পেস বোলিংয়ে সিলেট-রাজ

বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের নেতৃত্বে ছিলেন হাসিবুল হোসাইন শান্ত। ক্রিকেটের এই অভিজাত সংস্করণে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বলটি করেছিলেন সিলেটের এই ফাস্ট বোলার। এরপর তাঁকে দেখে উঠে এসেছিলেন তাপস বৈশ্য, নাজমুল হোসাইন এবং আবুল হাসান রাজুরা। একটা সময় বাংলাদেশ জাতীয় দলের পেস বোলিংয়ে মাশরাফি বিন মর্তুজার সঙ্গ দিয়েছিলেন তাপস, নাজমুলরা।

বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রথম টেস্ট ম্যাচের কথাই ধরা যাক।

বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের নেতৃত্বে ছিলেন হাসিবুল হোসাইন শান্ত। ক্রিকেটের এই অভিজাত সংস্করণে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বলটি করেছিলেন সিলেটের এই ফাস্ট বোলার। এরপর তাঁকে দেখে উঠে এসেছিলেন তাপস বৈশ্য, নাজমুল হোসেন এবং আবুল হাসান রাজুরা। একটা সময় বাংলাদেশ জাতীয় দলের পেস বোলিংয়ে মাশরাফি বিন মর্তুজার সঙ্গ দিয়েছিলেন তাপস, নাজমুলরা।

তাপস বৈশ্য এবং নাজমুল হোসেনের পর সিলেটে একটা বড় শুন্যতা তৈরি হয়েছিল। দীর্ঘ দিন জাতীয় দলের পেস বিভাগে সিলেটের কাউকে দেখা যায়নি। সেই শুন্যতার অবসান ঘটেছে আবু জায়েদ রাহি, সৈয়দ খালেদ আহমেদ এবং এবাদত হোসেন চৌধুরীর মাধ্যমে।

টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ জাতীয় দলের পেস বিভাগে প্রাণভোমরা সিলেটের এই তিন পেস তারকা। দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করেই জাতীয় দলে নিজেদের জায়গা পাকাপোক্ত করেছেন তারা।

আবু জায়েদ রাহি বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে যুব বিশ্বকাপ খেলেছিলেন ২০১২ সালে। সে দলের অনেকেই তার আগে জাতীয় দলে খেলেছেন, তাসকিন আহমেদ, আনামুল হক বিজয়রা। যুব বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত খেলেছিলেন, নিয়মিত পারফর্ম করেছিলেন। কিন্তু জাতীয় দলে ডাকটা পাচ্ছিলেন না। বাংলাদেশ ‘এ’ দল, এইচপি দলে ঠিকই ডাক পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ ‘এ’ দল এবং এইচপি দলের হয়ে ম্যাচ খেলা হয়ে গেছে, কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে খেলাটা বাকি ছিল। তার জন্য তাকে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

টি-টোয়েন্টি দিয়েই বাংলাদেশ জাতীয় দলে তার যাত্রা শুরু ২০১৮ সালে। সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেক হয় রাহির। আর টেস্টে তার অভিষেক হয় সে বছর জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ২০১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ জাতীয় দলের চমক ছিলেন রাহি। তাকে বিশ্বকাপ দলে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে নির্বাচকদের সইতে হয়েছিল সমালোচনা। সেই সমালোচনা বন্ধ করতে মুখ্য ভুমিকা পালন করেছিলেন রাহিই।

আয়ারল্যান্ডে অনুষ্টিত ত্রিদেশী সিরিজে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচে স্বাগতিক আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ উইকেট নিয়ে প্রমাণ করেছিলেন বিশ্বকাপ দলে তাকে নিয়ে ভুল করেননি নির্বাচকরা। তার এই পারফর্মেন্স সমালোচনা বন্ধ করতো পেরেছিল ঠিকই, কিন্তু বিশ্বকাপে ম্যাচ খেলার জন্য যথেষ্ট ছিল না, তাইতো তাকে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সব গুলো ম্যাচ দেখতে হয়েছিল দলের ডাগ আউটে বসে।

বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে রাহি এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের হয়ে ৯টি টেস্ট ম্যাচে খেলেছেন; তার বিপরীতে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি খেলেছে যথাক্রমে ২টি এবং ৩টি। সাদা বলের চাইতে লাল বলে বেশ কার্যকরি রাহি।

সেই রাহি আজ অনেক পরিনত, বাংলাদেশ টেস্ট দলের মূল পেস ভরসা। এটা সম্ভব হয়েছে তার নিরলস কঠোর পরিশ্রমের ফলে। রাহি খেলায় কতটা সিরিয়াস এবং পরিশ্রমী সেটা খুব কাছ থেকে দেখেছেন রাজিন সালেহ।

রাহির সাথে দীর্ঘ সময় সিলেট বিভাগীয় দলে খেলেছেন রাজিন এবং গেল জাতীয় ক্রিকেট লিগে ছিলেন তার কোচ হিসেবে, তখন খুব কাছ থেকে রাহীকে দেখার সুযোগ হয়েছে তার। রাজিনের কাছে রাহি অনন্য, পরিশ্রমী পেস বোলার। রাজিন বলছিলেন, ‘রাহির তুলনা সে নিজে, সে অনন্য। জাতীয় ক্রিকেট লিগের সময় দেখেছি নাজমুলের (নাজমুল হোসাইন) তার বোলিং নিয়ে কাজ করেছে। সে সব সময় নিজের বোলিংয়ের উন্নতি করতে চায়, তার জন্য প্রচুর ঘাম ঝরাতেও প্রস্তুত। তার পরিশ্রমের কারণেই সে এতোদূর আসতে পেরেছে।’

বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা রাহিকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে রাহিই একমাত্র বোলার যে বলটা করার আগে বলতে পারবে যে সে এটি ইনসুইং করাচ্ছে বা আউট সুইং করাচ্ছে। যা অন্য কেউ পারে না, অন্যদেরটা হয়ে যায় সম্ভবত।’

রবি পেসার হান্ট থেকে উঠে আসা পেস বোলার এবাদত হোসাইন এখন বাংলাদেশ টেস্ট দলের নিয়মিত মুখ। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে ছিলেন এবাদত। ২০১৬ সালে রবি পেসার হান্ট থেকে তার ক্রিকেটে আসা। ঘণ্টায় তিনি ১৩৮/৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করতে পারতেন বলে আলাদা নজড় কেড়েছিলেন আকিব জাভেদের। তার শরীরটা গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বোলার হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন আকিব জাভেদ।

আকিভ জাভেদ বলেছিলেন, ‘এবাদত ঘণ্টায় ১৩৮/৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করতে পারে। শরীরটা গড়ে তুলতে পারলে ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বোলার হবে।’

বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে এসে এবাদত হোসাইন খুব দ্রুত দেশের প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। সেজন্য তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছিল। তাকে সহযোগিতাও করেছিলেন সিলেট বিভাগীয় দলের কোচ খেলোয়াড় সহ অনেকেই।

রাজিন সালেহ এবাদতকেই কাছ থেকে দেখেছেন, সিলেটের হয়ে জাতীয় ক্রিকেট লিগে খেলেছেন এক সাথে। রাজিন তাকে কোচিং করিয়েছেন, রাজিন বলছিলেন, ‘আসলে সে এক ভিন্ন গ্রহ থেকে এসেছিল, তার জগত আলাদা। তবে এবাদতও খুব পটেনশিয়াল একজন পেস বোলার, শুরুতে একটু মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়েছিল। সেজন্য তাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। আমাদের সিলেট দলের কোচ শুরু দিকে খুব বেশি সাহায্য করেছিল। ক্রিকেটাররা তাকে অনেক সাহায্য করেছিল মানিয়ে নিতে। সে খুব পরিশ্রমী একজন পেস বোলার। তার কাছে প্রত্যাশার মাত্রাটা একটু বেশি, সে ঘন্টায় ১৩৮/৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করতে পারে। সে অনেক লম্বা হওয়াতে বাড়তি এডভান্টেজ পাবে উইকেট থেকে।’

রাজিন বিস্তারিত করে বলছিলেন,‘শুরুতে সে ঠিক জায়গায় বল ফেলতে পারত না, তার বল বেশি শট হয়ে যেত মাঠে তখন সে আমার দিকে তাকাত, অলকের (অলক কাপালি) দিকে থাকাত। সে জোড়ে বল করছে কিন্তু লাইন লেন্থ ঠিক থাকছে না। আমরা তাকে বলে দিতাম কোথায় কি করতে হবে। আসতে সে মানিয়ে নিয়েছে। সে খুব যোগ্য বোলার। বাংলাদেশ দলে সে ভাল করবে।’

এবাদত হোসাইন এখনো বাংলাদেশের হয়ে ৬টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। সাদা পোশাকে নিয়মিত হলেও এখনো লাল সবুজের জার্সি গায়ে জড়াতে পারেননি।

সৈয়দ খালেদ আহমেদও লাল বলের ক্রিকেটে এখনো বাংলাদেশ দলের অন্যতম পছন্দ। দীর্ঘ দেহি এবং বল খুব বাউন্স করাতে পারেন এই পেসার। টেপ টেনিস বল ক্রিকেট দিয়ে তার ক্রিকেটের যাত্রা শুরু। টেপ টেনিস বলে প্রচুর খ্যাপ খেলে ভেড়াতেন খালেদ। টেপ টেনিস বলে খুব জোরে বল করতে পারতেন বলে নামের সাথে বুলেট যোগ হয়েছিল, এরজন্য তিনি সিলেটের ক্রিকেটে ‘বুলেট খালেদ’ নামে পরিচিতি লাভ করেন।

টেপ বলে খেলার পাশাপাশি ক্রিকেট বলেও খেলতেন। সিলেট প্রথম বিভাগ লিগে যখন ভাল করছিলেন তখন টেপ বলে খেপ খেলা কমিয়ে দেন, ধীরে ধীরে খ্যাপ ছেড়ে ক্রিকেট বলের খেলায় মনোযোগ দেন।

সিলেটের গ্রিন সিলেট ক্রিকেট একাডেমিতে তার ক্রিকেটের হাতেখড়ি। তার উঠে আসার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান গ্রিন সিলেট ক্রিকেট একাডেমির কোচ রানা মিয়ার। রাজিন সালেহ তাঁর বন্ধু রানা মিয়াকে বেশি কৃতিত্ব দেন। কোচ রানাও তার শিষ্য খালেদের এমন উন্নতিতে বেশ খুশি। রানা বলছিলেন, ‘আসলে খালেদ এতোদূর যাওয়াতে আমাদের একাডেমিরই সুনাম হয়েছে। আসলে তার এমন উন্নতিতে আমি অনেক খুশি। আমি ছাড়াও সিলেট বিভাগীয় দলের কোচ ইমন ভাইও তাকে অনেক সাহায্য করেছে, খালেদের উঠে আসার পিছনে ইমনে ভাইয়েরও অবদান আছে।’

রানা আরও বলছিলেন,‘ছয় সাত বছর আগে ইমরান আলী এনাম খালেদকে আমার  একাডেমিতে নিয়ে আসে। সে খুব জোরে বল করতে পারত। তাকে সিলেট প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে আমি যখন মোহামেডানে খেলাই, সে জিমখানার বিপক্ষে ৫ উইকেট নিয়েছিল। তার বলে তখনো অতিরিক্ত বাউন্স করত। এটা দেখে মনে হয়েছিল যে অনেক দূর যাবে, ভবিষ্যতে ভাল কিছু করবে। সিলেট লিগে তার বল খেলতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছিল সিলেটের অনেক নামকরা ব্যাটসম্যানদের। সাথে তার গতি তো ছিল।’

খালেদ আহমেদের ক্রিকেটে সাফল্য পাওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে ডিসিপ্লিন মেনে চলা। খালেদ আহমেদ সব সময় ডিসিপ্লিন মেনে চলতেন। যখন তিনি দেখেছিলেন যে ক্রিকেট বলে ভাল করছেন তখন খেপ খেলা ছেড়ে দেন। তার কোচ রানা বলছিলেন, ‘খালেদের সাফল্যের মূলমন্ত্র হচ্ছে ডিসিপ্লিনড ওয়েতে চলাফেরা করত। নিয়মকানুন মেনে চলত, ক্রিকেট বলে সাফল্য পাওয়ার জন্য টেপ বলে খেপ খেলা বাদ দিয়ে দেয়।’

খালেদ আহমেদের কোচ রানা মিয়া আশাবাদী যে তার শিষ্য অনেক বাংলাদেশ দলকে সার্ভিস দিয়ে যাবে।

বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে দুইটি টেস্ট ম্যাচ খেলার পর হাটুর ইনজুরিতে পড়েন খালেদ। তার জন্য তাকে হাটুতে অপারেশন করাতে হয়েছিল। ইনজুরি কাটিয়ে ফিরতে সময় লেগেছিল প্রায় এক বছর। দীর্ঘ এক বছর পর ঠিক সময়ে মাঠে ফিরতে পারেননি করোনার কারণে, লকডাউন কাটিয়ে যখন সব কিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছিল তখন রাজিন সালেহ অধীনে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এক সপ্তাহ একটি ক্যাম্প করেন খালেদসহ সিলেট বিভাগীয় দলের ক্রিকেটাররা। সেই ক্যাম্প দিয়ে নিজেকে ফিরে পাওয়ার মিশন শুরু করেন খালেদ। এখন তিনি পুরোপুরি ফিট এবং আছেন বর্তমান বাংলাদেশ টেস্ট দলে।

এক বিভাগ থেকে জাতীয় দলের তিন পেস ভরসা? কিভাবে সম্ভব? আবু জায়েদ রাহিই খোলাসা করলেন ব্যাপারটা। টাইগার দলের টেস্ট আক্রমণের মূল অস্ত্র রাহি মনে করেন, সিলেট বিভাগ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পেসারদের নিয়মিত সুযোগ দিচ্ছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।

চট্টগ্রামে অনুশীলনের ফাঁকে রাহি গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকাালে বলেন, ‘প্রথমে সিলেট ডিভিশনকে ধন্যবাদ জানাতে হবে আমাদের। কারণ হলো সিলেট ডিভিশনে যখন আমরা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলি, তখন আমাদের অনেক প্রায়োরিটি দেয়। অনেক সময় দেখা যায় যে, আমরা তিনটা পেস বোলারই খেলছি। অনেক সময় নিয়ে বোলিং করছি। আমি আগেও বলছি যত বেশি বোলিং করব, তত বেশি শিখব।’

নিজ বিভাগের দুই সতীর্থকে নিয়ে রাহি বলেন, ‘এবাদত, খালেদ আগে বেশি বোলিং করতে চাইতো না। এখন আমরা যখন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলি, তখন আমরা চাই অনেক বোলিং করতে। নিজেদের ভেতরে একটা প্রতিযোগিতা আছে। আমার মনে হয়, তিন পেসার বিশেষ করে টেস্টে আসার পেছনে সিলেট বিভাগে আমাদের অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়টিই আসল। এজন্যই আমরা এই জায়গায় আসতে পেরেছি।’

রাজিন সালেহ বিশ্বাস সিলেটের এই তিন পেসার দীর্ঘ দিন জাতীয় দলকে সার্ভিস দিতে পারবেন। কঠোর পরিশ্রম করার যে সামর্থ্য তাদের আছে তাতে তারা অনেক দিন টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের জায়গা ধরে রাখতে পারবে, ‘সিলেটের এই তিন পেসার প্রতিভাবান, কঠোর পরিশ্রমী। তাদের যে যোগ্যতা আছে, তারা অনেক দিন বাংলাদেশ দলকে সার্ভিস দিতে পারবে। আমি আশা করি, তারা দীর্ঘ দিন বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলবে। এবং ভাল করবে। তাদের জন্য শুভ কামনা।’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...