ব্রাত্য উপত্যকার ‘আকন্দ’

ইতিহাস বড্ডো নাক উঁচু। সেখানে স্থান পাক বিরাট-মহেন্দ্র-সৌরভ-শচীন-রাহুলরা। কিন্তু দিনলিপিতে কোনো বৈষম্য থাকেনা, সে ভালোবেসে যায় সমানভাবে। তাই তো টার্নিং পিচে অনুষ্টুপের মুভমেন্ট গুলো কিংবা রঞ্জির প্রতিদিনকার প্রথম সেশনের স্যুইং বিরোধী ডিফেন্স বা লিভগুলো অথবা কৃষ্ণাপ্পা গৌতমের স্লেজিংগুলোকে ‘ভালোবেসে’ ঠাণ্ডা মাথায় হাঁকানো ওভারবাউন্ডারিগুলো বরং লিপিবদ্ধ হোক কারোর ভালোবাসার রোজনামচায়।

তবুও তো প্রেম জাগে যখন রয় গিলক্রিস্টের ক্যারিবিয়ান মারণঘাতী বাউন্সারগুলোর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে একটা ভাঙাকবজির শ্যামসুন্দর মিত্র বোর্ড প্রেসিডেন্টের হয়ে করে যায় আটানব্বইটা রান। অথবা লালমাটির দেশের খোঁয়ারে পিচে ওয়াসিম জাফরের সেঞ্চুরিগুলো? সেখানেও তো প্রেম ছিলো। ইতিহাস কি সব লিখে রাখে?

ইতিহাসে থাকে রাজত্ব, রাজকাহিনী,ষড়যন্ত্র। কই ইতিহাস তো ভালোবাসা লেখেনা! রাজসিংহাসনের নায়কত্ব থেকে অনেক দূরে আমার আপনার চারপাশের মানুষদের প্রাত্যহিক ভালোবাসা কিন্তু ইতিহাস লেখেনা। সেখানে ব্রাত্য ওয়াসিম জাফর, গোপাল বসু, মনোজ তিওয়ারিরা। সেগুলো বরং লিপিবদ্ধ হোক কোনো এক মেঠো রাখালের বাঁশির সুরে,অথবা ক্রিকেটপ্রেমকে সাম্যবাদ করা কারোর দিনলিপিতে।

সে প্রেমে বুনিয়াদ নেই, ভেদাভেদ নেই। সে প্রেমের জীবন্ত ক্রিজগুলোতে মাঝেমধ্যেই নায়ক হয়ে ওঠে কোনো এক অনুস্টুপ মজুমদার। যে রোদে আমি আপনি বাইরে বেরোতে ভয় পাই,সেই উত্তাপেই এক চুঁচুরাবাসী উত্তপ্ত কোটলায় ৯৯ টা জলবিন্দু স্থাপন করে মূর্ছিত বাংলাকে হাইড্রেশন দেয়।

আগুপিছু করা সেই পায়ের স্টান্সগুলিতে যেখানে বিরাট কোহলি কিংবা উইলিয়ামসনের রাজসিক ইতিহাসের অবয়ব সরে গিয়ে আমি আপনি ঈশ্বরজপ করছিলাম যখন রেলওয়েজের চাকরি প্রত্যাখান করা বছর পঁয়ত্রিশের এক সায়াহ্নসান্নিধ্য পুরুষ উড়িষ্যার দর্শকশূন্য গ্যালারিহীন খোঁয়ারে পিচে ব্যাট করতে নামল, বাংলা রঞ্জি দল তখন ৪৬-৫।

আসলে নোনতা ঘামের আস্বাদে তো কোনো সুখ টান নেই,আছে শ্রমিক শ্রেণীর ব্লু কলারসের মর্যাদাবোধ।আর অনুস্টুপরা বারবার সেই শ্রেণীর প্রতিকী হয়ে ‘এভাপোরেশনে’ নুইয়ে পড়া বাংলাকে টেনে তোলে কখনও ৪৬-৫ থেকে ৩৩২, আবার কখনও লোকেশ রাহুল-অভিমনু মিঠুনদের নীল দম্ভকে চূর্ণ করে ৬৭-৬ থেকে ৩১২।

নেপথ্যে থেকে যায় চুঁচুড়াবাসীর করা যথাক্রমে ১৫৭ আর ১৪৯। অথবা ফাইনালে সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে করা ৬৩! ইনিংস গুলোতে তো রাজসিক সুরের খাম্বাজ নেই। আছে মেঠোসুর, আছে শ্যামলাগীতি, ঠিক যেন ‘A music next to our Door।’

সেই নোনতা ঘামের ইনিংসগুলোতেও তো প্রেম ছিল, ত্যাগ ছিল, ধুলোমাখা সাদা জার্সি ছিল। কই ইতিহাস তো সেগুলো লিখবেনা। কেউ হয়তো জানবেনা রেলওয়েজের চাকরি ছেড়ে বাংলার হয়ে খেলার দমটা। সম্বল বলতে তো স্ত্রীর আইটি সেলের হয়ে কাজ করে জোটা মাইনেটা। আর তো কিছুই নেই।

দু বছর আগে একবার ইন্টারভিউতে অনুষ্টুপকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘Do you repent for not getting chance to Indian Team?’। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘Actually I play for Bengal & Mohun bagan. There’s lots of pride।’

গর্বের কিন্তু উচ্চনিচ হয়না, সব জার্সিই কিন্তু গর্বের। ইতিহাস আর দিনলিপির মধ্যে তফাত কি জানেন? ইতিহাসে লেখা থাকে যুগ বা শতকের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনাপুঞ্জি যার একটা ব্যাকগ্রাউন্ড থাকে, যুদ্ধের মিউজিক থাকে কিংবা ষড়যন্ত্রের লিরিক্স। আর দিনলিপি হলো সহজ সরল ভাষার মেঠো সুর,যেখানে প্রতিদিন নিয়মানুবর্তীক লিপিবদ্ধ হয় প্রাত্যহিক ভালোবাসা গুলো।

ইতিহাস বড্ডো নাক উঁচু। সেখানে স্থান পাক বিরাট-মহেন্দ্র-সৌরভ-শচীন-রাহুলরা। কিন্তু দিনলিপিতে কোনো বৈষম্য থাকেনা, সে ভালোবেসে যায় সমানভাবে। তাই তো টার্নিং পিচে অনুষ্টুপের মুভমেন্ট গুলো কিংবা রঞ্জির প্রতিদিনকার প্রথম সেশনের স্যুইং বিরোধী ডিফেন্স বা লিভগুলো অথবা কৃষ্ণাপ্পা গৌতমের স্লেজিংগুলোকে ‘ভালোবেসে’ ঠাণ্ডা মাথায় হাঁকানো ওভারবাউন্ডারিগুলো বরং লিপিবদ্ধ হোক কারোর ভালোবাসার রোজনামচায়।

ইতিহাসে থাকে পক্ষপাতিত্ব, বৈষম্য।কিন্তু কোনো এক ক্রিকেটপ্রেমীর ছেঁড়া ডায়েরিতে কালো-নীল কালিতে লিপিবদ্ধ করা অনুস্টুপ-মনোজ-ঋদ্ধি-লক্ষ্মীরতনের ইনিংস গুলোতে থাকবে প্রেম। থাকবে সাম্যবাদ। কংক্রিটের সাদাদাগওলা পিচ রাস্তাগুলো যখন রাজত্ব করে পৃথিবীর মানচিত্রে, তখন সেই রাজত্বের অন্তরালে মাঝেমধ্যে মননে ফুটে ওঠে গ্রাম্য মেঠো রাস্তাগুলো। তাঁদের রাজত্ব থাকেনা। স্পর্ধা থাকেনা। থাকে শ্যামল বিনয়ী ভালোবাসা।

অনুষ্টুপ মজুমদার আমার কাছে এটাই। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে বছর পঁয়ত্রিশের অনুস্টুপের জ্বলে ওঠাটাকে আমি ‘ফিনিক্স’ বলবনা। কারণ ইতিহাস তার নিজস্ব রথী-মহারথীর জন্য এই ‘ফিনিক্স’ শব্দের পেটেন্ট নিয়ে রেখেছে।অনুস্টুপ বরং গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘বিশাল ডানাওয়ালা এক থুড়থুড়ে বুড়ো’, যে উড়তে পারেনি এক দশক আগে আর সায়াহ্নে এসে একবার ডানা ঝটকালো শুধু।

ঝিলাম নদীর তীর থেকে একঝাঁক পাখি ঠোঁটে করে নুড়িগুলো যুগব্যাপী জনপদ দূরবর্তী অঞ্চলে ফেলে ফেলে এক নিরালা উপত্যকা তৈরী করে। সেখানে সারিবদ্ধ বনফুলের মতো সাজানো থাকে অম্বর রায়, গোপাল বসু, শ্যামসুন্দর মিত্র, রণদেব বসুরা। দিনলিপি সেই উপত্যকার দিয়েছে নাম ‘ব্রাত্য উপত্যকা’। আর সেই উপত্যকার সাজানো বনফুলদের পাশে ‘আকন্দ’ হয়ে বসে পড়ল একটা অনুষ্টুপ।

তারা নীল জার্সি থেকে ব্রাত্য নয়, তার চেয়েও বেশি ব্রাত্য দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা চোখগুলোর ভালোবাসা থেকে।আসলে চোখে বৈষম্য না থাকলে জীবনখাতায় বোধহয় সাফল্য-ব্যার্থতার হিসেবটা কষা হয় না। আর সেই ছককষহীন জীবন,চোখের দাঁড়িপাল্লা না টেনে ওয়াসিম জাফর কিংবা অনুষ্টুপদের নীল জার্সির ব্রাত্য ট্র্যাজেডি আখ্যা দেয়না, বরঞ্চ আখ্যা দেয় রঞ্জির গর্বের সাদা জার্সির রোমাঞ্চ হিসাবে।

মুম্বইয়ের সাদা জার্সিটা কিংবা বাংলার নীল-হলুদ লোগোটা কি কম গর্বের? জাতীয়তাবাদে কি রাজ্যপ্রেম থাকেনা? তবে কেনো জাতীয়সংগীতে লেখা থাকে, ‘হিমাচল…দ্রাবিড়-উৎকল-বঙ্গ!’ কাজেই ব্রাত্য তারা নীল জার্সি থেকে নয়,ব্রাত্য নাক উঁচু কিছু মানুষদের ভালোবাসা থেকে।

সেই ব্রাত্য উপত্যকার আকন্দের জন্য নাই বা থাকলো ইতিহাস। থাকবে নীল-কালো কালিতে লেখা রঞ্জিপ্রেমীর এক ছেঁড়া ডায়েরি। সেখানে পক্ষপাত নেই। বৈষম্য নেই। আছে প্রেম। আছে সাম্যবাদ।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...