অন শচীন

তিনি নিজের লক্ষ্যে যে সফল হয়েছিলেন তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। পঁচিশ বছর ধরে ধারাবাহিক সাফল্য এক অলৌকিক অ্যাচিভমেন্ট। তিন প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ বোলারদের তিনি সামলেছেন দক্ষতার সঙ্গে। টেস্ট এবং এক দিনের ম্যাচের চাহিদা অনুযায়ী নিজের ব্যাটিং টেকনিককে পরিমার্জিত করেছেন। কিন্তু এর মূল্যও তাঁকে দিতে হয়েছে। ক্যারিয়ারের শেষের কয়েক বছর তিনি ক্রিকেট মাঠে আর রাজত্ব করতেন না। তিনি পরিবর্তিত হয়েছিলেন অ্যাকুমুলেটরে। এ কাজ শচীনের প্রতিভার সঙ্গে মানানসই ছিল না।

১৯৯৯ সালের শেষের দিকের ঘটনা। স্টেট ব্যাংকের ব্যাঙ্গালোর ট্রেনিং সেন্টারে তখন আমাদের মত ব্যাংকে সদ্য জয়েন করা কয়েকজন ছেলে – মেয়েদের ট্রেনিং চলছে। তারই মধ্যে একদিন অতিথি হিসেবে সেন্টারে নিয়ে আসা হোল গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ এবং সৈয়দ কিরমানিকে। দুজনেই তখন স্টেট ব্যাংকের অফিসার।

কিছুক্ষন বাধ্যতামূলক বক্তৃতার পর আমাদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষন আলাপ-আলোচনা করলেন দুই কিংবদন্তি ক্রিকেটার। কিরিকে জিজ্ঞেস করা হল মাঠের শ্রেষ্ঠ সিট (নন স্ট্রাইকারের এন্ড) থেকে কপিল দেবের ১৭৫ দেখার অভিজ্ঞতা। ভিশিকে জিজ্ঞেস করলাম ওনার খেলা শ্রেষ্ঠ বোলারের নাম। অবধারিতভাবেই আলোচনায় উঠে এলেন সেই সময়ের বিশ্ব শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকারের নাম। তখন শুধু আমরাই কেন, পুরো দেশের মানুষই শচীনে আপ্লুত। কিছুদিন আগেই মরুঝড় দেখেছি আমরা।

ভিশিকে জিজ্ঞেস করলাম, ভিভের তুলনায় শচীনকে কোথায় রাখবেন?

মৃদু হাসলেন ভিশি, ‘ভিভ নিজের ক্যারিয়ার জুড়ে সব বোলারদের যেভাবে ব্লাস্ট করেছে, এবার শচীন সেটা করবে। তবে শচীনের ডিফেন্স ভিভের চেয়ে কম্প্যাক্ট। এক দিক দিয়ে বলা যেতে পারে ওর ব্যাটিং ভিভ আর সানির সমন্বয়।’

তারপর ভিশি আরও একটু বিস্তারে ব্যাখ্যা করলেন সানির ক্যারিয়ার জুড়ে ডিফেন্সিভ ব্যাটিংয়ের কারণ। ভিভের মতো সাপোর্ট যেহেতু সানির ছিল না, তাকে পুরো ভারতের ব্যাটিং এর দায়িত্ব অনেক সময় একার কাঁধে বইতে হত। এই কাজটা শচীন এত দিন ধরে করে এসেছে। কিন্তু এখন বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানদের আবির্ভাবে শচীনের ওপর চাপ কমবে, ও আরও ফ্রিলি ব্যাটিং করতে পারবে। বয়স অনুযায়ী শচীনের ব্যাটিং এর শ্রেষ্ঠ সময় এখনও ভবিষ্যতে।

সেদিন ভিশির কথা অযৌক্তিক মনে হয়নি একেবারেই। ঠিকই, যে ছেলে ষোল বছর বয়সে ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম কিংবা ওয়াকার ইউনুসদের সামলে এসেছে, শেন ওয়ার্নকে ইচ্ছেমত মাঠের বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে যে অভ্যস্ত, তাকে কে থামাবে?

শচীন থামেনও নি। বড় ইনিংস খেলার রেকর্ডগুলো ছাড়া প্রায় সব ব্যাটিং রেকর্ড তিনি অনায়াসে নিজের দখলে নিয়ে এসেছিলেন। টেস্ট তো বটেই, এক দিনের ক্রিকেটেও।

কিন্তু ভিভ হতে পারেননি শচীন। হয়ত সচেতনভাবে হতে চাননি। কারণ তার ধমনীতে ক্যারিবিয়ান নয়, মুম্বাই ঘরানার রক্ত। উদ্দামতার চেয়ে নির্ভরতা তার বেশি পছন্দ। বীরেন্দ্র শেবাগ, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষণ, সৌরভ গাঙ্গুলির রত্নখচিত ব্যাটিং লাইন আপে তিনি রয়ে গেছিলেন অবিসংবাদিত কোহিনূর কিন্তু তবু তার মধ্যে সেই তাণ্ডব দেখা যায়নি যেটা দেখা যেত শ্রেষ্ঠ ফর্মের ভিভের ব্যাটে। বা পরবর্তীকালে ব্রায়ান লারার।

এটাই সে যুগের ক্রিকেটপ্রেমীদের ছোট্ট অভিযোগ ভারতের চিরশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধে। তিনি নিজের ক্যারিয়ারকে প্রলম্বিত করা এবং ব্যাটিং এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসের তুলনায়।

তিনি নিজের লক্ষ্যে যে সফল হয়েছিলেন তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। পঁচিশ বছর ধরে ধারাবাহিক সাফল্য এক অলৌকিক অ্যাচিভমেন্ট। তিন প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ বোলারদের তিনি সামলেছেন দক্ষতার সঙ্গে। টেস্ট এবং একদিনের ম্যাচের চাহিদা অনুযায়ী নিজের ব্যাটিং টেকনিককে পরিমার্জিত করেছেন।

কিন্তু এর মূল্যও তাঁকে দিতে হয়েছে। ক্যারিয়ারের শেষের কয়েক বছর তিনি ক্রিকেট মাঠে আর রাজত্ব করতেন না। তিনি পরিবর্তিত হয়েছিলেন অ্যাকুমুলেটরে। এ কাজ শচীনের প্রতিভার সঙ্গে মানানসই ছিল না। এ কাজ তার থেকে হয়ত একটু বেশি ভালো করতেন ক্যালিস বা দ্রাবিড়। কিন্তু শেষের দুজনকে তাঁদের শ্রেষ্ঠ সময়েও বিশ্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানের মুকুটের দাবীদার মনে করা হত না। আজ হয়ত হয় কারণ এখন তাঁদের খেলার ধরন নয়, রেকর্ড বুকের সংখ্যার ওপর বিচার করা হচ্ছে।

স্মৃতি বড় নির্মম। শেষের দিনের স্মৃতি আমাদের মানসে তুলনায় বেশি উজ্জ্বল থাকে। তাই এখন দেখতে পাই ওয়ার্ন নিজের মত পরিবর্তন করে আজ লারাকে শচীনের চেয়ে এগিয়ে রাখেন। যদিও যখন খেলতেন তখন তার মত ছিল, ‘শচীন … ডে লাইটস … লারা।’

কপিলকে আক্ষেপ করতে শোনা যায় নিজের ট্যালেন্টের ওপর সুবিচার করেননি শচীন। তিনি জানবেন, কারণ তিনি শচীনকে নেটে কাছ থেকে দেখেছেন, বল করেছেন। মুম্বাই – হরিয়ানা রঞ্জি ফাইনালে একটা সময় এসেছিল যখন শচীনের বিধ্বংসী ব্যাটের সামনে বল ফেলার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলেন না ভারতের চিরশ্রেষ্ঠ ফাস্ট বোলার এবং অল-রাউআন্ডার। এ অবস্থা তার ভিভের বিরুদ্ধেও হয় নি।

মাঝে মধ্যে ভাবি ভিশির স্বপ্নের পথে চললে কোথায় শেষ করতেন শচীন। হয়ত আরও অনেকটা উঁচুতে উঠতেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে এতটা কথ কাভার করতে পারতেন না। জীবনে ফ্রি লাঞ্চ বলে কিছু হয় না। ক্রিকেটেও না।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...