এক রাজসিক ব্যাটসম্যান

পাকিস্তানের হয়ে একদিনের ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরিও তাঁর। স্টাইলিশ মজিদ খান এর খেলা কিছুটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। অমন দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং ভোলার উপায় নেই। ক্রিকেট আজ বাহুবলীদের প্রদর্শনী আর পরিসংখ্যানবিদদের কচকচানি । সেখানে মজিদের সৌখিনতা ব্রাত্য। কিন্তু রাজার মেজাজ আর শৈলীকে প্রত্যক্ষদর্শীরা কীভাবে ভুলবে!

১৯৩২ সালে ভারত যখন টেস্ট অঙ্গনে পা রাখলো তখন সে দলে ছিলেন তিন ফাস্ট বোলার। মোহাম্মদ নিসার, অমর সিং আর জাহাঙ্গির খান। লর্ডসের সেই প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে উইকেট না পেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে চার উইকেট নেন এই জাহাঙ্গির খান। পরে ১৯৩৬ সালেও তিনি ইংল্যান্ড সফরে ভারতের হয়ে টেস্ট খেলেন। খেলেছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়েও। তারপর দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয় তাঁর ভূখণ্ড।

এই জাহাঙ্গির খানের পুত্র হলেন পাকিস্তানের ওপেনিং ব্যাটসম্যান শৌর্যময় ব্যাটিং শৈলীর অধিকারী মজিদ খান। মাজিদের মায়েরা তিন বোন। তিন বোনের তিন সন্তান হলেন জাভেদ বার্কি, মাজিদ খান আর ইমরান খান। তিনজনেই টেস্ট ক্রিকেটার। সব মিলে এই পরিবারের রক্তে ক্রিকেট মিশে আছে।

শৈশব থেকেই ক্রিকেট হয়েছিল মাজিদের ধ্যানজ্ঞান। পেস বোলার আর স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান হিসাবে তাঁর নামডাক হয়। মাত্র ১৫ বছর বয়সে মাজিদ প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন। আবির্ভাবেই লাহোরের হয়ে তিনি ১১১ রান করেন আর বল হাতে নেন ৬৭ রানে ৬ উইকেট।

১৯৬৪ সালে টেস্ট দলে সুযোগ পান মাজিদ। ফাস্ট বোলার হিসাবে তাঁর সুযোগ পাওয়া। প্রথম ম্যাচেই তিনি নেন বিল লরি ও ব্রায়ান বুথের উইকেট। যদিও মাজিদের বোলিং নিয়ে চাকিং এর অভিযোগ ওঠে।

মজিদ বোলিং ছেড়ে মন দেন কেবলমাত্র ব্যাটিংয়ে। রক্তে যার ক্রিকেট তিনি যেখানে হাত ছোঁয়াবেন তাই সোনায় পরিণত হবে। আর তাই ব্যাটিংয়ে তিনি সত্যিই এক শিল্পী হয়ে উঠলেন।

১৯৬৫ সালে জন রিডের নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ড এল পাকিস্তান সফরে। মজিদ ও হানিফ মহম্মদ ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ২১৭ রান তুললেন। মজিদ একাই ৮০ রান। ১৯৭৩ সালে অস্ট্রেলিয়ায় লিলি, ওয়াকার, গিলমোর এর বিরুদ্ধে মেলবোর্নে তিনি করেন এক অসামান্য শৌর্য্যময় ১৫৮ রান। সেরা ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে এক অনন্য ইনিংস।

অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সফরে তাঁর কীর্তিতে মোহিত হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ডাক আসে শেফিল্ড শিল্ড খেলার। কুইন্সল্যান্ডের হয়েও তিনি সাফল্য পান। ৪৯২ রান করেন অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে। ১৯৭৩ সালে যখন ইংল্যাণ্ড পাকিস্তান সফরে আসে তখন মজিদ দলনায়ক নির্বাচিত হন। তিন টেস্টের সিরিজ ড্র হয়। মজিদ করাচি টেস্টে করেন ৯৯।

১৯৭৬-৭৭ সাল ছিল মজিদ খানের সেরা সময়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়ে রবার্টস, হোল্ডিং সমৃদ্ধ ভয়ানক ক্যারিবিয়ান পেস ব্যাটারীর মুখোমুখি হয়ে মজিদ যেন সর্বোত্তম ছন্দে পৌঁছান।

ব্রিজটাউন টেস্টে তিনি করেন ৮৮ ও ২৮, পোর্ট অফ স্পেনে করেন ৪৭ ও ৫৪, জর্জটাউনে করেন ২৩ ও ১৬৭ জর্জটাউনে আবার বল হাতে নিয়ে ৪৫ রানে ৪ উইকেট নেন। চতুর্থ টেস্ট পোর্ট অফ স্পেনে করেন ৯২ ও ১৬। ওই সিরিজে মজিদ ৫৩০ রান করেন। শেষ টেস্ট কিংস্টনে রান পাননি তেমন। কিন্তু উইকেটরক্ষক ওয়াসিম বারি চোট পাওয়ায় ধরতে হয় দস্তানা। কিন্তু সেখানেও দুরন্ত ফিল্ডার মাজিদ নিয়ে বসেন চার চারটি ক্যাচ।

মজিদের ব্যাটিং মানেই চৌকশ এক খেলোয়াড়ের অনায়াস শিথিল সৌন্দর্যবিলাস। পরিসংখ্যান উল্টে এমন খেলোয়াড়ের পরিমাপ সম্ভব নয়। আরও কীর্তি মজিদের রয়েছে। নিউজিল্যাণ্ড এর বিপক্ষে তিনি লাঞ্চ এর আগে রাজসিক ব্যাটিং প্রদর্শনীর মাধ্যমে শতরান করে এক অনন্য কীর্তি গড়েন। অতীতে ডন ব্র্যাডম্যান, ভিক্টর ট্র্যাম্পার এর মত কীর্তিমানদের সাথে একাসনে বসার গৌরব এভাবেই তিনি অর্জন করেছেন।

রাজার খেলা ক্রিকেটের রাজা এই মজিদ। যার ব্যাটিং শৈলীর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একটি শব্দই প্রযোজ্য – অপূর্ব । ৬২ টেস্টে মজিদ ৩৯৩১ রান করেছেন। গড় ৩৯.৩১, শতরান -৮, অর্ধশতরান -১৯ , ক্যাচ নিয়েছেন ৬৮ টি আর উইকেট ২৭ টি।

পাকিস্তানের হয়ে একদিনের ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরিও তাঁর। স্টাইলিশ মজিদ খান এর খেলা কিছুটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। অমন দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং ভোলার উপায় নেই। ক্রিকেট আজ বাহুবলীদের প্রদর্শনী আর পরিসংখ্যানবিদদের কচকচানি । সেখানে মজিদের সৌখিনতা ব্রাত্য। কিন্তু রাজার মেজাজ আর শৈলীকে প্রত্যক্ষদর্শীরা কীভাবে ভুলবে!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...