়ে শুরু থেকেই যে প্রাণশক্তি, উজ্জীবিত-উদ্দীপ্ত ভারতকে দেখা গেছে, নেতা রাহানের প্রেরণাদায়ী ভূমিকার প্রকাশ সেসবে।

৩৬ রানে গুটিয়ে যাওয়া দল যখন কয়েকদিন পরই বিরাট কোহলি, ইশান্ত শর্মা, মোহাম্মদ শামিকে ছাড়া মাঠে নেমেই প্রতিপক্ষকে এমন গুঁড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে মাঠে নামে, মাঝপেথ উমেশ যাদবকে হারানোর পরও শরীরী ভাষায় সেটা বোঝা যায়না খুব একটা, তখন অধিনায়ককে বড় কৃতিত্ব দিতেই হয়।

জাসপ্রিত বুমরাহ, রবিচন্দ্রন অশ্বিনদের স্কিলফুল বোলিং তো ছিলই। অভিষেকে নিজেকে উজার করে বোলিং করেছেন মোহাম্মদ সিরাজ। বিশেষ করে অশ্বিন, এর আগে অস্ট্রেলিয়ায় তার রেকর্ড বিবর্ণ হলেও এবার তার এতটাই আনন্দদায়ী, অফ স্পিনার হয়েও স্কিলের বৈচিত্রে কোনো রোমাঞ্চকর লেগ স্পিনারের মতোই যেন মেটাচ্ছেন মনের খোরাক।

যথারীতি ব্যাটে-বলে জাদেজার অবদান মহামূল্য। গত দুই-আড়াই বছরে জাদেজার ব্যাটিং ফর্ম ভারতের জন্য বড় আশীর্বাদ। ২০১৮ সালের ইংল্যান্ড সফরে টেস্ট একাদশে ফেরার পর থেকে এই টেস্ট পর্যন্ত ১৪ টেস্টে জাদেজার ব্যাটি গড় ৫৬.১৫, ভাবা যায়! তার ক্যারিয়ার ব্যাটিং গড় ৩৫-এর বেশি, বোলিং গড় ২৫-এর কম। টেস্ট ইতিহাসেই এটি বিরল নমুনা। নিয়মিত অলরাউন্ডারদের মধ্যে কেবল ইমরান খান আর কিথ মিলারের পরিসংখ্যান এতটা উজ্জ্বল।

যেটা বলছিলাম, ব্যক্তিগত পারফরমান্সের পসরা ছিল। সেই সুযোগটা করে দিয়েছিলেন অধিনায়ক রাহানে। সতীর্থদের চাঙা রাখা, বোলিং পরিবর্তন, মাঠ সাজানো, ব্যাটসম্যান ভেদে আলাদা পরিকল্পনা, সবকিছুতে ছিল নেতা রাহানের প্রকাশ। এই যুগে অবশ্য সব দলেই অ্যানালিস্টরা অধিনায়কের কাজ অনেক সহজ করে দেন। তবু মাঠে গিয়ে প্রতিমুহূর্তের সিদ্ধান্ত, চাপের সময়গুলোয় ভড়কে না যাওয়া, এসব তো অধিনায়ককে করতে হয় তাৎক্ষনিক।

সঙ্গে নিজের সেঞ্চুরি, দলের ইনিংসের মেরুদণ্ড হয়ে থাকা, টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথমবার রান আউট হওয়ার পর একটুও বিরক্তি না দেখিয়ে উইকেটে সঙ্গী জাদেজার সঙ্গে ফিস্ট বাম্প ও তাকে হাত চাপড়ে সাহস দিয়ে আসা, আচরণে স্থিতধি কিন্তু ধরনে আগ্রাসী নেতৃত্ব,  মাঠে প্রতিটি পদক্ষেপে কতৃত্ব আর ব্যক্তিত্ব, সব মিলিয়ে দলের কোনো জয়ে অধিনায়কের এতটা ছাপ, নিটক অতীতে কবে দেখেছি, মনে পড়ে না।

অস্ট্রেলিয়ায় এটি ভারতের সেরা জয় কিনা, সেটি নিয়ে অবশ্য আমি খানিকটা ধন্দে আছি।

২০০৩ সালের অ্যাডিলেইড টেস্ট জয় ও রাহুল দ্রাবিড়ের ধ্রুপদি পারফরম্যান্সের (২৩৩ ও ৭২*) একটা আলাদা জায়গা ভারতীয় ক্রিকেটে সবসময়ই থাকবে। প্রায় ২৩ বছর পর তারা অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট জিতেছিল, সেটাও স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে। তবে সেই ম্যাচে ম্যাকগ্রা, ব্রেট লি, ওয়ার্ন ছিলেন না।

পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতার প্রতিকূলতার দিক থেকে ২০০৮ সালের পার্থের জয়কে এবারের জয়ের পাশে রাখা যায়। ২-০তে পিছিয়ে থাকার পর, সিডনিতে মাঙ্কিগেট নিয়ে তুমুল হইচই, হরভজন সিংকে নিষিদ্ধ করা, পরে তুলে নেওয়া, ভারতের দেশে ফিরে যাওয়ার হুমকি, দুই দেশের ক্রিকেটীয় ও কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন, সব মিলিয়ে বিতর্কের প্রবল স্রোতের পর পার্থ টেস্ট, বাউন্সি উইকেটে অস্ট্রেলিয়ার চার পেসার লি-জনসন-টেইট-স্টুয়ার্ট ক্লার্ককে সামলে অনিল কুম্বলের প্রেরণাদায়ী নেতৃত্বে পাওয়া জয়কে এবারের জয়ের চেয়ে এগিয়ে রাখতে পারেন অনেকে। রিকি পন্টিংয়ের ওই দলের ব্যাটিংও এই অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে অনেক ভালো ছিল।

তবে এবারের জয়ও নিশ্চিতভাবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে, যেমন থাকবে দলের দুর্দিনে রাহানের বটবৃক্ষ হয়ে ওঠা। ‘আজিঙ্কা মাধুকর রাহানে’; এই টেস্টে ছিলেন ঠিক যেন তার নামের মতোই। বিচ্ছিন্ন সম্ভাবনাগলোকে এক সুতোয় গেঁথে উপহার দিলেন মধুময় এক টেস্ট।

– ফেসবুক থেকে

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...