আমি একদিনের ক্রিকেট! আমাকে বাঁচাও!

বিভিন্ন রকম নিয়মের চাপে পিষতে পিষতে একদিনের ক্রিকেট এখন চরম একমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছে। চেনা স্ক্রিপ্ট দুটিই। পাটা পিচে দিন রাতের ম্যাচ খেলা হবে। দুই ইনিংসেই ৩০০ বা তার কাছাকাছি রান হবে। কখনও যারা প্রথমে ব্যাট করবে তারা জিতবে। কখনও উল্টোটা। আগের মতন, ২৫০ রানের ম্যাচ আর হয় না।

‘আজ খেলা আছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে।’ বা ‘স্যার, আজকে একটু ছুটি চাই। ইডেনে ম্যাচ আছে। অনেক কষ্টে টিকিট পেলাম।’ – এসব এখন অতীত। বড় কোনো ম্যাচের দিন রাস্তা শুনশান-তারও মৃত্যু হয়েছে বছর দশেক আগেই। খেলা থাকলেও দিব্যি আপিস-ইস্কুল সেরে আরামসে বাড়ি ফিরে পুরোটাই দেখা যায়।

ইডেন যেতে হলেও সমস্যা নেই। হাফ ডে নেবার প্রশ্নই আসে না। আপিস সেরে বেরিয়েই দিব্যি মাঠে যাওয়া যায়। বসের ধাতানির জায়গাই নেই। কারণ এখন তো আর ওয়ানডে খেলা হয় না। শুধুই কুড়ি-বিশ। একসময় যে একদিনের ক্রিকেটের হাত ধরে ক্রিকেট স্বাধীন হবার স্বপ্ন দেখতো, সে এখন বিস্মৃতপ্রায়।

এখনও একেবারে ডাস্টবিনে চলে যাওয়ার অবস্থা না হলেও, একদিনের ক্রিকেট এখন আইসিসি’র সদর দপ্তরের কোনো ভুলে যাওয়া তাকে আধ ছেঁড়া পুরোনো বই। মাঝে মাঝে আমরা যেমন নিছক নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ধুলো ঝেড়ে সেই বই গুলোর পাতা ওল্টাই, আইসিসি ও একদিনের ক্রিকেটের সম্পর্কও সেরকম। আগামী বছরের বিশ্বকাপে সরাসরি যোগ্যতা অর্জনের জন্যে যে একদিনের আন্তর্জাতিক সুপার লিগ খেলা হচ্ছে, সেটা ক’জন জানেন? বা জানলেও মনে রাখেন?

এই যে বাবর আজম সেঞ্চুরি করে পাকিস্তানকে জেতালেন, কজন ম্যাচের একটি বল হলেও সরাসরি দেখেছেন? ফেবুকে যদি সেটা মাপার সূচক হিসাবে ধরি, তাহলে নিতান্তই ছিটেফোঁটা। তা ওয়ানডে ক্রিকেটের এই হাল কিভাবে হলো? অনেক ভেবে কতগুলো কারণ খুঁজে পেলাম। পাঠক দেখুন আপনাদের সাথে মেলে কিনা।

  • কুড়ি-বিশের থাবা

টেস্ট ক্রিকেটকে অবজ্ঞা করা চলবে না। ক্রিকেটের সার্বিক উন্নতির জন্যে এর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু সাদা পোশাক ও লাল-গোলাপি বলের খেলায় তো আর্থিক ক্ষতি। তা পূরণ করবে কে? কেন, কুড়ি-বিশ ক্রিকেট। বা বলা ভালো কুড়ি বিশ ক্রিকেটের ঘরোয়া লিগ।

আজই ওসমান সামিউদ্দিনের একটি লেখা পড়ছিলাম একদিনের ক্রিকেট নিয়ে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যালেন্ডারে ঘরোয়া কুড়ি-বিশ ক্রিকেটের প্রভাব নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি লিখছেন, ‘যে সময়ে মানুষের ঘরে বসে আম পেদানোর কথা, মুলতানে সেই সময়ে এখন পাকিস্তান আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ একদিনের ম্যাচ খেলছে। ৪০-ডিগ্রি রোদ্দুরে।’

কিন্তু এছাড়া আর সময় নেই যে। ক্রিকেটের ক্যালেন্ডার জুড়ে কুড়ি-বিশ ক্রিকেটের লাল দাগ। আবার ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রাম অনুযায়ী, এই ম্যাচ গুলো আগে থেকে নির্ধারিদঃ। না খেললে বিশ্বকাপের জন্যে দল পাওয়া দায় হবে! তাই একরকম বাধ্য হয়েই ম্যাচ গুলো খেলতে হচ্ছে। আগামী এফটিপি. থেকে বিশ্বকাপের যোগ্যতা নির্ণায়ক সুপার লিগও বন্ধ করে দিচ্ছে আইসিসি।

তাই উঠে যাচ্ছে এই বাধ্যবাধকতার বালাই। অলিম্পিক-স্বর্গে পৌঁছতে ক্রিকেটের সারথি এই কুড়ি-বিশই। তাই মহাপ্রস্থানের পথে একদিনের ক্রিকেটের যুধিষ্ঠির ছাড়া অন্যান্য পাণ্ডবদের মতোই দশা না হয় ! আর ২০৩১ এর পরে আইসিসি এখনও পরের ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ ঘোষণা করেনি। কাজেই…!

  • দর্শক অনীহা

টেস্ট দেখতে গেলে ধৈর্য্য ধরে সময় বিনিয়োগ করতে হবে। ঠিক যেভাবে হালকা আঁচে আসতে আসতে মাটন ডাকবাংলো রাঁধা হয়। আবার কুড়ি-বিশে ধৈর্য্য ধরার ব্যাপার নেই। চটজলদি খাওয়া শেষ। হজমও ফটাফট। আমার মত কারুর কারুর আবার গত মাস ছয়েকের ক্রমাগত কুড়ি-বিশ ভক্ষণের ফলে ধোঁয়া ঢেকুর উঠছে। তবে তা ধর্তব্যের মধ্যে না আনাই ভালো।

কিন্তু, এই দুইয়ের মাঝে একদিনের ক্রিকেটের প্রতি দর্শকের মনোভাব ঠিক কি রকম? আমার এক ক্রিকেট প্রেমী বন্ধু আমাকে একবার বলেছিলেন, ‘এখন আর ওয়ানডে দেখতে ভালো লাগে না। টেস্ট দেখি, টি-টোয়েন্টি ও দেখি। কিন্তু ওয়ানডে কেমন যেন একঘেঁয়ে হয়ে গেছে।’

ফাস্ট ফুডও নয় আবার মাটন ডাকবাংলোও নয়। কিভাবে খাবেন সেটাই বোঝা মুশকিল। ফলত ,একদিনের ক্রিকেটকে বর্জন করাটাই স্বাভাবিক। কি জানি হজম হয় কি না ! এবং এটার জন্যে কুড়ি-বিশের উদ্ভব ছাড়াও যেটা দায়ি সেই ব্যাপারটাতেই আসি।

  • একদিনের ক্রিকেটের বৈচিত্রের অভাব

বিভিন্ন রকম নিয়মের চাপে পিষতে পিষতে একদিনের ক্রিকেট এখন চরম একমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছে। চেনা স্ক্রিপ্ট দুটিই। পাটা পিচে দিন রাতের ম্যাচ খেলা হবে। দুই ইনিংসেই ৩০০ বা তার কাছাকাছি রান হবে। কখনও যারা প্রথমে ব্যাট করবে তারা জিতবে। কখনও উল্টোটা। আগের মতন, ২৫০ রানের ম্যাচ আর হয় না।

 

খুব বেশি দল (শুধু প্রধান দলগুলির কথাই বলছি) আজকাল কম রানে আউট হয়ে যায় না। ১২৫ বনাম ৮৭’র মতো ম্যাচের অস্তিত্ব আর নেই। টেস্ট ক্রিকেটের মতো কট-বিহাইন্ডও খুব কম হয়। স্লিপ নামক জায়গাটাই একদিনের ক্রিকেট থেকে বিলুপ্তপ্রায়। ২০১৯ বিশ্বকাপ ব্যতিক্রম। দ্বিপাক্ষিক সিরিজ মানেই এখন রানের ফোয়ারা।

চার-ছক্কা হৈ-হৈ রব। যা দেখে দেখে মানুষ ক্লান্ত। তবে এখানে প্রতিযুক্তি হতে পারে, একদিনের ক্রিকেট তো যথেষ্ট পরিমানে খেলাই হয় না। বৈচিত্র আসবে কিভাবে? তবুও, কুড়ি বিশকে দোষ দেবার আগে একদিনের ক্রিকেটকে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই হবে।

খুঁজে বার করতে হবে স্বল্প পরিসরে নিজেকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার উপায়। যা কুড়ি বিশ করেছে গত দশকের প্রথম দিকে এবং তার আগের দশকের শেষ দিকে। নাহলে কালের নিয়মেই ওয়ানডে ক্রিকেট একদিন ক্রিকেটের ‘ভেস্টিজিয়াল অর্গান’ হয়ে যাবে।

এতো কিছুর পরেও, ৫০ ওভারের ক্রিকেট বিশ্বকাপ আজও ক্রিকেটের ফ্ল্যাগশিপ। তবে কদ্দিন থাকবে জানি না। একদিনের ক্রিকেটে এখন চাই আন্দোলন। জ্বালাময়ী। রক্তরঞ্জিত। সবকিছু টলিয়ে দেয়া। কে হবেন তাঁর কান্ডারী? কে এনে দেবেন একদিনের ক্রিকেটকে ‘মুক্তির দশক’? এখনও খোঁজ চলছে। পাওয়া যায়নি। আরও ভালো করে খুঁজতে হবে। কাগজের আপিসটা যেনো কোনদিকে? বিজ্ঞাপনের বয়ানটাও বানাতে হবে। না! এসব হাবিজাবি তাড়াতাড়ি শেষ করি। সামনে অনেক কাজ রয়েছে যে!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...