ক্রিকেট মাঠে দ্রোহের প্রকাশ

ওই বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ‘গণতন্ত্র হত্যা’র প্রতিবাদ জানিয়ে কালো আর্মব্যান্ড পড়ে খেলতে নেমেছিলেন হেনরি ওলোঙ্গা ও অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। এক শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গ মিলে ক্রিকেট দুনিয়ায় সেদিন দেখিয়েছিলেন সাহসী এক প্রতিবাদ।

কী বলবেন সময়টাকে? একটা সোনালী যুগের শেষের শুরু? নাকি একটা নতুন যুগের সূচনা? তবে এক কথায় বলা ভালো, ক্রিকেট মাঠের সেরা বিদ্রোহ।

দমনপীঢ়নের রাজনীতি নিয়ে প্রতিবাদ যুগে যুগে হয়েছে। খেলার মাঠেও সে প্রতিবাদ দেখা গেছে। তবে ক্রিকেট মাঠে রাজনীতির এমন প্রকাশ আগে-পরে আর দেখেনি বিশ্ব। ২০০৩ বিশ্বকাপে সেই কাজটিই করেছিলেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গা।

জিম্বাবুয়েতে সেটা ছিলো এক উত্তাল সময়। সাধারণ মানুষের জন্য একসময় বিপ্লব করে সরকার গড়েছিলেন রবার্ট মুগাবে। আবার সেই রবার্ট মুগাবে সরকারেরই স্বৈরাচারিতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্র হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিলো জিম্বাবুয়ের জনগণ। ঠিক তখনি পর্দা উঠছিলো ২০০৩ বিশ্বকাপের। প্রথমবারের মতো আয়জক দেশ হিসেবে ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে জিম্বাবুয়ে।

আর এটাকেই মঞ্চ হিসেবে নিয়েছিলেন ক্রিকেটাররা। ওই বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ‘গণতন্ত্র হত্যা’র প্রতিবাদ জানিয়ে কালো আর্মব্যান্ড পড়ে খেলতে নেমেছিলেন হেনরি ওলোঙ্গা ও অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। এক শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গ মিলে ক্রিকেট দুনিয়ায় সেদিন দেখিয়েছিলেন সাহসী এক প্রতিবাদ।

সেই সময়টারই স্মৃতিচারণ করছিলেন ওলোঙ্গা। বলছিলেন, সেটা ছিলো সত্যিকারের এক পরিকল্পিত বিদ্রোহ।

১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১০। হারারেতে নামিবিয়ার বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি জিম্বাবুয়ে। ড্রেসিং রুমে দেখা গেলো কালো আর্মব্যান্ড পড়েছেন দুই সিনিয়র ক্রিকেটার হেনরি ওলোঙ্গা ও অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার! সবাইকে জানালেন, ‘জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্র হত্যার শোক হিসেবেই আমরা এটি পড়েছি!’

অবশ্য তাঁদের এই পরিকল্পনা ছিলো বিশ্বকাপেরও এক মাস আগের! অ্যান্ডিকে প্রথম ফোন করেন ওলোঙ্গা। বললেন, ‘চলো আমরা একটি ক্যাফেতে দেখা করি। সেও উত্তরে জানালো ঠিকাছে দেখা করবো। ওলোঙ্গা অ্যান্ডিকে জানালেন, আমি গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপারে কথা বলবো। কাউকে না কাউকে তো দেশের এই কঠিন সময়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে সবার পাশে।’

দু জনই অবশ্য জানতেন এমন কিছু করলে পরিণতি নিশ্চয়ই ভালো হবে না। এই পরিকল্পনার ব্যাপারে ওলোঙ্গা বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে আমি ঠিক কাজটি করছি। আমাকে আমার নীতিতে স্থির থাকতে হবে, সেটা যে বিষয়ই হোক না কেনো। এর মাধ্যমে অন্তত আমার কোনো কিছুর জন্য অনুশোচনাবোধটা থাকবে না।’

পরদিন সকালে ড্রেসিং রুমে ম্যাচের আগে তাঁদের এমন কান্ড দেখে দু একজন তো বিরূপ মন্তব্য করেই ফেলেছেন, তবে সেটা হাতে গোনা দুয়েক জন। এরপর ওলোঙ্গা ও অ্যান্ডি টিম ম্যানেজমেন্টকে বার্তা দিলো প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তাঁদের এই কর্মকান্ড প্রকাশ করা হোক!

তাঁদেরকে তখন সরাসরি নিয়ে যাওয়া হলো বোর্ডের সিইও ভিন্স হগের কাছে। ওলোঙ্গা ও ফ্লাওয়ার তখন এই প্রতিবাদের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে ফেলেছেন। যে করেই হোক তাঁরা এর প্রতিবাদ জানিয়ে ম্যাচ খেলবে। অবশ্য দু’জনেই জানতেন এর কারণে অনেক বড় সমস্যায়ও পড়তে পারেন।

প্রথমে ব্যাট করে ২ উইকেটে ৩৪০ রান সংগ্রহ করে জিম্বাবুয়ে। যেখানে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার খেলেন ৩৯ রানের এক ইনিংস। ওলোঙ্গা বলেন, ‘অ্যান্ডি আর্মব্যান্ড পড়েই ব্যাট করছিলো কিন্তু আমি তখনো মাঠে প্রবেশ করিনি তাই যখন মাঠে পা দিচ্ছিলাম আমার জন্য এটা একটা বিশেষ মূহুর্ত ছিলো। পরিস্থিতিও ভীতিকর মনে হচ্ছিলো কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম না এর কারণে তৎক্ষনাৎ কিছু ঘটবে কিনা। অবশ্য বিশ্বকাপেই সবার চোখ থাকায় এটা জানতাম যে মিডিয়ার সামনে কিছুই হবেনা আমাদের।’

ওই ম্যাচে জিম্বাবুয়ে জয় পেলেও মিডিয়া সহ দর্শকদের দৃষ্টিটা ছিলো সেই আর্মব্যান্ড কান্ডে। তিনি বলেন, ‘বেশ ভালোভাবেই হোটেলে ফিরে আসলাম। জানতাম আমরা কঠিন জায়গায় হাত দিয়েছি। তবে নিজের মধ্যে স্বস্তি ছিলো যে আমরা এটা করতে পেরেছি। এটা ছিলো একধরনের অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স। কারণ আমাদের সমস্ত আবেগ, ঝুঁকি সব কিছুই ভিন্ন রকম লাগছিলো যখন আমরা কালো আর্মব্যান্ড পড়ে মাঠে প্রবেশ করলাম।’

অবশ্য এই দুইজনের এমন কান্ডে আইসিসির কাছে রিপোর্ট করার সিদ্ধান্ত নেয় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বোর্ড (জেডসি)। তখন পুরো বিশ্বব্যাপি মিডিয়ার সমর্থন ছিলো ওলোঙ্গা-ফ্লাওয়ারদের পক্ষে। বোর্ড থেকে সিদ্ধান্ত নিলো ফ্লাওয়ারকে দল থেকে বাদ দেওয়ার।

ওই সময়ে জিম্বাবুয়ের সবচেয়ে বড় তারকাও যে ছিলেন তিনি! ফ্লাওয়ারকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হবার আগেই সিনিয়র ক্রিকেটাররা বলেন, ‘যদি অ্যান্ডিকে বাদ দেওয়ার হয় তাহলে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়াবে সব সিনিয়র ক্রিকেটাররা!’

সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্রিকেটারদের এমন প্রতিবাদে অবশ্য দলে টিকে যান অ্যান্ডি। তবে, ফর্মহীনতার অজুহাত দিয়ে দল থেকে বাদ দেওয়া হেনরি ওলোঙ্গাকে।

যদিও তিনিও জানতেন এই বাদ পড়ার পেছনে মূল কারণ কি। প্রধান নির্বাচক ম্যাক্স ইব্রাহিম এমনও বার্তা দিয়েছিলেন যে ১২তম খেলোয়াড় হিসেবেও ওলোঙ্গাকে বিবেচনা করা হবে না। ওলোঙ্গা বলেন, ‘অবশ্য আমি জানি না এই সিদ্ধান্ত ঠিক কোথা থেকে নেওয়া হয়েছে বা কারা আদেশ করেছে। কারণ তাঁর উপরে তখন অনেকেই ছিলো। ‘

তিনি আরো বলেন, ‘অ্যান্ডি এবং আমি মাথায় লাল বা কালো স্যুইটব্যান্ড বাঁধতে চেয়েছিলাম। তবে কর্তৃপক্ষ এটাতে নিষেধাজ্ঞা দেয় এবং হগের কাছ থেকে একটি চিঠিও আসে আমাদের কাছে। পরিবেশ এমন ছিলো যে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি বুঝতে পারছিলামা আমকে স্কোয়াড থেকে বাদ দিয়ে হয়তো ১৩জন নিয়েই বিশ্বকাপে থাকবে দল। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের এই পদক্ষেপ দেখিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে যে তারা আমাদের প্রতি সমর্থন না দেখিয়ে আমাদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।’

তবে ওলোঙ্গাকে আরেক ম্যাচে সুযোগ দেওয়া হয়। সেটাও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সুপার সিক্সের ম্যাচে। অবশ্য এর পেছনেও ছিলো বড় চাল! তিনি বলেন, ‘এটা করার কারণ শুধুমাত্র সবাইকে দেখানো যে এখানে কোনো রাজনৈতিক ব্যাপার নেই। আমি চেয়েছিলাম আমার দেশের হয়ে অন্তত আরো একটি বার মাঠে নামতে। আমাকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো তবে আমার তখন জীবন হুমকির মুখে ছিলো! এমনকি শুনেছিলাম নিরাপত্তার জন্য গোপনে সেখানে পুলিশও পাহারায় থাকবে!’

এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে লন্ডনে ম্যাচ শেষেই মিডিয়ায় ওলোঙ্গা বার্তা দেন ক্রিকেটকে বিদায়ের। এরপর সব ক্রিকেটাররা টিম বাসে গেলেও বোর্ডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ওজিয়াস বিভুতে ওলোঙ্গাকে আলাদা যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন! অবশ্য এই ব্যাপারে কেউই প্রতিবাদ করেনি।

ওলোঙ্গা বলেন, ‘আমাকে আমার বিমানের টিকেট দিয়ে বলা হয়েছিলো নিজের মতো করে চলে যেতে। এমনকি আমার হোটেল বিলও আমাকে মেটাতে বলা হয়! সিকিউরিটি অফিসার আমার প্রতি দয়া দেখিয়ে তাঁদের গাড়িতে (যা টিম বাসের সামনে ছিলো) আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেয়!’

তিনি আরো বলেন, ‘পোর্ট এলিজাবেথ থেকে জোহানেসবার্গে ফেরার পর আমি সবাইকে আবেগপ্রবণ হয়েই বিদায় জানালাম। ডগলোস হন্ডো আমার ক্রিকেট কিট বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিলো। আমার কিছু কাপড়, জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের জার্সি আর আমার ল্যাপটপ ছিলো।’

কিন্তু এই প্রতিবাদের কী কোনো মূল্য ছিলো? এতে কী আদৌ কোনো কাজ হয়েছে। ওলোঙ্গা মনে করছেন, ‘হ্যাঁ, এটার মূল্য ছিলো। এটা আমাকে শিখিয়েছে কারো বিশ্বাসের জন্য প্রতিপক্ষের বিপরীতে লড়াই করার সাহস অর্জনের। আমাদের কর্মকাণ্ডের কারণেই পুরো বিশ্বের মিডিয়া সেখানে ফোকাস করেছিলো। এমন একটি দেশ যেখানে মানুষ খুব কষ্টে জর্জরিত ছিলো। আমরা হয়তো বড় কোনো পরিবর্তন করতে পারিনি। কিন্তু আমারা কিছু মানুষের জন্য আশার আলো দেখাতে পেরেছি। আমরা অনেকের হয়ে কথা বলেছিলাম যা তাঁরা সহজে বলার সাহস করতে পারছিলো না। আমি কখনোই বলবো না আমি ভালো মানুষ, তবে আমি আশা করি আমি কিছু করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছি।’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...