বিকেল-বেভানের যুদ্ধ

ইংলিশ বোলারদের তোপে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকা অস্ট্রেলিয়ার স্কোর এক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৮ উইকেটে ১৩৫। ম্যাচের ৩৮তম ওভারের খেলা চলছিল তখন। জয় থেকে তখনও তারা ৭০ রান দুরে। হাতে ছিল মাত্র ২ উইকেট আর ৭৪ বল। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে অজিদের উদ্ধারকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হলেন সেই অ্যান্ডি বিকেল! বিকেলের অবশ্য সৌভাগ্য যে সঙ্গী হিসেবে পাশে ছিলেন ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ফিনিশার মাইকেল বেভান।

২০০৩ সালের দুই মার্চ। বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মুখোমুখি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড। পোর্ট এলিজাবেথে অনুষ্ঠিত দুদলের জমজমাট লড়াই সেদিন ছড়িয়েছিল অ্যাশেজের উত্তাপ। আর বল হাতে অ্যান্ডি বিকেল নামের এক ফাস্ট বোলার সেদিন ঝরিয়েছিলেন আগুন। সেই সর্বগ্রাসী আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছিল ইংলিশ ব্যাটিং লাইন আপ।

পোর্ট এলিজাবেথের সেন্ট জর্জেস পার্কে সেদিন টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৫০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে ইংল্যান্ড করেছিল ২০৪ রান। অথচ মার্কাস ট্রেসকোথিক-নিক নাইটের উদ্বোধনী জুটিতে প্রথম ১০ ওভারে বিনা উইকেটে ৬৬ রান তোলা ইংল্যান্ডের শুরুটা ছিল দারুণ। এমন শুরুর পরও ইংলিশদের অল্প রানে বেঁধে রাখার মূল কৃতিত্বটা ছিল অ্যান্ডি বিকেলের। বিধ্বংসী বোলিংয়ে মাত্র ২০ রানে ৭ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডকে বলতে গেলে একা হাতে ধসিয়ে দিয়েছিলেন সদা হাসিখুশি সোনালি চুলের অধিকারী এই ফাস্ট বোলার।

৬৬ রানের মাথায় নিক নাইটকে (৩০) স্লিপে ডেমিয়েন মার্টিনের ক্যাচ বানিয়ে শুরু। এরপর মাত্র ৭ বলের ব্যবধানে একই ধরনের দুটি লেট আউটসুইঙ্গারে অধিনায়ক নাসের হুসেইনকে (০) বোল্ড আর মাইকেল ভনকে (১) উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন বিকেল। সত্যি বলতে এখনো চোখে লেগে আছে অসাধারণ সেই ডেলিভারি দুটি! একটু পরেই দারুণ খেলতে থাকা ট্রেসকোথিক (৩৭) ম্যকগ্রার একমাত্র শিকারে পরিণত হলে ৭৪ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে রীতিমতো ধুঁকতে শুরু করে ইংল্যান্ডের ইনিংস।

৮৭ রানের মাথায় আবারও বিকেলের আঘাত। এবার তাঁর শিকার কলিংউড (১০)। ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ৯০ রানের জুটি গড়ে প্রাথমিকভাবে বিপর্যয় সামাল দেন অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ (৪৫) আর অ্যালেক স্টুয়ার্ট (৪৬)। দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে এসে দুজনকেই প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠান বিকেল। বিকেলের সর্বশেষ শিকার ছিলেন অ্যাশলি জাইলস (২)।

২০৪ রানের মামুলি পুঁজি নিয়েও সেদিন দারুণ লড়াই করেছিল নাসের হুসেইনের ইংল্যান্ড। অজি টপ অর্ডারের চার ব্যাটসম্যানকে টপাটপ তুলে নিয়ে মূল ধ্বসটা নামিয়েছিলেন অ্যান্ডি ক্যাডিক (৯-২-৩৫-৪)। বিকেলের মত ক্যাডিকও দেখিয়েছিলেন দুর্দান্ত সুইং বোলিংয়ের প্রদর্শনী। অস্ট্রেলিয়ার টপ ও মিডল অর্ডারের নামীদামী ব্যাটসম্যানদের প্রায় সবাই ছিলেন ব্যর্থ। গিলক্রিস্ট (২২), হেইডেন (১), পন্টিং (১৮), মার্টিন (০), সাইমন্ডসদের (০) ব্যর্থতার দিনে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন পাঁচে নামা ড্যারেন লেহম্যান (৩৭)।

ফাস্ট বাউন্সি উইকেটের সুবিধা কাজে লাগিয়ে এবং নিয়ন্ত্রিত লাইন লেংথে বোলিং করে ব্যাটসম্যানদের ক্রমাগত চাপে রাখার কাজটা করেছিলেন দুই অলরাউন্ডার অ্যান্ড্রু ফ্লিন্টফ (৯.৪-১-২৬-০) আর ক্রেইগ হোয়াইট (১০-২-২১-১)। বাঁ-হাতি স্পিনার জাইলসও ২ উইকেট নিয়ে নিজের দায়িত্বটা পালন করেছিলেন ঠিকঠাক।

ইংলিশ বোলারদের তোপে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকা অস্ট্রেলিয়ার স্কোর এক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৮ উইকেটে ১৩৫। ম্যাচের ৩৮তম ওভারের খেলা চলছিল তখন। জয় থেকে তখনও তারা ৭০ রান দুরে। হাতে ছিল মাত্র ২ উইকেট আর ৭৪ বল। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে অজিদের উদ্ধারকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হলেন সেই অ্যান্ডি বিকেল!

বিকেলের অবশ্য সৌভাগ্য যে সঙ্গী হিসেবে পাশে ছিলেন ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ফিনিশার মাইকেল বেভান। অবিচ্ছিন্ন নবম উইকেট জুটিতে দু’জন মিলে গড়েন ৭৩ রানের দুর্দান্ত এক পার্টনারশিপ। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, এই জুটিতে বেভান আর বিকেলের অবদান ছিল সমান সমান। দুই বল বাকি থাকতেই অস্ট্রেলিয়া পেয়েছিল দুই উইকেটের শ্বাসরূদ্ধকর এক জয়। যে জয়ে সুপার সিক্স পর্বটাও নিশ্চিত হয়েছিল অজিদের।

মাইকেল বেভান সেদিন মূলত অ্যাঙ্কর রোল প্লে করেছিলেন। পরিস্থিতির দাবি মিটিয়ে খেলেছিলেন ১২৬ বলে ৭৪ রানের একটি দায়িত্বশীল ও সংযমী ইনিংস। মূলত সিঙ্গেলস ডাবলসে খেলা বেভানের মহামূল্যবান ইনিংসটিতে ছিল পাঁচটি চার ও একটি ছয়ের মার। অপরদিকে, স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করা বিকেলের ব্যাট থেকে এসেছিল তিন বাউন্ডারি ও এক ছক্কায় ৩৬ বলে ৩৪ রান।

জয়ের জন্য শেষ দুই ওভারে অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ছিল ১৪ রান। জিমি অ্যান্ডারসনের করা ৪৯তম ওভারে পর পর দুই বলে একটি ছক্কা ও একটি চার হাঁকান বিকেল। আর তখনই খেলাটা পুরোপুরি ঘুরে যায় অস্ট্রেলিয়ার দিকে। ফ্লিনটফের করা শেষ ওভারের চতুর্থ বলে বাউন্ডারি মেরে নিজের ট্রেডমার্ক স্টাইলে ম্যাচ ফিনিশ করেন মাইকেল বেভান। বলাই বাহুল্য, ব্যাটে বলে অসাধারণ অলরাউন্ড নৈপুণ্য দেখিয়ে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন অ্যান্ডি বিকেল।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...