দ্য ফাইনেস্ট ব্ল্যাক ক্যাপ

হ্যাডলির অভিষেকের পূর্বে ১০২ টেস্টে নিউজিল্যান্ডের ৪৬ টি হারের বিপরীতে জয় ছিল মাত্র ৭টি। আর হ্যাডলির খেলা ৮৬ টেস্টে নিউজিল্যান্ডের ২৮ হারের বিপরীতে জয়ের সংখ্যা ২২টি। পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট, নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে অবিসংবাদিত সেরা ম্যাচ উইনার স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে হ্যাডলির ইম্প্যাক্ট বোঝাতে এই একটা পরিসংখ্যানই যথেষ্ট।

তাঁর সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, ‘দ্য ফাইনেস্ট ক্রিকেটার নিউজিল্যান্ড হ্যাজ এভার প্রোডিউসড।’ ক্রিকেট বিশ্বে তুলনামূলক খর্বশক্তির দল হিসেবে বিবেচিত নিউজিল্যান্ডকে তিনিই সর্বপ্রথম লড়াই করে জিততে শিখিয়েছেন। একজন জেনুইন অলরাউন্ডার হয়েও কেবল ফাস্ট বোলার হিসেবেই যিনি সর্বকালের সেরাদের কাতারে থাকার যোগ্য। বলছিলাম টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ৪০০ উইকেট পাওয়া বোলার, আশির দশকের বিখ্যাত ফ্যাব-ফোরের সদস্য স্যার রিচার্ড হ্যাডলির কথা।

রিচার্ড হ্যাডলিকে মনে করা হয় ইতিহাসের সবচেয়ে নিখুঁত ও কন্সিস্টেন্ট ফাস্ট বোলারদের একজন। দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা, নিয়ন্ত্রণ এবং ম্যাচ উইনিং ইম্প্যাক্টের বিচারে তাঁর সমকক্ষ বোলার গোটা ইতিহাসেই বিরল। সাবেক প্রোটিয়া অলরাউন্ডার ক্লাইভ রাইসের মতে সর্বকালের সেরা পাঁচ ফাস্ট বোলারের একজন হলেন রিচার্ড হ্যাডলি।

ক্যারিয়ারের শুরুতে হ্যাডলি ছিলেন একজন ‘আউট অ্যান্ড আউট’ ফাস্ট বোলার। লম্বা রানআপ এবং সাইড অন একশনে যেকোন উইকেটে তুলতে পারতেন গতির ঝড়। সাবেক ইংরেজ গতিদানব ফ্রাঙ্ক টাইসনের মতে, তরুণ বয়সে হ্যাডলির গতি ছিল ম্যালকম মার্শাল কিংবা জোয়েল গার্নারের কাছাকাছি। তবে সময়ের সাথে রানআপ ও গতি কমিয়ে মনোযোগ দেন সুইং এবং অ্যাকুরেসির দিকে।

উইজডেনের ভাষায়, ‘His lithe, whippy, side-on action made life uncomfortable for all the great batsmen of his era, as he extracted pace, bounce and movement from even the least responsive of surfaces.’

নিখুঁত সিম প্রেজেন্টেশনের কারণে উইকেটের দুপাশেই বলকে সুইং করাতে পারতেন, তবে আউটসুইংটা ছিল ন্যাচারাল। হ্যাডলির ক্রিকেটিং আইডল ছিলেন ডেনিস লিলি। লিলিকে দেখেই নিজের অস্ত্রভাণ্ডারে যোগ করেছিলেন ‘লেগ কাটার’।

হ্যাডলি বল রিলিজ করতেন স্টাম্পের খুব কাছ থেকে। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য ছিল, “When the ball shot through along a line drawn from middle stump to middle stump, even minimal movements through the air and off the pitch could produce devastating effect.’

১৯৫১ সালের ৩ জুলাই, ক্রাইস্টচার্চের একটি স্বনামধন্য ক্রিকেট পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রিচার্ড জন হ্যাডলি। তাঁর বাবা ওয়াল্টার হ্যাডলিও ছিলেন নামকরা ক্রিকেটার। নিউজিল্যান্ডের হয়ে ১১ টি টেস্ট খেলা সাবেক এই ডানহাতি ওপেনারকে মনে করা হয় দেশটির ইতিহাসে অন্যতম সেরা অধিনায়ক।

ওয়াল্টার হ্যাডলির পাঁচ সন্তানের সবাই ছিলেন ক্রিকেটার। এদের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনজন। ব্যারি হ্যাডলি (ব্যাটসম্যান), ডেল হ্যাডলি (ফাস্ট বোলার) আর রিচার্ড হ্যাডলি (অলরাউন্ডার) তিন ভাই একসাথে খেলেছেন ১৯৭৫ বিশ্বকাপে।

মজার ব্যাপার হল, স্যার রিচার্ড হ্যাডলির সাবেক স্ত্রী কারেন হ্যাডলিও ছিলেন ক্রিকেটার। ১৯৭৮ সালে নিউজিল্যান্ড প্রমীলা ক্রিকেট দলের হয়ে একটি ওয়ানডে খেলেছেন তিনি।

রিচার্ড হ্যাডলির প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ১৯৭১ সালে, ক্যান্টারবারির হয়ে। প্রথম টেস্ট খেলেন ১৯৭৩ সালে, পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়েলিংটনে। ওয়ানডে অভিষেকও একই বছর একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, ঘরের মাঠ ক্রাইস্টচার্চে।

১৯৭৩ সালে অভিষেক হলেও তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলার শুরুটা তেমন মসৃন ছিল না। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ক্যারিয়ারের প্রথম ১৭ টেস্টে তাঁর শিকার ছিল মাত্র ৬১ উইকেট, ৩৫.৫৭ গড়ে! আর ব্যাট হাতে ২২.৮৫ গড়ে করেছিলেন মাত্র ৬১৭ রান।

তবে এই সাদামাটা ক্যারিয়ারেই নিজের বোলিং প্রতিভা এবং অলরাউন্ড সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছিলেন তিনি এবং সেটাও অস্ট্রেলিয়া, ভারতের মত শক্তিশালী দলের বিপক্ষে টেস্ট জেতানোর মধ্য দিয়ে।

হ্যাডলির অভিষেকের পূর্বে তৎকালীন ক্রিকেটের ‘বিগ থ্রি’ বলে বিবেচিত ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর অস্ট্রেলিয়াকে কখনোই হারাতে পারে নি নিউজিল্যান্ড। অথচ হ্যাডলির আবির্ভাবের কিছুদিন পরই ইতিহাসে প্রথমবারের মত অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর স্বাদ পায় তারা।

১৯৭৪ সালে হ্যাডলির বোলিং নৈপুণ্যেই (৩/৫৯ ও ৪/৭১) ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ইতিহাস গড়ে কিউইরা। এটা ছিল পাঁচ বছরের মধ্যে নিউজিল্যান্ডের প্রথম টেস্ট জয়!

১৯৭৬ সালে ভারতের বিপক্ষে সিরিজ নির্ধারণী ওয়েলিংটন টেস্টে নিউজিল্যান্ড জিতেছিল ইনিংস ব্যবধানে। বিধ্বংসী বোলিংয়ে রিচার্ড হ্যাডলি একাই নিয়েছিলেন ১১ উইকেট (৪/৩৫ ও ৭/২৩)। অথচ সুনীল গাভাস্কার, দিলীপ ভেংসরকার, মহিন্দর অমরনাথ, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথে সমৃদ্ধ ভারতের ব্যাটিং লাইনআপটা ছিল বেশ শক্তিশালী।

স্যার রিচার্ড হ্যাডলির ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট বলা যেতে পারে ১৯৭৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাওয়া ঐতিহাসিক জয়টিকে। দীর্ঘ ৪৮ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে টেস্টে প্রথমবারের মত ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে নিউজিল্যান্ড। ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভে হ্যাডলির অসাধারণ বোলিং নৈপুণ্যে ব্ল্যাক ক্যাপসরা জিতেছিল ৭২ রানে। হ্যাডলির শিকার ছিল ১০ উইকেট (৪/৪৭ ও ৬/২৬)।

অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইংল্যান্ডের পর ‘হ্যাডলির নিউজিল্যান্ডের’ পরবর্তী শিকার ছিল ক্লাইভ লয়েডের দোর্দন্ড প্রতাপশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৯৭৯-৮০ সালে মূলত হ্যাডলির একক নৈপুণ্যেই ক্যারিবিয়ানদের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ জিতেছিল নিউজিল্যান্ড।

তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথমটা হয়েছিল ডানেডিনে। চতুর্থ ইনিংসে সফরকারী ক্যারিবীয়দের দেয়া ১০৪ রানের লক্ষ্য করতে নেমে মাত্র ১ উইকেটের রুদ্ধশ্বাস এক জয় পায় নিউজিল্যান্ড। ঐতিহাসিক এই বিজয়ে ব্যাটে-বলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। বল হাতে ১১ উইকেট (৫/৩৪ ও ৬/৬৮) নেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে খেলেন ৫৩ ও ১৭ রানের ‘মহামূল্যবান’ দুটো ইনিংস।

পরের দুটি ম্যাচ ড্র হলে সিরিজ জয়ের ট্রফি ঘরে তোলে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড এবং তাতে হ্যাডলির অবদান ছিল ১৭৮ রান ও ১৯ উইকেট। ঘরের মাঠ ক্রাইস্টচার্চে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি তুলে নেন হ্যাডলি। আট নম্বরে নেমে হোল্ডিং, গার্নার, রবার্টস, ক্রফটের মত দানবীয় ফাস্ট বোলারদের পিটিয়ে খেলেন ৯২ বলে ১০৩ রানের এক বিস্ফোরক ইনিংস।

১৯৮০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এওয়ে সিরিজে ২-০ ব্যবধানে হারে নিউজিল্যান্ড। তবে দল ব্যর্থ হলেও ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে উজ্জ্বল ছিলেন হ্যাডলি। দুইবার ইনিংসে ৫ উইকেটসহ মাত্র ১৯.১৬ গড়ে তুলে নেন ১৯ উইকেট।

১৯৮২ সালে অজিদের বিপক্ষে ফিরতি সিরিজের প্রথম ম্যাচ ড্রয়ের পর দ্বিতীয় টেস্টে আবারও জয় তুলে নেয় নিউজিল্যান্ড। অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে হ্যাডলির ৮ উইকেট শিকারের (৩/৩৮ ও ৫/৬৩) কল্যাণেই অস্ট্রেলিয়াকে পাঁচ উইকেটে হারাতে পেরেছিল তারা।

পরের ম্যাচটা অস্ট্রেলিয়া জিতলে সিরিজে আসে ১-১ সমতা। মাত্র ১৬.১৪ গড়ে ১৪ উইকেট নিয়ে সিরিজের সেরা বোলার ছিলেন ‘ওয়ান অ্যান্ড অনলি’ রিচার্ড হ্যাডলি।

১৯৮৩ সালের ‘বিখ্যাত’ হেডিংলি টেস্টে ল্যান্স কেয়ার্নসের বিধ্বংসী বোলিংয়ে (৭/৭৪ ও ৩/৭০) স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫ উইকেটের এক অবিস্মরণীয় জয় তুলে নেয় নিউজিল্যান্ড। উল্লেখ্য, এটাই ছিল ইংল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের প্রথম টেস্ট জয়। বল হাতে ‘উইকেটশূন্য’ হ্যাডলি এ ম্যাচে আলো ছড়িয়েছিলেন ব্যাট হাতে। ৭ নম্বরে নেমে খেলেছিলেন ৭৫ রানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস।

শেষ পর্যন্ত ৩-১ ব্যবধানে সিরিজ হারলেও ব্যাটে-বলে দলের সেরা পারফর্মার ছিলেন হ্যাডলিই। ব্যাট হাতে ৪ ফিফটিসহ ৩০১ রান এবং বল হাতে দুইবার ইনিংসে ৫ উইকেটসহ হ্যাডলির শিকার ছিল ২১ উইকেট।

ফিরতি সিরিজ খেলতে পরের বছরই ইংলিশরা আসে নিউজিল্যান্ড সফরে। এবং সেবারই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের (১-০) গৌরব অর্জন করে নিউজিল্যান্ড। যার সিংহভাগ কৃতিত্ব স্যার রিচার্ড হ্যাডলির।

হ্যাডলির ‘ঘরের মাঠ’ ক্রাইস্টচার্চে ব্ল্যাকক্যাপরা জিতেছিল এক ইনিংস ও ১৩২ রানের বিশাল ব্যবধানে। বল হাতে ৮ উইকেট (৩/১৬ ও ৫/২৮) এবং ব্যাট হাতে ৮১ বলে ৯৯ রানের বিধ্বংসী ইনিংস উপহার দেন হ্যাডলি।

ডেভিড গাওয়ার, অ্যালান ল্যাম্ব, ইয়ান বোথাম, মাইক গ্যাটিং, বব উইলিস, ডেরেক র‍্যান্ডালের মত দুর্দান্ত সব প্লেয়ার থাকা সত্ত্বেও ইংল্যান্ডকে বরণ করতে হয়েছিল দুই ইনিংসেই একশ’র নিচে অলআউট হবার লজ্জা!

১৯৮৪ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হ্যাডলির অর্জন ছিল দুইবার ইনিংসে ৫ উইকেট ও একবার ম্যাচে ১০ উইকেটসহ মাত্র ১০ গড়ে ২৩ উইকেট! নিউজিল্যান্ড সিরিজ জিতেছিল ২-০ ব্যবধানে।

রিচার্ড হ্যাডলির অনবদ্য বোলিং নৈপুণ্যেই ১৯৮৫ সালে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ট্রান্স-তাসমান ট্রফি ঘরে তোলে নিউজিল্যান্ড। ব্রিসবেনে সিরিজের প্রথম টেস্টে হ্যাডলির আগুনঝরা বোলিং তোপে (৯/৫২ ও ৬/৭১) এক ইনিংস ও ৪১ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয় অ্যালান বোর্ডারের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়া।

উল্লেখ্য, জর্জ লোহম্যানের (৯/২৮) পর টেস্টে যেকোন ফাস্ট বোলারের সেরা বোলিং ফিগার (৯/৫২) এখনও অব্দি এটাই। বল হাতে একাই ১৫ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতেও ৪১ বলে ৫৪ রানের একটি ঝড়োগতির ইনিংস খেলেন হ্যাডলি।

সিডনিতে দ্বিতীয় ম্যাচটা অস্ট্রেলিয়া জিতলেও শেষ টেস্টে আবারও ১১ উইকেট নিয়ে কিউইদের ঐতিহাসিক সিরিজ জয় (২-১) নিশ্চিত করেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি।

তিন ম্যাচ খেলে হ্যাডলি নিয়েছিলেন ৩৩ উইকেট; মাত্র ১২.১৫ গড়ে! ম্যাচে ১০ উইকেট ২ বার আর ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করেছিলেন ৫ বার! এ প্রসঙ্গে উইজডেন লিখেছিল, ‘In that summer of 1985, Sir Hadlee had become the Wizard of Oz in the Land of Oz.’

পরের বছর নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ফিরতি সিরিজটাও ১-০ ব্যবধানে জিতে নেয় ব্ল্যাক ক্যাপ্সরা। যেখানে হ্যাডলির অবদান ছিল ১৬ উইকেট এবং ২১৬ রান। ১৯৮৬ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথমবারের মত টেস্ট সিরিজ জয়লাভ করে নিউজিল্যান্ড। কিউইদের একমাত্র জয়টা এসেছিল ট্রেন্টব্রিজে। জয়ের নায়ক ছিলেন যথারীতি স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। বল হাতে ১০ উইকেট (৬/৮০ ও ৪/৬০) লাভের পাশাপাশি অবদান রাখেন ব্যাট হাতেও, খেলেন ৬৮ রানের ‘দায়িত্বশীল’ একটি ইনিংস।

১৯৮৭ সালে নিজেদের মাটিতে ‘শক্তিশালী’ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ ড্র (১-১) করে নিউজিল্যান্ড। ক্রাইস্টচার্চে সিরিজের শেষ ম্যাচটা তারা জিতেছিল ৫ উইকেটে। ৯ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন।কে আবার? স্যার রিচার্ড হ্যাডলি!

১৯৮৭ সালের শ্রীলঙ্কা সফরে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট শতকের দেখা পান হ্যাডলি। তাঁর ২৪০ বলে অপরাজিত ১৫১ রানের লড়াকু ইনিংসের সৌজন্যেই প্রায় হারতে বসা কলম্বো টেস্ট ড্র করতে পেরেছিল ব্ল্যাক ক্যাপরা।

১৯৮৭-৮৮ সালে মেলবোর্নের ঐতিহাসিক ‘বক্সিং ডে’ টেস্টে ১০ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। কিউইদের দেয়া ২৪৭ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে এক পর্যায়ে ৯ উইকেট হারিয়ে ফেললেও শেষ পর্যন্ত দুই টেলএন্ডারের দৃঢ়তায় কোনরকমে ম্যাচ বাঁচায় অস্ট্রেলিয়া।

১৯৮৮ সালে ইতিহাসে মাত্র ‘দ্বিতীয়বারের’ মত (প্রথমবার ১৯৬৯ সালে) ভারতের মাটিতে টেস্ট জয়ের কীর্তি গড়ে নিউজিল্যান্ড। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের ব্যাটিং স্বর্গেও দুর্দান্ত বোলিং করেন রিচার্ড হ্যাডলি। ১৩৬ রানের অবিস্মরণীয় জয়ে তাঁর অবদান ছিল ১০ উইকেট (৬/৪৯ ও ৪/৩৯)। ভারতের মাটিতে আজ পর্যন্ত এটাই নিউজিল্যান্ডের সর্বশেষ টেস্ট জয়। গত ৩২ বছরে একবারও জিততে পারে নি তারা৷

নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের ‘চিরায়ত’ স্পিন দুর্বলতা এবং ভারতীয় স্পিনারদের নৈপুণ্যে সিরিজটা শেষ পর্যন্ত জিতেছিল স্বাগতিকরাই। তবে বল হাতে মাত্র চৌদ্দ গড়ে ১৮ উইকেট নিয়ে সিরিজের সেরা বোলার ছিলেন ৩৭ বছরের ‘বুড়ো’ রিচার্ড হ্যাডলি।

মুম্বাই টেস্টে হ্যাডলির অনবদ্য বোলিং নৈপুণ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিশিষ্ট ক্রীড়ালেখক অরুণাভ সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘Hadlee ran in, the ball darted around in ways that had never been witnessed in India as far as memory and fancy stretched. It veered away deceptively, jagged back with menace, sometimes mischievously held its line. The batsmen were never certain, the edge connected far more frequently than the middle. On occasions it moved early, often it curled late. Once in a while a sudden short one reared at the body. And some broke back off the pitch, right into the batsman.’

১৯৯০ সালে ভারতের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ক্রাইস্টচার্চ ইতিহাসের প্রথম বোলার হিসাবে টেস্টে ৪০০ উইকেটের মাইলফলক অর্জন করেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। তাঁর ৪০০তম শিকার ছিলেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার।

১৯৯০ সালের পাঁচ জুলাই, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এজবাস্টনে ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন হ্যাডলি। বিদায়ী টেস্টেও অসাধারণ বোলিং করেছিলেন তিনি। প্রথম ইনিংসে ৩ উইকেট শিকারের পর দ্বিতীয় ইনিংসে নেন পাঁচ উইকেট; ম্যাচ সেরা এবং সিরিজ সেরা দুটো পুরস্কারই ওঠে তাঁর হাতে। অথচ হ্যাডলির বয়স তখন ৩৯ বছর!

হ্যাডলির অবসরের পর উইজডেন লিখেছিল, ‘Hadlee was a phenomenon — one of a kind, and will perhaps never be repeated.’

প্রায় দেড় যুগের বর্ণাঢ্য আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে হ্যাডলি খেলেছেন ৮৬টি টেস্ট এবং ১১৫টি ওয়ানডে। টেস্টে মাত্র ২২.২৯ গড়ে নিয়েছেন ৪৩১ উইকেট। স্ট্রাইক রেট ৫০.৮। ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ৩৬ বার; আর ম্যাচে দশ উইকেট ৯ বার। ফাস্ট বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যকবার ইনিংসে ৫ উইকেট এবং ম্যাচে ১০ উইকেট পাওয়ার রেকর্ডটা এখনও অবধি স্যার রিচার্ড হ্যাডলির দখলে।

এছাড়া ওয়ানডেতে মাত্র ২১.৫৬ গড়ে হ্যাডলির অর্জন ১৫৮ উইকেট। ইকোনমি রেট ৩.৩০। ইনিংসে ৫ উইকেট পেয়েছেন পাঁচ বার। ওয়ানডেতে কমপক্ষে ১৫০ উইকেট পাওয়া বোলারদের মাঝে সেরা বোলিং গড়ে (২১.৫৬) মালিক হ্যাডলি।

বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান রিচার্ড হ্যাডলি ছিলেন তাঁর সময়ের সেরা হার্ডহিটারদের একজন। মূলত লোয়ার অর্ডারে ব্যাট করলেও দলের প্রয়োজনে মিডল অর্ডারে উঠে এসে অ্যাঙ্কর রোলও প্লে করতে দেখা গেছে তাঁকে।

টেস্টে ব্যাট হাতে তাঁর সংগ্রহ ২৭.১৬ গড়ে ৩১২৪ রান। দু’টি সেঞ্চুরির পাশাপাশি হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ১৫টি। এছাড়া ওয়ানডেতে ২১.৬১ গড়ে করেছেন ১৭৫১ রান। হাফ সেঞ্চুরি চারটি।

১৯৭৫ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত মোট তিনটি বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছেন হ্যাডলি। ১৩ ম্যাচ খেলে তাঁর শিকার ২২ উইকেট; মাত্র ১৯.১৩ গড়ে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তাঁর ইকোনমি রেট মাত্র ২.৮৮! মেডেন নিয়েছেন ৩৮টি! একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০০০ রান এবং ১০০ উইকেটের ডাবল অর্জনকারী প্রথম ক্রিকেটার হলেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি।

নিশ্চয়ই বুঝতে আর বাকি নেই যে, হ্যাডলি ছিলেন একজন সত্যিকারের ম্যাচ উইনার। টেস্টে ১১ বার এবং ওয়ানডেতে ১০ বার জিতেছেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার। টেস্টে সিরিজ সেরা হয়েছেন ৮ বার। তাঁর চেয়ে বেশিবার সিরিজ সেরা হয়েছেন শুধুমাত্র মুত্তিয়া মুরালিধরন (১১ বার) এবং জ্যাক ক্যালিস (৯ বার)।

লক্ষণীয় ব্যাপার হল, হ্যাডলির অভিষেকের পূর্বে ১০২ টেস্টে নিউজিল্যান্ডের ৪৬ টি হারের বিপরীতে জয় ছিল মাত্র ৭টি। আর হ্যাডলির খেলা ৮৬ টেস্টে নিউজিল্যান্ডের ২৮ হারের বিপরীতে জয়ের সংখ্যা ২২টি। পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট, নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে অবিসংবাদিত সেরা ম্যাচ উইনার স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে হ্যাডলির ইম্প্যাক্ট বোঝাতে এই একটা পরিসংখ্যানই যথেষ্ট।

মাইকেল হোল্ডিংয়ের ভাষায়, ‘He single-handedly converted New Zealand from a bunch of faceless amateurs to a world class fighting unit.’ শুধু তাই নয়, এই ২২ ম্যাচে হ্যাডলির শিকার ১৭৩ উইকেট; মাত্র ১৩.০৬ গড়ে! জেতা ম্যাচে কমপক্ষে ১৫০ উইকেট নেওয়া বোলারদের মধ্যে এটাই সেরা বোলিং গড়।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিসংখ্যান হল, হ্যাডলির খেলা টেস্টসমূহে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের যত উইকেট পড়েছে তার ৩৬% একাই নিয়েছেন হ্যাডলি। আর জেতা ম্যাচে সেটা প্রায় ৪১%!

স্যার রিচার্ড হ্যাডলির প্রিয় প্রতিপক্ষ ছিল ট্রান্স-তাসমান রাইভাল অস্ট্রেলিয়া। কিউইদের ‘পুরনো শত্রু’ অজিদের বিপক্ষে ২৩ টেস্টে তাঁর শিকার ১৩০ উইকেট; ২০.৫৬ গড়ে। ইনিংসে ৫ উইকেট ১৪ বার এবং ম্যাচে ১০ উইকেট পেয়েছেন তিন বার। উইজডেনের ভাষায়, ‘When it comes to wrecking the psyche of Australia, there was none better than Sir Hadlee.’

মজার ব্যাপার হল, বল হাতে হ্যাডলির হোম রেকর্ডের তুলনায় অ্যাওয়ে রেকর্ডই বেশি সমৃদ্ধ। দেশের মাটিতে ২০১ উইকেট নিতে যেখানে উইকেটপ্রতি তিনি খরচ করেছেন ২২.৯৬ রান, সেখানে নিউজিল্যান্ডের বাইরে ২৩০ উইকেট নিয়েছেন মাত্র ২১.৭২ গড়ে!

এমনকি উপমহাদেশের মরা উইকেটেও সফল ছিলেন হ্যাডলি। দু’বার ম্যাচে ১০ উইকেটসহ ১৩ টেস্টে নিয়েছেন ৬৮ উইকেট; মাত্র ২১.৫৮ গড়ে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...