তামিম ইকবাল, ড্যান্সিং ডাউন দ্য ট্র্যাক

তামিম ইজ অল অ্যাবাউটট স্টেটটমেন্ট। পোর্ট অব স্পেন থেকে লর্ডস হয়ে মিরপুর কিংবা চট্টগ্রামের সেই কুক্ষণের প্রেস কনফারেন্স থেকে আজকের সামাজিক মাধ্যমের স্ট্যাটাস, সবখানেই তামিম একটা স্টেটমেন্ট দিয়ে যেতে চেয়েছেন।

তামিম ইকবাল খান, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সব থেকে বড় পরিবর্তনের প্রধান চরিত্র জানিয়ে দিলেন, সব চাওয়ার পরেও পাওয়া হয় না, চাইলেই ঘরে ফেরা যায় না।

তামিম ইজ অল অ্যাবাউটট স্টেটটমেন্ট। পোর্ট অব স্পেন থেকে লর্ডস হয়ে মিরপুর কিংবা চট্টগ্রামের সেই কুক্ষণের প্রেস কনফারেন্স থেকে আজকের সামাজিক মাধ্যমের স্ট্যাটাস, সবখানেই তামিম একটা স্টেটমেন্ট দিয়ে যেতে চেয়েছেন।

তামিমের মূহুর্ত বলতে আমরা বুঝি, ভারতের বিপক্ষে পোর্ট অব স্পেনের ইনিংস, লর্ডসের রেকর্ড গড়া সেঞ্চুরি, এশিয়া কাপের টানা ৪ ফিফটি, টি২০ এর এখন পর্যন্ত একমাত্র সেঞ্চুরি কিংবা ২০১৫-১৯ এর অমানবিক ধারাবাহিকতা। সবগুলো ইনিংসের সাথে জড়িয়ে আছে এক একটা স্টেটিমেন্ট।

২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষের বিধ্বংসী হাফ সেঞ্চুরির সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষের ৩৮ রানের ইনিংস। এমনিতে ওয়ানডেতে ৩৮ রান খুব বড় কোন রান নয়। কিন্তু ইতিহাস বলে তখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সাউথ আফ্রিকার ফাস্ট বোলারদের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করত।

চার-পাঁচটা স্লিপ ফিল্ডারের সাথে গালি-পয়েন্ট রেখে দক্ষিণ আফ্রিকান ফাস্ট বোলারদের বোলিং এবং বাংলাদেশের ইনিংস ১০৫-১১০ রানে গুটিয়ে যাওয়াই ছিলো নিয়মিত দৃশ্য। তামিম সেখানে প্রতিরোধ গড়লেন, ৩৮ রানের থেকেও বড় নতুন বলের ৫৫-৬০ টা বল খেলে ভিত তৈরি করে দেয়া। যার উপরে দাঁড়িয়ে আশরাফুলরা আক্রমণের সুযোগ পেলেন। এই যে আক্রমণাত্মক তরুন তামিমের একই বিশ্বকাপে ভিন্ন রূপ দেখা গেলো, এটা তার নিবেদনের প্রথম পাঠ।

লর্ডস টেস্টে তামিম যখন টিম ব্রেসনান কিংবা গ্রায়েম সোয়ানদের ছিড়েখুঁড়ে ফেলছিলেন, তার পা একবারও নড়ে নি। যায়গায় দাঁড়িয়ে স্পিনারের বল কাভার দিয়ে তুলে মেরেছেন, ফাস্ট বোলারদের লং অনের উপর দিয়ে।

পরের টেস্টেই ওল্ড ট্র‍্যাফোর্ডের ফ্রন্ট ফুটের টিপিক্যাল তামিমের সেঞ্চুরি। একটা স্টেটমেন্ট ‘চাইলেই’ লর্ডসে দ্রুতগতির সেঞ্চুরির রেকর্ড ভেঙে অনার্স বোর্ডে নাম লেখা যায়। চাইলেই ওল্ড ট্র‍্যাফোর্ডে ইংরেজদের আদর্শ টেস্ট ব্যাটিং শেখানো যায়।

মিরপুর, বুলাওয়ে, দুবাই, সবখানেই এক একটা স্টেটমেন্ট। ১৫৪ রান করে রেকর্ড চেজে যেমন স্টেটমেন্ট থাকে, ভাঙা হাতে এক বল খেলেও থাকে একই স্টেটমেন্ট।

তামিমের পরিকল্পনা নিয়ে সমালোচনা করা যায় কিন্তু পরিকল্পনার স্বচ্ছতা নিয়ে সমালোচনার সুযোগ তিনি রাখেন নি। তার বড় উদাহরণ, বাংলাদেশের ওয়ানডে দল। তামিম জানতেন তিনি কি চান, তার জন্য কোন পজিশনে কাকে দরকার, তিনি তাদেরকেই বারবার খেলিয়েছেন। ফলে, তামিমের বিদায়ের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ওয়ানডে দলের একাদশে ১০ টা পজিশনই সেটেলড ছিলো। সেটেলড পজিশনের একটা ভাঙলো তার অবসরে।

যেখান থেকে শুরু করা গেলো, তার ব্যাখ্যা দিয়েই শেষ করা যাক। তামিম প্রথম বাংলাদেশি খেলোয়াড় যিনি প্রতিপক্ষের স্লেজিংয়ে কোঠরে ঢুকে না গিয়ে, মুখে এবং ব্যাটে জবাব দিয়েছেন। ক্রিকেট যতটা টেকনিকের, তার থেকেও বেশি মনস্তাত্ত্বিক। তামিমের আগে বড় দলগুলোর বিপক্ষে বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ এখানে মার খেয়েছে।

আন্দ্রে নেল, ফ্লিনটফ কিংবা ব্রেট লিরা প্রতিটা বলের পরে বাংলাদেশি ব্যাটারদের মুখের কাছে পৌছে জবাব চেয়েছেন। ব্যাটাররা দিতে পারি নি। সম্ভবত ব্যাট কথা বলে নি বলেই জবাব দেয়া হয় নি। অথবা, জবাব দিতে পারি নি বলেই ব্যাট কথা বলে নি, কে জানে!

তামিম কথা বলা শুরু করলেন, ব্যাটে এবং মুখে। ছাড় দেন নি জহির খানকেও। ধারাভাষ্যকার বলে উঠলেন, ‘this young man is not showing any respect to the senior statesman.’ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে থিতু হবার পরে সাকিবও সেই মিছিলে যোগ দিলেন। এরপরে এলেন মুশফিক, রিয়াদরা।

একটা জেনারেশন তৈরি হলো, যারা প্রতিপক্ষের ভয়ে কুঁকড়ে যায় না, কথার জবাবে কথায় জানান দেয়, ব্যাটে জানান দেয়। পরের জেনারেশনগুলো শিখলো, ক্রিকেটে কেবল ভালো খেলাই যথেষ্ট নয়, প্রতিপক্ষ যেন আপনার উপরে চড়ে বসতে না পারে, সেটাও নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশ এখনও ক্রিকেট শক্তিগুলোর মধ্যে বেশ বড় কোন হনু হয়ে ওঠে নি। কিন্তু প্রতিপক্ষ বাংলাদেশের বিপক্ষের ম্যাচকে এখন আর সহজভাবে নেয়ার সাহস করে না। তারা জানে ব্যাটে-বলে কিংবা কথায়, লড়াই আর একতরফা হবে না। স্টেটমেন্টের শুরুটা তামিমের হাত ধরে।

তামিম সম্ভবত সবথেকে বড় স্টেটমেন্টটা দিয়ে গেলেন অবসর ঘোষণার সময়। তামিমের অবসর ঘোষণার সময়কে পছন্দ করা যায় কিন্তু আরও একবার তার নিবেদন এবং পরিকল্পনার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রইলো না। কোচ, ম্যানেজমেন্ট থেকে ফর্ম কিংবা শরীর সবকিছুই বিপক্ষে চলে গিয়েছিলো কিন্তু এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, তামিম বিশ্বকাপ খেলতে পারতেন না।

খুব সহজেই তিনি এশিয়া কাপ, বিশ্বকাপ খেলে অবসর নিতে পারতেন। কিংবা অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিয়ে আরো বছর দুয়েক খেলা চালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু বিশ্বকাপের মাত্র তিনমাস আগে ঘোষনা দিলেন, তিনি আর খেলছেন না। দেড় বছর সময়ের ব্যবধানে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আগে আরও একবার জানালেন, হলো না ফেরা আর।

এমন সময়ে অবসরের ঘোষনা দিতে নিজের পরিকল্পনার উপরে যথেষ্ট নিবেদন থাকতে হয়, আস্থা থাকতে হয়। আর থাকতে হয় একটা স্টেটমেন্ট দিয়ে যেতে চাওয়ার চেষ্টা। আজ থেকে তামিমকে নিয়ে আর কোন সমালোচনা নয়। বিদায় জানানোর পরে, একজনকে মনে রাখা যায় কেবল তার ভালো কাজগুলোর জন্য। পছন্দ করুণ বা নাই করুণ, তামিমকে বাংলাদেশ ক্রিকেট মনে রাখতে বাধ্য।

Share via
Copy link