আমার হল সারা

জন্ম ১৯৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল। বাবার নামানুসারে তার নাম রাখা হয় শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। যাকে পরবর্তীতে ক্রিকেটে 'লিটল মাস্টার' হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। ‘লিটল মাস্টার’র পিতা রমেশ টেন্ডুলকার ভারতের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণের বিরাট ভক্ত ছিলেন।

১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক। প্রথম ম্যাচেই আউট হন শূন্য রানে!

শুধু প্রথম না নিজের খেলা দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও আউট হন শূন্য রানেই। তাও কিনা দুই ওয়ানডেতেই নিজের খেলা দ্বিতীয় বলে খালি হাতেই ফেরত গিয়েছেন। প্রথম ওয়ানডে ফিফটির দেখা পেয়েছিলেন ক্যারিয়ারের ৯ম ম্যাচে, প্রথম সেঞ্চুরি করতে লেগেছে ৭৯ ম্যাচ! এমন শুরু নিয়ে কী কাব্য করা চলে? এমন শুরুর পর কেউ ‘সেরা’ হতে পারেন?

পারেন। পারেন; কারণ তিনি শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। ১৯৮৯ সালে শূন্য রান দিয়ে যাত্রা শুরু করা সেই টেন্ডুলকার কালক্রমে সর্বকালের সেরাদের একজন হয়েছেন।

জন্ম ১৯৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল। বাবার নামানুসারে তার নাম রাখা হয় শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। যাকে পরবর্তীতে ক্রিকেটে ‘লিটল মাস্টার’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। ‘লিটল মাস্টার’র পিতা রমেশ টেন্ডুলকার ভারতের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণের বিরাট ভক্ত ছিলেন। তবে ছেলে হতে চেয়েছিলেন পেসার!

পেস বোলিংকে মূল অস্ত্র হিসেবে নিতে ১৯৮৭ সালে সাবেক অজি পেসার ডেনিস লিলির ‘এমআরএফ’ পেস ফাউন্ডেশনে তিনি বোলিংয়ের পরীক্ষাও দিয়েছিলেন! কিন্তু সে যাত্রায় ব্যর্থ হন শচীন। ডেনিস লিলি তাকে সেবার উত্তীর্ণ করেননি। পরবর্তীতে পেসার থেকে হয়ে গেলেন ব্যাটসম্যান, শুধু ব্যাটসম্যান বললেও ভুল হবে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি একসময় বল হাতে নিয়মিত হাত ঘোরাতেন তিনি। বল হাতে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে তার ঝুলিতে আছে ১৫৪ উইকেট! যা নেহাৎ কমও নয়।

শচীনের ব্যাপারে বেশ কিছু মজার ঘটনা আছে যা হয়তো জানেন না অনেকেই! ১৯৮৭ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ভারত বনাম ইংল্যান্ডের ম্যাচে বল বয় ছিলেন শচীন। ব্যাপারটা বিস্ময়কর হলেও সত্যি। ২০০৭ সালে একবার অজি স্পিনার ব্র‍্যাড হগ শচীনকে আউট করেছিলেন এবং ম্যাচ শেষে হগ শচীনের কাছে অটোগ্রাফ চান, শচীন অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় লিখেন, ‘নেভার এগেইন হগ’! সেদিনের পর আর কখনোই শচীনকে আউট করতে পারেননি ব্র‍্যাড হগ।

ব্যক্তিজীবনে শচীন তার বাবাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি কখনোই অ্যালকোহল ব্যক্তি জীবনে জড়াবেন না। একবার ২০১০ সালে শচীনকে শুভেচ্ছাদূত হিসেবে ২০ কোটি রুপির প্রস্তাব দেয় একটি অ্যালকোহল ব্র‍্যান্ড। বাবাকে দেওয়া কথা রাখতেই তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এছাড়া পড়ালেখায় বেশ মনযোগী ছিলেন শচীন। রঞ্জি টুর্নামেন্টে অংশ নিলেও নিজের পড়াশোনার ক্ষতি হতে দেননি শচীন। রঞ্জি দলের সফরের সময় তার ব্যাগে সবসময় পাঠ্য বই থাকত। এমনকি এসএসসি বোর্ড পরীক্ষা আর রঞ্জি একসঙ্গে ম্যানেজ করেছেন তিনি। যদিই শচীন জন্মগতভাবে বাঁহাতি। কিন্তু ব্যাটিং-বোলিং দুটোই করতেন ডান হাতে। তবে লেখালেখিটা তিনি বাঁহাতেই করেন।

১৬ই মার্চ ২০১২, ওয়ানডে এশিয়া কাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ। মিরপুর দর্শককে কানায় কানায় পূর্ণ। সেদিন হাজার হাজার দর্শকের সামনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন শচীন। যে মানুষটা নিজের অভিষেকের প্রথম দুই ওয়ানডেতেই আউট হয়েছিলেন শূন্য রানে, যে মানুষটা তার প্রথম সেঞ্চুরি পেতে খেলেছিলেন ৭৯টি ম্যাচ! সেই মানুষটাই কিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে করলেন সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি।

১৯৯৭ সালে উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন শচীন। শুধু তাই না, প্রথম ভারতীয় হিসেবে উইজডেনের সর্বকালের সেরা একাদশেও জায়গা করে নেন তিনি।

ওয়ানডেতে শচীনের অভিষেক ম্যাচটি কার্টেল ওভারে ১৬ ওভারে নির্ধারিত হয় খেলা। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান সেদিন ৯ উইকেটে ৮৭ রান সংগ্রহ করে। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ৯ উইকেটে ৮০ রান করতে সক্ষম হয় ভারত। সে ম্যাচটা ভারত হারে ৭ রান, সিরিজটাও ২-০তে হারতে হয় সফরকারীদের। একই সফরের টেস্ট সিরিজে অভিষেক হয় আরেক পাকিস্তানি গ্রেট ওয়াকার ইউনুসের! ওয়াকার ইউনুস যখন অবসরে যান তখনও শচীন খেলছেন, ওয়াকার ইউনুস যখন কোচিং করান তখনো শচীন ২২ গজ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন!

২০০৩ বিশ্বকাপে শচীন টেন্ডুলকার রেকর্ড গড়ে ৬৭৩ রান করেছিলেন এবং ম্যান অব দ্যা টুর্নামেন্ট নির্বাচিত হয়। সেবার বিশ্বকাপের পর তখনকার অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড় এক চমকপ্রদ তথ্য ফাঁস করেন! তিনি জানান যে সেবার শচীন নেটে কোনো বলই প্র‍্যাকটিস না করেই ম্যান অব দ্যা টুর্নামেন্টের পুরষ্কার জেতেন!

একবার ১৯৮৭ সালে ভারত সফরে একটি ম্যাচে ইনিংস বিরতির সময় মাঠ ছাড়েন জাভেদ মিঁয়াদাদ ও আব্দুল কাদের। এরপর বদলি হিসেবে পাকিস্তান দলের হয়ে ফিল্ডিংয়ে নামেন শচীন। নিজের আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং মাই ওয়ে’তে শচীন লিখেছেন,‘আমি জানি না ইমরান খান (সাবেক পাকিস্তানি অধিনায়ক ও দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) মনে করতে পারবেন কি না কিংবা তার কোনো ধারণা আছে কি না যে আমি একবার পাকিস্তানের হয়ে ফিল্ডিং করেছিলাম।’

শচীনের মেয়ের নামকরণ করাটাও হয় বেশ অদ্ভুতভাবে! সেই সিরিজের স্পনসর ছিলো ‘সাহারা’। ১৯৯৭ সালে সাহারা জাপে অজিদের বিপক্ষে শচীনের দাপুটে ব্যাটিংয়ে পর পর দুই ম্যাচে জয় ভারত! অধিনায়ক হিসেবে সেটি শচীনের প্রথম ট্রফি জয়। সেই জয়ের পর মেয়ের নাম রাখেন ‘সারা’।

শচীন ২০১৩ সালে অবসর নিলেও তার জার্সিটি অফিসিয়ালি অবসরে পাঠায়নি বোর্ড অফ ক্রিকেট কন্ট্রোল ফর ইন্ডিয়া (বিসিসিআই)। যার জন্য বাধে আরেক বিপত্তি! অভিষেকের পর জাতীয় দলের জার্সিতে শচীনের জার্সি নাম্বার ব্যবহার করে মাঠে নামেন শার্দুল ঠাকুর! আর এতেই বেশ সমালোচনার ঝড় ওঠে। তারপর অবশ্য বিসিসিআই অফিসিয়ালি শচীনের জার্সিটি অবসরে পাঠায়।

খেলেছেন ৪৬৩ ওয়ানডে ম্যাচ (যা কিনা একজন ক্রিকেটার হিসেবে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক ওয়ানডে), রান করেছেন ১৮৪২৬ (ওয়ানডেতে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ মোট রান),  আছে ৪৯টি সেঞ্চুরি (সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিক এখন পর্যন্ত)।

তার বিদায়ের ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩৩০ রান তাড়া করতে যেয়ে ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলেন বিরাট কোহলি।শচীনের সেই বিদায়ী ম্যাচে ১৪৮ বলে ১৮৩ রানের ব্যক্তিগত সেরা ইনিংস খেলেন বিরাট! পাকিস্তানের বিপক্ষেই শচীনের ওয়ানডের গোড়াপত্তন হয় সেই পাকিস্তানের বিপক্ষেই ৯ বছর আগে শেষ পেরেক টা ঠুকেন তিনি। ১৮ মার্চ, ২০১৩ সালে ওয়ানডেকে বিদায় বলেন এই ক্রিকেট কিংবদন্তি।

পেসার হবার আশায় ক্রিকেট ঈশ্বর একসময় লিলির কাছে পরীক্ষা দিতে গেলেও উত্তীর্ণ হননি। পরে অবশ্য লিলি বলেছেন এই কাজ করে তিনি ক্রিকেটের ‘উপকার’ করেছেন। ক্রিকেট বিশ্ব পেয়েছে লিটল মাস্টার খ্যাত ক্রিকেট দেবতা। যিনি রাজতন্ত্র পরিচালনা করেন তিনি রাজা, যিনি রাজাদের পরিচালনা করেন তিনি মহারাজা আর যিনি পুরো ক্রিকেট বিশ্ব শাসন করেন তিনি ক্রিকেট ঈশ্বর শচীন রমেশ টেন্ডুলকার!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...