রিয়াদের ছক্কায় মুম্বাই কানেকশন!
নিজের ব্যাটিং বিশ্লেষণ তো ছিলোই, পাশাপাশি সাহায্য পেয়েছেন মুম্বাইয়ের এক বন্ধুর। সেই সাথে যোগ হয়েছিলো অক্লান্ত পরিশ্রম। তিনের সম্মিলিত প্রয়াসেই মাহমুদউল্লাহর এই ছোট্ট কিন্তু ঝড়ো ইনিংসের জন্ম। ফাইনালেও ধরে রেখেছেন সাফল্য।
লোকে বলে, ম্যান অব ক্রাইসিস। আবার কেউ বলে, ঠান্ডা মাথার বিস্ফোরক!
বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডারের যে কজন মানুষের ওপর দায়িত্ব দিয়ে নির্ভার থাকা যায়, তাঁদের একজন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মাঠে নেমে ঠান্ডা মাথায় শট খেলে দলকে জিতিয়ে দেয়া তাঁর নিজস্ব স্বভাব।
কিন্তু মাঝে দু তিন সপ্তাহ ধরে কেন যেন নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না রিয়াদ। মিরপুরের মন্থর পিচের ফাঁদে ব্যাটিংয়ের ছন্দই হারিয়ে ফেলেছিলেন অনেকটা। অবশেষে ব্যর্থতার খোলস ভেঙে বেরিয়ে এলেন তিনি৷ বঙ্গবন্ধু কাপে চট্টগ্রামের বিপক্ষে খেললেন মাত্র ৯ বলে ৩০ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। যা এর মধ্যেই এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত আর চমৎকার ইনিংসগুলোর একটি হিসেবে সাড়া ফেলে দিয়েছে। এরপর ফাইনালে সেই বীরত্বপূর্ন ইনিংস তো আছেই।
কী ছিলো এই সাফল্যের রহস্য?
উত্তরটা রিয়াদ নিজেই দিয়েছেন। নিজের ব্যাটিং বিশ্লেষণ তো ছিলোই, পাশাপাশি সাহায্য পেয়েছেন মুম্বাইয়ের এক বন্ধুর। সেই সাথে যোগ হয়েছিলো অক্লান্ত পরিশ্রম। তিনের সম্মিলিত প্রয়াসেই মাহমুদউল্লাহর এই ছোট্ট কিন্তু ঝড়ো ইনিংসের জন্ম। ফাইনালেও ধরে রেখেছেন সাফল্য। সেই চট্টগ্রামের বিপক্ষেই একইভাবে খেলেছেন। তাঁর দ্রুত ইনিংসটি জয়ের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছে দলকে।
বেশীরভাগ সময় ধীরস্থিরভাবে খেললেও রিয়াদ যে প্রয়োজনে গিয়ার বদলে বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারেন, তার প্রমাণ কিন্তু প্রথম কোয়ালিফায়ারেই পাওয়া গিয়েছিলো। শরিফুল ইসলামের ফাস্ট বলে তিন তিনটি ছক্কা হাঁকিয়ে চট্টগ্রাম দলের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি৷ এক রিয়াদের ব্যাটেই কোনঠাসা হয়ে গিয়েছিলো চট্টগ্রাম।
ছক্কাগুলোর কৌশলও ছিলো চমৎকার। প্রথমটা মেরেছিলেন লেগসাইডের লাইন বরাবর সুইং শট। পরেরটা একটু পিছিয়ে এসে লেংথ বলকে ডিপ স্কয়ারের দিকে ফ্লিপ, একদম যেন ২০১৮ নিদহাস ট্রফিতে ইসুরু উদানাকে করা ফ্লিপটার মতো। আর ঘুরে দাঁড়ানোর মন্ত্রটা তাঁর কানে ফুঁকে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পারফরম্যান্স বিশ্লেষক, শ্রীনিবাস চন্দ্রশেখরন।
ক্রিকইনফোকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মাহমুদউল্লাহ বলেন, ‘আমার পাওয়ার শটগুলোতে নিজের কাছেই কি যেন একটা নেই বলে মনে হচ্ছিলো। বারবার ম্যাচ ভিডিওগুলো দেখেও সুরাহা করতে পারছিলাম না। সেসময় কথা বললাম শ্রীনিবাসের সাথে। শ্রী কিছুটা সময় নিয়ে আমার ভিডিওগুলো দেখলেন। সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করলেন। তাঁর মতে আমার কাঁধ একটু দ্রুত উপরে উঠে যাচ্ছিলো।’
শুধু মাহমুদউল্লাহ নন, বাংলাদেশের প্রায় সব ক্রিকেটারের সাথেই নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন চন্দ্রশেখরন। কোভিড-১৯ এর জন্য বাংলাদেশের সব আন্তর্জাতিক ম্যাচ স্থগিত হওয়ায় তিনি এখন মুম্বাইতে নিজের বাড়িতে আছে। বাড়িতে বসেই দেখছেন বঙ্গবন্ধু কাপ৷ সেইসাথে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করে যাচ্ছেন বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের।
চন্দ্রশেখরনের ভাষ্যে, ‘তামিম, মুশফিক, সৌম্য, লিটন, ইয়াসির আলিদের পাশাপাশি বোলারদের সাথেও আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো। ওদের পারফরম্যান্স, অপজিশনের পারফরম্যান্স, খেলার কোথায় ঘাটতি আছে; এসব নিয়ে আলোচনা হতো। ওদের সাথে এমনভাবে মিশে ছিলাম যে মনেই হতোনা আমি বাড়িতে বসে খেলা দেখছি। পুরোটা সময় মনটা টুর্নামেন্টেই আটকে ছিলো।’
রিয়াদের কথা বিশেষভাবে বলতে গিয়ে শ্রী বলছিলেন, ‘খেয়াল করছিলাম, পুরোটা টুর্নামেন্ট জুড়েই রিয়াদ ডেথলি ওভারে তার সহজাত পিকআপ শটগুলো খেলতে পারছিলোনা। তো একদিন কথাবার্তার সময় তাকে জানালাম ব্যাপারটা। তখন রিয়াদ আমাকে জিজ্ঞেস করলো এ ব্যাপারে আমি তাকে সাহায্য করতে পারি কিনা।’
চন্দ্রশেখরন নেমে পড়লেন মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিং বিশ্লেষণে। ২০১৮ সালের নিদহাস ট্রফি থেকে শুরু করে ২০১৯ বিশ্বকাপ, সর্বশেষ দুটো বিপিএল, কিছুই বাদ গেলোনা। এমনকি মাহমুদউল্লাহর খেলা শটগুলোর একটা গ্রাফও এঁকে ফেললেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, যখন তিনি টিভিতে নিদহাস ট্রফির বিখ্যাত ‘মাহমুদইল্লাহ নক’টা দেখছিলেন, ঠিক সেসময়ই ফোনে লাইভ চলতে থাকা বঙ্গবন্ধু কাপের ম্যাচে মাহমুদউল্লাহ একই শটটা মিস করেছিলেন। পার্থক্যটা দেখে চন্দ্রশেখরন সমাধান পেয়ে গেলেন রিয়াদের ব্যাটিং ব্যর্থতার। সবগুলো ম্যাচ ভিডিও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তিনি রিয়াদের সমস্যাগুলো খুঁজে বের করলেন। তারপর সেগুলো বুঝিয়ে বললেন রিয়াদকে। রিয়াদ উত্তরে জানালেন, নেট প্র্যাকটিসে তিনি চেষ্টা করবেন ভুলগুলো শোধরানোর।
রিয়াদ কি পেরেছিলেন ভুল শোধরাতে?
উত্তরটা হলো হ্যাঁ, রিয়াদ পেরেছিলেন। পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই পেরেছিলেন।
বাকিটা রিয়াদের মুখেই শোনা যাক, ‘পরদিন সকালটা আমি দলের সহকারী নাসিরের সাথে নেটেই কাটালাম। আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য একঘন্টারও বেশী সময় শট খেলেছিলাম। তারপর অবশেষে কোয়ালিফায়ার ম্যাচে নিদহাস ট্রফির ওই শটটার মতো করে খেলতে পারলাম। ব্যক্তিগতভাবে আমি শ্রীনিবাসকে ধন্যবাদ জানাই। ওর সাথে খুব অল্পসময় কথা হলেও প্রচণ্ড ইফেক্টিভ একটা আলোচনা হয়েছিলো। শ্রীই আমাকে সাহায্য করেছিলো পুরনো ফর্মে ফিরে যেতে।’
ঢাকার সাথে ফাইনাল ম্যাচে নিজের ইনিংসের প্রায় পুরোটাই মাহমুদউল্লাহ খুলনার অন্য ব্যাটসম্যানদের সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছিলেন। একদম শেষ ওভারে এসে শুরু করলেন নিজের খেল দেখানো৷ দুই চার আর এক ছয় মেরে সৌম্যকে তুলোধুনো করে ছাড়লেন। সতেরো রানের ওভারটিই ব্যবধান গড়ে দিয়েছিলো ঢাকা আর খুলনার। পাঁচ রানে ম্যাচটা জিতে গেলো খুলনা।
‘দলের প্রয়োজনের সময়ে সঠিক ইনিংসটা খেলতে পেরেছি’-বলছিলেন মাহমুদউল্লাহ।
রিয়াদের মতে, পুরো দলের মতোই চেষ্টাা করতে পেরেছেন তিনি, ‘আমার দায়িত্ব তো আমি পালন করছিলামই, তবে তারচেয়েও বেশী জরুরি ছিলো দলকে জেতানো, টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হওয়া৷ দলের প্রত্যেকের মধ্যে জেতার একটা স্পৃহা ছিলো। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যোগ্যতা আমাদের প্রথম থেকেই ছিলো, শুধু সেরা খেলাটা বের করে আনতে একটু দেরী হচ্ছিলো। যাক, শেষ পর্যন্ত সবাই’ই সময়মতো জ্বলে উঠতে পেরেছি। জয়ের পেছনে আমাদের খেলোয়াড়, ম্যানেজমেন্ট আর দলের মালিক- সবার সম্মিলিত প্রয়াস কাজ করেছে৷ মাশরাফি ভাইয়ের উপদেশ আর পরামর্শগুলোও খুব কাজে দিয়েছে। দিনশেষে যখন আপনার খেলোয়াড়রা নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দেয়, তখন অধিনায়কত্ব সত্যিই খুব আনন্দের কাজ হয়ে দাঁড়ায়।’
সামনের মাসেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম করোনাকালীন ম্যাচ। বহুদিন পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া আন্তর্জাতিক ম্যাচের পেছনে প্রত্যাশার চাপটাও একটু বেশী। তাই রণক্ষেত্রে পা দেয়ার আগে এখন বাড়িতে বসে একটু বিশ্রাম করে নিচ্ছেন মাহমুদউল্লাহ। তাছাড়া এই সিরিজ দিয়েই নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে মাঠে নামছেন সাকিব আল হাসান। তাই ব্যাটিং অর্ডারে মাহমুদউল্লাহর অবস্থানটা এখনো নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছেনা। তবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই তাঁর। দলের প্রয়োজনমাফিক যেকোন পজিশনেই খেলতে রাজি আছেন তিনি।
রিয়াদ বলছিলেন, তিনি যে কোনো জায়গায় খেলতে রাজী আছেন, ‘টপ অর্ডার, মিডল অর্ডার কিংবা লোয়ার-মিডলের ফিনিশার- যেখানেই খেলতে দেয়া হবে, আমি চেষ্টা করবো নিজের দায়িত্বটা শতভাগ পালন করার। এতদিন ধরে ঘরোয়া ক্রিকেট খেললেও আমরা সবাই জানি ঘরোয়া আর আন্তর্জাতিক ম্যাচের মধ্যে যোজন যোজন পার্থক্য। সেভাবেই মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি। সকলেই চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব ছন্দে ফেরার, যাতে করে জয়ের মধ্যে দিয়েই আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলো শুরু করতে পারি।’
ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলোয় প্রতিনিয়ত দলকে জিতিয়ে আসা, কিংবা বিসিবি প্রেসিডেন্ট কাপ আর বঙ্গবন্ধু টি-২০ কাপ দুটোতেই সফলভাবে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করা; মাহমুদউল্লাহর গত ক মাসের ক্রিকেটীয় সফর প্রমাণ করে, তিনি নিজের খেলাটা ভালোমতই বোঝেন। সেই সাথে অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিতেও তিনি কুণ্ঠাবোধ করেননা। দুইয়ের মিশেলে দিন দিন নিজেকে ছাড়িয়ে আরো বেশী পরিনত হয়ে উঠছেন আমাদের মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।