টু ডব্লু: দোস্ত থেকে দুশমন

প্রতিবারই উইকেট শিকার করে ওয়াকার ও ওয়াসিম একে অপরের আনন্দে মেতে উঠতেন। যেনো তাঁরা পরস্পরের জন্য খেলছেন। কিন্তু, এই বন্ধুত্ব টিকলো না। বন্ধুত্বটা শুধু ভেঙে গেলে কথা ছিলো না। বন্ধুত্বটা আসলে শত্রুতায় পরিণত হলো।

৮০৯ ম্যাচ। ১৭০৭ উইকেট!

ওপরের সংখ্যাগুলো দেখার পর আর কিচ্ছুটি বলার দরকার নেই। একেবারে কিচ্ছুটি না। দু জন বোলার নিজেদের মধ্যে ১৭০৭টি আর্ন্তজাতিক উইকেট ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। এরপর আর একবারও মুখ ফুটে বলার দরকার নেই যে, তারা এই ক্রিকেট দুনিয়ার ইতিহাসের সফলতম বোলিং জুটি।

আসলে ‘সফলতম’ বললে ঠিক বোঝা যায় না। ইংরেজি শব্দ টেনে বলা উচিত-লেথাল। হ্যাঁ, দুনিয়ার সবচেয়ে ঘাতক পেস বোলিং জুটি ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনুস।

শন পোলক বলেছেন, ‘সর্বকালের সেরা? অবশ্যই ওয়াসিম ও ওয়াকারের জুটি। কী উইকেটে খেলা হচ্ছে, সেটা ব্যাপার না। তারা তাদের স্কিল দিয়ে সেটা জয় করে নিতে পারতেন। বিশ্বসেরা জুটি বেছে নিতে হলে আমি তাঁদেরই বেছে নেবো।’

ওয়াসিম-ওয়াকারের গল্প বলতে বসলে তো ছোটখাটো একটা মহাকাব্য হয়ে যাবে। ফলে দু’জনের সাফল্য নিয়ে কথা না হয় আজকের মতো তোলা থাক। আজ বরং এই দুই কিংবদন্তির সম্পর্ক নিয়ে আলাপ করা যাক। আলাপ করা যাক দু’জনের বন্ধুত্ব নিয়ে।

কী বিশ্বাস হচ্ছে না?

যারা ইদানিংকালের খোজখবর রাখেন, তাঁদের কাছে ওয়াসিম-ওয়াকার কেবলই দু’জন ‘শত্রু’। তারা একে অপরের সাথে খুব একটা দায়ে না পড়লে কথা বলেন না, পরষ্পরের সামনে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন না; এমনকি একসাথে কাজ করার প্রস্তাব পেলেও ফিরিয়ে দেন। কিন্তু চিরটাকাল এমন ছিলো না গল্পটা। একসময় তাঁরা দু’জন ছিলেন দুই দেহ এক প্রাণের বন্ধু।

দু’জনের মধ্যে একটা বড় মিল হলো, দু জনই ছিলেন আরেক কিংবদন্তি ইমরান খানের খুব পছন্দের পাত্র। কার্যত নিজের উত্তরসুরী হিসেবে এই দু’জনকেই পছন্দ করেছেন ইমরান। পছন্দ যে ভুল ছিলো না, সেটা দুনিয়া খুব টের পেয়েছে।

ওয়াসিম-ওয়াকার জুটিতে ওয়াসিম বয়স ও অভিজ্ঞতায় একটু সিনিয়র। ওয়াসিমের পাকিস্তানের হয়ে অভিষেক ১৯৮৪ সালে। এর প্রায় পাঁচ বছর পর ইমরান খানের আবিষ্কারে জাতীয় দলে এলেন ওয়াকার। দু জনের প্রথম জুটি হলো ১৪ অক্টোবর; ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে, শারজায়। ওয়াকারের অভিষেক ম্যাচেই নতুন বলে বল করেছিলেন ওয়াসিম-ওয়াকার। পরের মাসেই টেস্টেও ভারতের বিপক্ষে ওয়াকারের অভিষেক এবং সেখানেও নতুন বলে এই টু ডব্লু শুরু করলেন। প্রথম ইনিংসে দু’জনই চারটি করে উইকেট নিয়েছিলেন।

এটা ছিলো এক দশকেরও বেশি স্থায়ী এক ভয়ানক পেস জুটির ঐতিহাসিক শুরু।

এক পাশ থেকে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত পেসার ওয়াসিম তাঁর একটার পর একটা বৈচিত্রময় ডেলিভারি করে যাচ্ছেন। আরেক পাশ থেকে নারকীয় গতিতে বাউন্সার, ইয়র্কার ছুড়ে যাচ্ছেন ওয়াকার। মানে, আপনি ব্যাটসম্যান হলে দু:স্বপ্নেও এমন ওপেনিং স্পেল সামলাতে চাইবেন না।

মাঠে এই জুটি করার পাশাপাশি মাঠের বাইরে ওয়াসিম-ওয়াকার খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠলেন। ওয়াকারের প্রতি ওয়াসিমের তখনকার স্নেহটা ছিলো ভাতৃসূলভ। দু’জন হোটেল রুমে, ড্রেসিংরুমে ক্রিকেট এবং ক্রিকেটের বাইরের বিষয় নিয়ে সমানে আড্ডা দিতেন। এমনকি বিদেশ সফরে একসাথে ঘুরতেও দেখা যেতো তাদের।

১৯৯২ বিশ্বকাপে ওয়াকার যখন যেতে পারলেন না, সেটা ওয়াসিমের জন্য বড় একটা আঘাত ছিলো। প্রকাশ্যেই ওয়াসিম তখন বলেছিলেন, তিনি ওয়াকারকে ছাড়া অসহায় বোধ করছেন। ওই বছরই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিখ্যাত ‘বল টেম্পারিং সিরিজ’-এ ওয়াকার ফেরেন। প্রথম ইনিংসে ওয়াসিম পাঁচ উইকেট নেন এবং পরের ইনিংসে ওয়াকার। এটাই আসলে ওই সময়ে তাদের সম্পর্কটা বুঝিয়ে দেয়।

ওয়াকার পরে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছিলেন, তাদের মধ্যে তখন সম্পর্কটা ছিলো প্রতিদ্বন্ধীতাপূর্ণ বন্ধুত্বের। তাঁদের মাঠে পরস্পরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার একটা লড়াই ছিলো। সেটা বর্ণনা করতে গিয়ে ওয়কার বলেছেন, ‘এটার কারণ ছিলো যে, ওয়াসিম দুই উইকেট নিলে আমি তিন উইকেট নিতে চাইতাম। আমি তিন উইকেট নিলে, ও চার উইকেট নিতে চাইতো। আমাদের মধ্যে সবসময় ওই স্বাস্থ্যকর লড়াইটা ছিলো। আর তাতে উপকার পাকিস্তানেরই হয়েছে।’

এই লড়াইয়ের ফলটাও বিশ্ব দেখেছে।

১৯৯০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করাচি টেস্টে প্রথমবারের মতো নিজেরা দশ বা তার বেশী উইকেট নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করলেন; নিউজিল্যান্ডের ২০ উইকেটের ১৫টাই তারা নিয়েছিলেন। এটাও একটা শুরু হলো ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ২৪ টেস্ট খেলেছেন দু’জন একসাথে। এর মধ্যে ১৮ বারই তারা প্রতিপক্ষের ১০ বা তার বেশি উইকেট নিজেদের দু জনের দখলে রেখেছেন।

প্রতিবারই উইকেট শিকার করে ওয়াকার ও ওয়াসিম একে অপরের আনন্দে মেতে উঠতেন। যেনো তারা পরস্পরের জন্য খেলছেন। কিন্তু এই বন্ধুত্ব টিকলো না। বন্ধুত্বটা শুধু ভেঙে গেলে কথা ছিলো না। বন্ধুত্বটা আসলে শত্রুতায় পরিণত হলো।

পাকিস্তানী গ্রেট পেসার মুদাসসর নজর বলেছেন নব্বই দশকের মাঝামাঝি দু’জনের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। ঠিক কী নিয়ে দু জনের মধ্যে মনোমালিন্য ছিলো, এ কখনো জানা যায়নি। তবে লেখকরা মনে করেন, মূলত ইগোর লড়াই থেকেই এই টানাপোড়েন। দু জনই টের পাচ্ছিলেন যে, পরষ্পরকে তারকা হিসেবে দু জন ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।

প্রথম প্রকাশ্যে সমস্যা হয়েছিলো ১৯৯৩ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। ওয়াসিম তখন প্রথম অধিনায়ক হয়েছেন। পাকিস্তান ৪৩ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ার পর ওয়াসিম টিম মিটিংয়ে সিনিয়রদের সাথে কঠোর ব্যবহার করেন। বলেন যে, সবাইকে নেটে আরও কঠোর হতে হবে এবং বেশি সময় দিতে হবে। এই কথায় সিনিয়ররা খেপে গিয়ে ওয়াসিমের বিরুদ্ধে গ্রুপিং করেন। এবং বলা হয় যে, ওয়াসিমের তার আগ পর্যন্ত প্রিয়তম বন্ধু ও সহঅধিনায়ক ওয়কার নাকি এই ‘বিদ্রোহ’ উষ্কে দিয়েছেন।

এর ধারাবাহিকতায় দ্রুত ওয়াসিমকে সরিয়ে সেলিম মালিককে অধিনায়ক করা হয়।

তারপরও সে সময় অবশ্য প্রকাশ্যে কখনো দু জন গন্ডগোল করেননি। কথাও বলতেন টুকটাক, একসাথে মাঠে পারফরম করতেন, উইকেট নিয়ে উল্লাস করতেন; কিন্তু আগের হৃদ্যতাটা যে নেই, সেটা বোঝা যাচ্ছিলো। শোয়েব আখতার তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ১৯৯৯ সালে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে ভারতে থাকা অবস্থায় আসলে প্রথম বিস্ফোরনটা হয়। ওয়াসিম তখন অধিনায়ক।

দিল্লি টেস্ট হেরে যাওয়ার পর ওয়াসিম ও ওয়াকার ড্রেসিংরুমে সবার সামনে একে অপরকে দোষারোপ করেন এবং ‘আগলি’ কথার লড়াইয়ে জড়ান। শোয়েব লিখেছেন, ‘আমরা দিল্লিতে হেরে গেলাম এবং ওয়াসিম ওয়াকারের সাথে তর্কে জড়ালো। ব্যাপারটা এতোটাই খারাপ হলো যে, দলের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে গেলো যে, ওয়াকারকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। অবশ্য পুরো দলটাই কলকাতায় এলাম আমরা। ড্রেসিংরুমে যা হতে থাকলো, তা খুবই নোংরা ব্যাপার স্যাপার। আমি মনে করতে পারি না যে, তখনকার মতো বাজে পরিস্থিতি আর কখনো দেখেছি। দলের দুই সিনিয়র নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছেন। সবাই খুব টেনশনে ছিলো।’

পুরো ব্যাপারটা জঘন্য একটা রূপ পেলো ২০০৩ বিশ্বকাপে এসে। এর আগ পর্যন্ত যা অনেকটাই আড়ালে ছিলো, তা প্রকাশ্যে চলে এলো। সে বিশ্বকাপে পাকিস্তানের অধিনায়ক ছিলেন ওয়াকার ইউনুস। বলা হয়, ওয়াসিমকে দলে নেওয়াতেই তার আপত্তি ছিলো। তারপরও দলে আসার পর দু জনের কথাবার্তাই বন্ধ। পরষ্পরকে ইঙ্গিত করে বাজে কথা বলার নজিরও দেখা গেলো।

পাকিস্তান দল ওয়াকার ও ওয়াসিমের দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। কোনো পক্ষ কারো সাথে কথা বলতো না। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন ইনজামাম-উল হক। তিনি সবার সাথে কথা বলতেন। অধিনায়ক ওয়াকার কোনো প্রয়োজন হলে ইনজামামের মাধ্যমে ওয়াসিমদের সাথে যোগাযোগ করতেন।

এই অবস্থা পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ঠেলে দিলো। ফলে ওই ২০০৩ বিশ্বকাপ দু জনের জন্যই শেষ আর্ন্তজাতিক আউটিং হয়ে রইলো। এই ভয়াবহ বাজে সম্পর্কের কারণে দু জনেরই ক্যারিয়ার একই সাথে, একই দিনে শেষ হয়ে গেলো।

এও যেনো নিয়তির লেখা!

এখন কী অবস্থা? ওয়াসিম ধারাভাষ্যকার বা বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। ওয়াকার পাকিস্তানের কোচ ছিলেন, এখন বোলিং কোচ। ফলে হুটহাট দেখা হয়ে যায়। হাত মেলান দু জনে। ছবির জন্য পোজও দেন। এ পর্যন্তই। কথা বিনিময়ে খুব একটা হয় না।

২০১৭ সালে তাদের মেলানোর একটা উদ্যোগ নিয়েছিলো পিএসএল দল মুলতান সুলতান্স। দু জনকে একসাথে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছিলো তারা। দু জনই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।

মানে, এখনও দোস্তি ফিরে আসেনি।

ক্রিকেট ইতিহাস অবশ্য এই দোস্ত বা দুশমনদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক মনে রাখবে না। ইতিহাসে লেখা থাকবে, পাকিস্তানে এসেছিলেন সর্বকালের সেরা দুই পেসার, যারা রহস্যময় এক কারণে পুরো বিকশিত হতে পারেননি।

সেই রহস্যটা থেকেই যাক না হয়!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...