অনবদ্য, অবিশ্বাস্য, অতিমানবীয়!

বেশিরভাগ ক্রিকেটারদের বেঞ্চমার্কে যে পরিসংখ্যান ঠিকঠাক তেমনটা সেঞ্চুরিহীন থাকা অবস্থাতেই ছিলেন কোহলি। কিন্তু কোহলি নামটার পাশে গড়পড়তা পরিসংখ্যান কি আর মানায়? তাই বিরাটের নিজের এবং সমর্থকদের- দুইয়ের খিদেই বাড়ছিল। সেঞ্চুরির খিদে। রানের জন্য তৃষ্ণা। অবশেষে রানের জন্য তৃষিত, সেঞ্চুরির জন্য ক্ষুধার্ত বিরাট কোহলির দেখা মিলল। 

দিন, মাস পেরিয়ে বছর পেরিয়েছে। নিন্দুকদের সমালোচনার স্রোতের ধারা বইতে ঐটুকু সময়ই তো যথেষ্ট। বিরাট কোহলিও সেই তীব্র সমালোচনার স্রোতে বিধ্বস্ত হলেন। ‘ফুরিয়ে গেছেন’ শোরগোলে নিজেকে হারিয়ে ফেললেন। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর সামর্থ্য তাঁর মাঝে আছে সেটা তিনি জানতেন। কিন্তু ছন্দে ফেরার সেই কিকটা পাচ্ছিলেন না। 

গত বছরে এশিয়া কাপের সময় কিছুটা আলো ফিরে পেলেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে অগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে করলেন সেঞ্চুরি। ভারতের জন্য সে ম্যাচটা ছিল একদমই গুরুত্বহীন। কিন্তু বিরাটের জন্য সেটি ছিল একটা ফেরার ইনিংস, হারিয়ে যে যাননি তেমন একটা বার্তা দেওয়ার উপলক্ষ। কারণ সহস্র দিন পর তিন অঙ্কের ম্যাজিক্যাল ফিগার যে স্পর্শ করলেন সে ম্যাচ দিয়েই। 

বিরাট ফিরলেন, তবে ফেরাটা কি রাজকীয় হল ? একের পর এক সেঞ্চুরি করবেন, সেঞ্চুরির পর শূন্যে লাফিয়ে তাঁর ট্রেডমার্ক উদযাপন করবেন- এটাই রাজার রাজত্বের স্থির চিত্র। কিন্তু তেমন চিত্র আর পাওয়া গেল কই। পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অবশ্য দারুণ এক ৮২ রানের ইনিংস দিয়ে নিজেকে আবারো লাইম লাইটে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এরপরেই আবার কিছুটা বিরতি। 

বেশিরভাগ ক্রিকেটারদের বেঞ্চমার্কে যে পরিসংখ্যান ঠিকঠাক তেমনটা সেঞ্চুরিহীন থাকা অবস্থাতেই ছিলেন কোহলি। কিন্তু কোহলি নামটার পাশে গড়পড়তা পরিসংখ্যান কি আর মানায়? তাই বিরাটের নিজের এবং সমর্থকদের- দুইয়ের খিদেই বাড়ছিল। সেঞ্চুরির খিদে। রানের জন্য তৃষ্ণা। অবশেষে রানের জন্য তৃষিত, সেঞ্চুরির জন্য ক্ষুধার্ত বিরাট কোহলির দেখা মিলল। 

যেমনটা করে ২০১৯ পর্যন্ত দাপিয়েছেন, সেঞ্চুরিকে ডালভাত বানিয়ে ফেলেছিলেন ঠিক তেমন কিছুর প্রতিচ্ছবি হয়ে ২০২৩ এসে ধরা দিল।

শুরুটা অবশ্য ২০২২ এর শেষ দিকে। বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি হাঁকালেন। অপেক্ষাটা ১২৮৮ দিন! হয়তো এই অপেক্ষাই ব্যাটার বিরাট কোহলিকে তাতিয়ে দিয়েছিল। অপেক্ষার অস্থিরতা মেটালেন পরের ওয়ানডেতেও। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘরের মাটিতে হওয়া সিরিজের প্রথম ম্যাচেই হাঁকালেন সেঞ্চুরি। ব্যাক টু ব্যাক ওয়ানডে সেঞ্চুরি। ২০১৯ এ যেখানে থেমেছিলেন ৪৩ সেঞ্চুরিতে, সেখানে তিন বছর বাদে ৪৪, ৪৫ সংখ্যাটা ছোঁয়া হলো এই দুই ম্যাচেই। 

শচীন থেকে তখন পিছিয়ে রইলেন ৪ সেঞ্চুরিতে। কিন্তু পিছিয়ে থাকা তো কোহলির অভ্যাসে নেই। বিরাট আবার সেঞ্চুরি হাঁকালেন। পুরনো অভ্যাস ফিরিয়ে আনলেন। এক ম্যাচ বিরতি দিয়ে সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আবার তিন অঙ্কের ফিগার স্পর্শ করলেন।

বিরাট সেঞ্চুরি করলেন। অথচ কোনো রেকর্ড হবে না? তেমনটা আবার হয় নাকি? শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ১৬৬ রানের ইনিংস খেলার দিনে যেন রেকর্ডের এক ঝুপড়ি খুলে বসলেন তিনি। প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ১০ টি সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়লেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪৯ ইনিংসে তিনি হাঁকিয়েছেন ১০ সেঞ্চুরি আর ১১ টি হাফ সেঞ্চুরি।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এ ইনিংস দিয়ে ক্যারিয়ারে পঞ্চম বারের মত ১৫০+ রানের ইনিংস খেললেন কোহলি। এখানেও হয়েছে দুটি রেকর্ড। প্রথমত ভারতের মাটিতে দ্রুততম দেড়শো রানের ব্যক্তিগত সংগ্রহের রেকর্ড এটি। এর আগে ২০১৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার জর্জ বেইলি ১০৯ বলে দেড়শো রান পূরণ করেছিলেন।

আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এ ম্যাচে কোহলি তাঁর ইনিংসের ১৫০ তম রানটি পূরণ করেছেন ১০৬ বলে। দ্বিতীয়ত, নন ওপেনার হিসেবে কোহলির চেয়ে ক্রিকেট ইতিহাসের কেউ ওয়ানডেতে এতবার দেড়শো রানের ইনিংস খেলেননি। কোহলির পর নন ওপেনার ব্যাটার হয়ে সর্বোচ্চ তিনবার ১৫০+ রানের ইনিংস খেলেছেন ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি ভিভ রিচার্ডস।

রেকর্ড গড়ার ইনিংসে ফেরা যাক। ১৩ চার আর ৮ ছক্কায় ১৬৬ রানের এ ইনিংস সাজিয়েছেন বিরাট কোহলি। নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৪৬ তম সেঞ্চুরি ইনিংস ছোঁয়ার পর আরো রূদ্রমূর্তি ধারণ করেন কোহলি। বোলারদের উপর চড়াও হচ্ছিলেন প্রায় প্রতি বলেই। লঙ্কানদের করা স্লটের বল কিংবা বাউন্সি শর্টার বল- কোন বলই যেন দাঁড়াতে পারছিল কোহলির উইলোর সামনে। অবলীলায় সেগুলোকে বাউন্ডারিতে রূপান্তর করছিলেন তিনি। আর তাতে ভারতের দলীয় সংগ্রহও গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯০ তে।

শেষ ৪ ম্যাচে ৩ সেঞ্চুরি! কোহলি ঠিকই বুঝিয়ে দিচ্ছেন আগের কোহলি এখনও ম্রিয়মাণ হয়নি। প্রতিচ্ছবি হয়ে ফিরে আসতে একটা সাময়িক বিরতি হয়েছিল শুধু। সেই বিরতি কেটে গিয়েছে। কোহলিও সেঞ্চুরিয়ান রূপে ফিরেছেন।

শচীনের শত সেঞ্চুরির রেকর্ড হয়তো এখনও তাঁর জন্য অনেক দূরের পথ, কিন্তু ওয়ানডের সেঞ্চুরির হাফসেঞ্চুরি তো একদম সন্নিকটে। যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন, তাতে এমন আর দুই একটা সিরিজ পেলেই সেই ৫০ সংখ্যাটা স্পর্শ করার মুহূর্ত এল বলে। তবে বিরাটের যাত্রা তো আর শুধু এই মাইলফলকটি স্পর্শ করাকে ঘিরে নয়। শচীনের ঐ রেকর্ডের দূরের পথটা ডিঙিয়ে যাওয়ার দুঃসাহস ঠিকই দেখাবেন তিনি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...