বার্বাডোজের বাঘ

সাউন্ড টেকনিকের কারণে ফাস্ট বোলিংয়ে বেশ স্বচ্ছন্দ ছিলেন হেইন্স। ফ্রন্টফুট ও ব্যাকফুটে ছিলেন প্রায় সমপরিমাণ দক্ষ। তাঁর ছিল জমাট ডিফেন্স, নতুন বলে সুইং সামলানোর বিশেষ ক্ষমতা এবং লেংথ বলে ড্রাইভ খেলার পারদর্শিতা।হেইন্সের ব্যাটিংকে বলা যায় পাওয়ার এবং টাইমিংয়ের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। বিশেষ করে কাভার ড্রাইভ, স্কয়ার কাট, ফ্লিক এই শটগুলোতে তাঁর ছিল অসম্ভব নিয়ন্ত্রণ। পেসারদের দ্রুতগতির বাউন্সারের জবাব দিতেন দর্শনীয় পুল ও হুক শটে।

ডেসমন্ড হেইন্স যখন ১৯৯৪ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় জানান, তখন এই ফরম্যাটে কারো রানই তাঁর চেয়ে বেশি ছিল না। কেউ তাঁর চেয়ে বেশি ওয়ানডেও খেলেননি। এমনকি সেঞ্চুরির সংখ্যার দিক থেকেও তিনি ছিলেন সবার আগে। তাঁর আধিপত্তই তাঁর সামর্থ্যের হয়ে কথা বলে, তাই তো তিনি বার্বাডোজের বাঘ।

১৯৫৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বার্বাডোজের হোল্ডারস হিল ডিস্ট্রিক্ট নামক এলাকায় জন্মগ্রহন করেন ডেসমন্ড হেইন্স। তিন ভাইয়ের মধ্যে হেইন্স ছিলেন সবার বড়। তাঁর ডাকনাম ছিল লিও।

ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ওপেনিং জুটির তালিকা করলে গর্ডন গ্রিনিজ-ডেসমন্ড হেইন্স জুটির স্থানটা সবার ওপরেই থাকবে। দুজনে মিলে খেলেছেন ৮৯ টেস্ট, ইনিংস উদ্বোধন করেছেন ১৪৮ বার, ৪৭.৩২ গড়ে সংগ্রহ করেছেন ৬৪৮২ রান। টেস্ট ক্রিকেটের উদ্বোধনী জুটিতে তাঁদের চেয়ে বেশী রান আর কারো নেই!

টেস্টে তাঁদের শতরানের জুটি আছে ১৬টি, যার মধ্যে ৪টি আবার দুই শতাধিক রানের। সর্বোচ্চ ২৯৮ রানের জুটিটা গড়েছিলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ১৯৯০ সালে অ্যান্টিগায়।

হেইন্স-গ্রিনিজ জুটি তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছেন একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও। রান তোলার দিক থেকে শচীন-সৌরভ (৬৬০৯) আর গিলক্রিস্ট-হেইডেন (৫৩৭২) জুটির ঠিক পরেই আছেন তাঁরা।

১০৪ ওয়ানডেতে ৫২.৫৫ গড়ে হেইন্স-গ্রিনিজ জুটির সংগ্রহ ৫১৫০ রান। শতরানের জুটি গড়েছেন ১৫ বার। সর্বোচ্চ ১৯২* রানের জুটিটা গড়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, ১৯৮৭ সালে ক্রাইস্টচার্চে।

গ্রিনিজের সাথে তাঁর সফল ওপেনিং জুটি সম্পর্কে হেইন্স এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘আমরা সাধারণত প্রচুর স্ট্রাইক রোটেট করতাম। খুব ভাল বল না করলে, তাহলে আমাদের বিপক্ষে টানা ছয়টা বল কেউ কখনো পায়নি। কারণ যখনই আমরা ব্যাট করতাম, তখনই স্ট্রাইক পাল্টে নিতে চাইতাম।’

১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে অ্যান্টিগার রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একদিনের ম্যাচ দিয়ে তাঁর আন্তর্জাতিক অভিষেক। মজার ব্যাপার হল, ওই একই ম্যাচে দু’দল মিলিয়ে সর্বমোট ১৪ জন ক্রিকেটারের ওয়ানডে অভিষেক হয়েছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের নয় জন আর অস্ট্রেলিয়ার পাঁচ জন।

ওয়ানডে অভিষেকেই সেঞ্চুরি করে দলকে দারুণ এক জয় উপহার দিয়েছিলেন হেইন্স। ১৬ চার ও ২ ছক্কায় সাজানো ১৩৬ বলে ১৪৮ রানের দুর্দান্ত ইনিংসটি অভিষেক ম্যাচে যেকোন ব্যাটসম্যানের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ও দ্রুততম ইনিংসের রেকর্ড।

কেবল অভিষেকেই নয়, হেইন্স সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচেও। ১৯৯৪ সালের ৫ মার্চ, পোর্ট অব স্পেনের কুইন্স পার্ক ওভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ‘বিদায়ী’ ওয়ানডেতে ১১২ বলে ১১৫ রানের চমৎকার একটি ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।

ইংল্যান্ডের ডেনিস অ্যামিসের পর ডেসমন্ড হেইন্সই একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি অভিষেক ও বিদায়ী ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করার বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

হেইন্সের ব্যাটিং স্টাইল ছিল ‘টিপিক্যাল’ ক্যারিবিয়ান ওপেনারদের মত। তাঁর ছিল দুর্দান্ত স্ট্যামিনা; ফলে সহজে ক্লান্ত হতেন না। রানিং বিট্যুইন দ্য উইকেটে ছিলেন বেশ তৎপর। অনায়াসেই খেলতে পারতেন লম্বা ইনিংস।

সাউন্ড টেকনিকের কারণে ফাস্ট বোলিংয়ে বেশ স্বচ্ছন্দ ছিলেন হেইন্স। ফ্রন্টফুট ও ব্যাকফুটে ছিলেন প্রায় সমপরিমাণ দক্ষ। তাঁর ছিল জমাট ডিফেন্স, নতুন বলে সুইং সামলানোর বিশেষ ক্ষমতা এবং লেংথ বলে ড্রাইভ খেলার পারদর্শিতা।

হেইন্সের ব্যাটিংকে বলা যায় পাওয়ার এবং টাইমিংয়ের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। বিশেষ করে কাভার ড্রাইভ, স্কয়ার কাট, ফ্লিক এই শটগুলোতে তাঁর ছিল অসম্ভব নিয়ন্ত্রণ। পেসারদের দ্রুতগতির বাউন্সারের জবাব দিতেন দর্শনীয় পুল ও হুক শটে।

বিখ্যাত ক্রীড়া সাময়িকী উইজডেনের ভাষ্যমতে, ‘শুধু রান দিয়ে তাঁকে (হেইন্স) বোঝা যাবে না, বুঝতে হবে কিভাবে তিনি রান করেছেন সেটা দিয়ে। কখনো রানের গতি কমেনি, বরং হয়েছে আরো আকর্ষণীয়, যদিও কখনোই খুব বেশি স্লগ করেননি।’

তবে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে কোয়ালিটি স্পিনের বিপক্ষে বেশ দুর্বল ছিলেন তিনি। অবশ্য সময় যত গড়িয়েছে, স্পিনারদের বিপক্ষেও ক্রমশ ধারালো হয়ে উঠেছে তাঁর ব্যাট।

১৯৮৯ সালে সিডনি টেস্টের পিচকে বলা হচ্ছিল ‘ডাস্টবোল’ অর্থাৎ ‘ধূলির আধার’। স্পিন সহায়ক টার্নিং উইকেটে অস্ট্রেলিয়ান স্পিনারদের বিপক্ষে সেবার দুর্দান্ত ব্যাটিং করেছিলেন ‘স্পিনে দুর্বল’ হেইন্স। ১৪৩ বলে ৭৫ রানের অসাধারণ ইনিংসটি নিঃসন্দেহে তাঁর ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসগুলোর একটি।

সঙ্গী গর্ডন গ্রিনিজের চাইতে তুলনামূলক কম আক্রমণাত্মক ছিলেন হেইন্স। তাই বলে রান তোলার দিক থেকে সঙ্গীর চেয়ে কোন অংশে কম যেতেন না এই ডানহাতি বার্বাডিয়ান। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেকেও খেলেছিলেন দলের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ৬১ রানের দারুণ এক ইনিংস।

১১৬ টেস্টে ১৮ সেঞ্চুরিসহ ৪২.২৯ গড়ে হেইন্সের সংগ্রহ ৭৪৮৭ রান। ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৮৪ রান, ১৯৮৪ সালে লর্ডসে।

ডেসমন্ড হেইন্সই টেস্ট ইতিহাসের একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি সর্বাধিক ৩ বার ইনিংসের ‘শুরু থেকে শেষ’ অর্থাৎ একেবারে অলআউট হবার আগ পর্যন্ত ব্যাট ‘ক্যারি’ করার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন ।

হেইন্স ও গর্ডন গ্রিনিজ
  • প্রথমবার: ১৯৮৬ সালে করাচিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত ৮৮
  • দ্বিতীয়বার: ১৯৯১ সালে হেডিংলিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ৭৬
  • তৃতীয়বার: ১৯৯৩ সালে কুইন্স পার্ক ওভালে পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত ১৪৩

শুধু তিনবার ব্যাট ক্যারি করাই নয়, টেস্টে আরো একটি অনন্য রেকর্ডের মালিক এই ডেসমন্ড হেইন্স।

১৯৭৯ সালে ডানেডিন টেস্টে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ইনিংসেই নেমেছিলেন ওপেনার হিসেবে, আউট হয়েছিলেন ‘শেষ’ ব্যাটসম্যান হিসেবে। টেস্ট ইতিহাসে এমন ঘটনার নজির মাত্র এই একটাই আছে। উল্লেখ্য, প্রথম ও দ্বিতীয় ইনিংসে হেইন্স করেছিলেন যথাক্রমে ৫৫ ও ১০৫ রান।

২৩৮ ওয়ানডেতে ৪১.৩৭ গড়ে হেইন্স করেছেন ৮৬৪৮ রান। ১৭টি সেঞ্চুরির সাথে ফিফটি আছে ৫৭টি। ক্যারিয়ার সেরা ১২৬ বলে অপরাজিত ১৫২ রানের ইনিংসটি খেলেছিলেন ভারতের বিপক্ষে, ১৯৮৯ সালে গায়ানার জর্জটাউনে। অনবদ্য সেই ইনিংসটি খেলার পথে ১২টি চার ও ৬টি ছক্কা মেরেছিলেন হেইন্স।

১৭টি ওয়ানডে সেঞ্চুরির মধ্যে ১১ টিতেই অপরাজিত ছিলেন হেইন্স। ওয়ানডেতে হেইন্সের সেঞ্চুরি মানেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় অবধারিত ছিল। হেইন্স সেঞ্চুরি করেছেন কিন্তু দল জেতেনি ইতিহাসে এমনটা হয়েছে মাত্র একবার!

যখন অবসর নিলেন তখন হেইন্সের ১৭ সেঞ্চুরি ও ৮৬৪৮ রানই ছিল ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি ও রানের রেকর্ড! তাঁর সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির রেকর্ডটা ভেঙেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার আর সর্বোচ্চ রানেরটা আজহারউদ্দীন।

১৯৮৩ সালের ২৪ নভেম্বর আহমেদাবাদে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ক্রিকেটের বিরল আইন ‘হ্যান্ডলড দ্য বল’ এর ফাঁদে পড়ে আউট হন তিনি। ক্রিকেট ইতিহাসের ৪র্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে অদ্ভুত এই আউটের শিকার হয়েছিলেন হেইন্স।

১৯৭৯ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত মোট ৪টি বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছেন হেইন্স। বিশ্বকাপের ২৫ ম্যাচে ৩৭.১৩ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ৮৫৪ রান। তিনটি হাফ সেঞ্চুরির পাশে সেঞ্চুরি আছে ১টি।

খেলোয়াড়ি জীবনে প্রচুর কাউন্টি ক্রিকেট খেলেছেন হেইন্স। তাঁকে কাউন্টি দল মিডলসেক্সের একজন জীবন্ত কিংবদন্তী হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত মিডলসেক্সের পক্ষে ৯৫টি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচে তিনি রান করেছেন ৭০৭১। ব্যাটিং গড় ৪৯.৫। সর্বোচ্চ স্কোর অপরাজিত ২৫৫, সাসেক্সের বিপক্ষে।

সবমিলিয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে হেইন্সের সংগ্রহ ৬১টি সেঞ্চুরিসহ ৪৫.৯০ গড়ে ২৬,০৩০ রান। এছাড়া ৪১৯টি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচও খেলেছেন তিনি। ২৮টি সেঞ্চুরিসহ ৪২.০৭ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ১৫,৬৫১ রান

১৯৯১ সালে ‘উইজডেন ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন হেইন্স। ১৯৯৩ সালে  ‘ডেসমন্ড হেইন্স: লায়ন অব বার্বাডোজ’ নামে তাঁর একটি আত্মজীবনী গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছিল।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...