স্মিথ-সুধা পান করে যাই!

স্টিভেন স্মিথের রানের জোয়ার, অপ্রথাগত টেকনিক, ক্রিকেট ব্যাকরণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজস্ব ঘরানা তৈরি করা, এসব নিয়ে কয়েক বছর ধরেই চর্চা হয়ে আসছে। প্রতিপক্ষ দলগুলির অ্যানালিস্টদের গবেষণাগারে কাটোছেঁড়া হয়েছে বিস্তর। তাকে আটকানোর পথ মিলেছে সামান্যই। একটা বড় কারণ সম্ভবত, তাঁর ব্যাটিংয়ে নিজের ঘরানার সঙ্গে মৌলিকত্বের নিবিড় সংযোগ কিংবা বন্ধন।

পরপর দুই ম্যাচে ৬২ বলে সেঞ্চুরি – এমনিতেই অবিশ্বাস্য। কিন্তু ব্যাপারটা শুধু সংখ্যার নয়। ব্যাপারটা হলো, সংখ্যাগুলোর জন্ম যেভাবে হয়েছে। বা হয়ে আসছে।

স্টিভেন স্মিথের রানের জোয়ার, অপ্রথাগত টেকনিক, ক্রিকেট ব্যাকরণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজস্ব ঘরানা তৈরি করা, এসব নিয়ে কয়েক বছর ধরেই চর্চা হয়ে আসছে। প্রতিপক্ষ দলগুলির অ্যানালিস্টদের গবেষণাগারে কাটোছেঁড়া হয়েছে বিস্তর। তাকে আটকানোর পথ মিলেছে সামান্যই। একটা বড় কারণ সম্ভবত, তাঁর ব্যাটিংয়ে নিজের ঘরানার সঙ্গে মৌলিকত্বের নিবিড় সংযোগ কিংবা বন্ধন।

আজকেই চমৎকার একটা উদাহরণ দেখা গেল টিভি ধারাভাষ্যকারদের বিশ্লেষণে। স্মিথের একটি শটে ভেঙে ভেঙে তারা দেখালেন, তিনি শাফল করছেন, ব্যাক লিফট আসছে প্রায় গালি থেকে (যা মোটেও আদর্শ কিছু নয়), কিন্তু বলের সঙ্গে যখন ব্যাটের দেখা হচ্ছে, ওই মুহূর্তটায় ব্যাট একদম সোজা, হেড স্টিল, এলবো ও বডির পজিশন প্রায় নিখুঁত, ব্যালান্স নিটোল ও অটুট।

প্রথম ওয়ানডেতেও একটা শট ছিল – বলটি ছিল অফ স্টাম্পের বেশ বাইরে, স্মিথের ব্যাক লিফট যথারীতি নামছিল গালি থেকে, ওই জায়গা থেকে কিভাবে পয়েন্ট দিয়ে খেলা সম্ভব? স্মিথ ঠিকই স্কয়ার ড্রাইভে পয়েন্টের পাশ দিয়ে চার মারলেন। কারণ, যতই শাফল করুক, ব্যাট যেখান থেকেই নামুক, একদম ব্যাটে-বলে হওয়ার সময়টায় ঠিক পজিশনে চলে যাচ্ছেন।

এ কারণেই স্মিথ অনন্য। এই যে ক্রিজে তার অস্থির পয়চারি, অদ্ভূত ব্যাক লিফট, শাফল, প্রচুর নড়াচড়া, মনে হয় ব্যালান্সে গড়বড় – এসব তাঁর নিজস্বতা। কিন্তু শট মেকিংয়ের চূড়ান্ত ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটায় তিন একদম ক্রিকেট বইয়ের মনোযোগী ছাত্র ও একনিষ্ঠ অনুসারী, যেটা ওপরে লিখেছি, একই সঙ্গে প্রথা মানা ও প্রথা ভাঙার অপূর্ব সম্মিলন।

এখানেই স্মিথ অনন্য। এজন্যই তাকে নিয়ে পরিকল্পনা করা প্রতিপক্ষের জন্য কঠিন। এটি দারুণ একটি বার্তাও। আমরা যারা ক্রিকেটের মৌলিকত্বের পূজারি, তাদের জন্য আনন্দময়। আপনি যতকিছুই করুন, যতোই উদ্ভাবনী হোন, মৌলিকত্বের আশ্রয়ে থেকেই সব করতে হবে। মৌলিকত্বের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারলে নিরাপত্তার মূল ঢাল নিশ্চিত, তার পর ইচ্ছেমতো নিজেকে ভেঙেচূড়ে গড়তে পারেন। সেই ভাঙাগড়াও সাধনার ব্যাপার – স্মিথ, বিরেন্দর শেবাগরা সেসব পারেন বলেই তারা স্পেশাল।

স্মিথের প্রসঙ্গে শেবাগকে টেনে আনায় অনেকে অবাক হতে পারেন। কিন্তু আমার দুজনকে খুব পাশাপাশি ভাবতে ভালো লাগে। শেবাগের ঘরানা আলাদা, দর্শন আলাদা। কিন্তু দুজনের একটা জায়গায় দারুণ মিল। মানসিক শক্তি। এভাবে প্রচলিত ধারার উল্টো পথে রথ ছুটিয়ে যেতে অসম্ভব মানসিক শক্তি থাকতে হয়। একজন জন রাইট কলার চেপে ধরলেও, দুনিয়াজোড়া বিশ্লেষকরা সংশয়ের ছুরি নিয়ে বসে থাকলেও যেমন শেবাগ নিজের পথ বদলাননা, স্মিথও তেমনি সংশয়ের অনেক কাঁটা পেরিয়েই এগিয়ে যান সামনে।

আমরা সৌম্য-লিটনের কথা বলি। তাদের টেকনিক-টেম্পারামেন্ট আরও ভালো হওয়ার ব্যাপার তো আছেই। কিন্তু এই মানসিক শক্তিটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। নিজের ওপর আস্থা। আগেও অবশ্য এটা লিখেছি, বলেছি। ও হ্যাঁ, কান ধরে বলছি, তুলনা করছি না ওদের সঙ্গে। স্রেফ একটা পয়েন্ট বললাম, প্রসঙ্গক্রমে

বীরেন্দ্র শেবাগের মানসিক শক্তির পাশাপাশি ব্যাটিংয়ের মূল ব্যাপার ছিল হ্যান্ড-আই কো অর্ডিনেশন। স্মিথের ক্ষেত্রেও এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি হ্যান্ড আর মাইন্ডের কো-অর্ডিনেশন, হ্যান্ড আর বডির কো-অর্ডিনেশনও (এসবের ব্যবধান খুব সূক্ষ্ম ও একটা ক্ষেত্রে সবই অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে) তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ক্রিজে যতটা অস্থির তাকে মনে হয়, আসলে ততটাই মনোযোগী।

এমনিতে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন সবসময়। একটা শট ঠিকমতো খেলতে না পারলে, পছন্দমতো না হলে, এমন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলেন যে সব শেষ হয়ে গেল! এতটা ‘এক্সিপ্রেসিভ’ বলেই মনোযোগ তার জন্য জরুরি, পরের বলটায় আবার ফোকাস করা। সেটাও তিনি অসাধারণভাবে পারেন। এখানেই কো-অর্ডিনেশনগুলোর কথা বলেছি। তার মাথা, শরীর, হাত সব স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে। তার প্রসেস বা প্রক্রিয়া ঠিক থাকে।

তার জন্য ‘রিদম’ বা ছন্দ খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাকে দেখলেই বুঝবেন, অনেক সময় রান পেলেও তার চেনা চেহারায় নেই। কারণ নিজের ছন্দে নেই।অনেক সময় রান না পেলেও ব্যাটিংয়ে বোঝা যায়, ছন্দে ঠিকই আছেন। এবারের আইপিএলে যেমন, একটুও ছন্দে ছিলেন না। কিছু ম্যাচে রান পেয়েছেন বটে। কিন্তু দেখেই মনে হচ্ছিল, স্বস্তি পাচ্ছেন না। কি একটা যেন নেই!

কিছুদিন আগে, ভারত সিরিজের আগে অস্ট্রেলিয়ার ট্রেনিং সেশনে হঠাৎই একটা সময় সেই ‘মিসিং’ জিনিসটা তিনি খুঁজে পেলেন। তখনই কোচকে বললেন, ঘোষণার সুরেই সবাএক জানালেন, কাঙ্ক্ষিত সেটি খুঁজে পেয়েছেন, সেই ‘হ্যান্ড’ খুঁজে পেয়েছেন। তাই আপন ছন্দও ফিরেছে। কতটা ফিরেছে, ভারত সিরিজের প্রথম দুই ওয়ানডেতেই স্পষ্ট।

সামনে টানা ব্যর্থতাও আসতে পারে। ক্রিকেটের নিয়মে সেটা অস্বাভাবিক না। কিন্তু তার এই যে প্রক্রিয়া, এই যে ঘরানা, এই নিজস্বতা, এসব অনন্য।

নিল ওয়্যাগনার তাকে শরীর তাক করা শর্ট বলে কাবু করেছেন দু’দলের সবশেষ সিরিজে। ওয়্যাগনার এই একই পরিকল্পনা নিয়ে দুনিয়ার তাবত ব্যাটসম্যানকে ভুগিয়ে যাচ্ছেন। মূল কারণ, তার বাউন্সারগুলোর গতি ও উচ্চতার হেরফের হয় এবং তিনি যন্ত্রের মতো একটার পর একটা করতেই থাকেন, লম্বা স্পেলও করেন। আমি নিশ্চিত, পরের বার তবু স্মিথ ঠিকই ওয়্যাগনারের দাওয়াই বের করবেন।

স্মিথের চেয়ে ভালো ব্যাটসম্যান হয়তো এখন আছে, ভবিষ্যতে অবশ্যই আসবে। কিন্তু তার মতো কেউ কখনও আসবে কিনা, আমি নিশ্চিত নই।

তাঁকে ব্যাখ্যা করা কঠিন। তার ব্যাটিং উপভোগ করা সহজ। আমি মনে করি, আমরা ভাগ্যবান, এরকম একজনকে দেখতে পাচ্ছি সরাসরি। আমরা বরং সহজ কাজটাই করি, স্মিথ-সুধা পান করে যাই, যতদিন পারি!

– ফেসবুক থেকে

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...