ওয়াসিম ‘দ্য এলিগেন্ট’ রাজা
বড় ভাই রমিজ রাজা মোটামুটি কিংবদন্তীতুল্য পাকিস্তানি সাবেক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার ও অধিনায়ক, ছোট ভাই জাইম রাজা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার এবং তাঁদের বাবা রাজা সলিম আখতার নিজেও সরকারী চাকরিতে প্রবেশের পূর্বে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে খেলতেন। এমন একটি পরিবারে জন্ম নিলে রক্তে ক্রিকেটের নেশা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
১৯৫২ সালের ৩ জুলাই। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে রাজা সলিম আখতারের ঘরে জন্ম নিল এক পুত্রসন্তান। নাম তাঁর ওয়াসিম রাজা। ‘রাজা’ তাঁদের পারিবারিক পদবি হলেও, সেই পরিবারের রাজারা রাজত্ব করতো ক্রিকেটের দুনিয়ায়।
বড় ভাই রমিজ রাজা মোটামুটি কিংবদন্তীতুল্য পাকিস্তানি সাবেক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার ও অধিনায়ক, ছোট ভাই জাইম রাজা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার এবং তাঁদের বাবা রাজা সলিম আখতার নিজেও সরকারী চাকরিতে প্রবেশের পূর্বে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে খেলতেন। এমন একটি পরিবারে জন্ম নিলে রক্তে ক্রিকেটের নেশা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
শুধু কি ক্রিকেটে! রাজা প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায়ও রেখেছেন রাজত্বের ছাপ। ১৫ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তাঁর। তারপর তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন এবং সেখান থেকে তিনি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছিলেন।
এই প্রতিভাবান অলরাউন্ডার পাকিস্তানের হয়ে খেলেছেন ১৯৭৩-৮৫ এর সময়কালে। তিনি ছিলেন একজন চতুর লেগ–স্পিনার এবং একজন মার্জিত বাঁ–হাতি, যার চাপ শোষণ করার বিরল ক্ষমতা ছিল। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর টেস্টে অভিষেক ঘটেছিল, কিন্তু কিছু অসঙ্গতির কারণে দলে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকতেন তিনি। যদিও রাজা টেস্ট ঘরানায় ব্যাটিং দিয়ে ওইভাবে জ্বলে উঠতে পারেননি।
তিনি তখনকার বিশ্বের সেরা দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে কেন জানি দুর্দান্ত খেলেতেন। যেখানে তার ক্যারিয়ারের ব্যাটিং গড় ছিল ৩৬.১৭, কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এটি ৫৭.৪৪ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। সব মিলিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তার ১১ টেস্টে ৯১৯ রান এসেছে। তার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটিও ১৯৭৫ সালে করাচিতে ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে ছিল।
ওয়াসিম রাজার ওয়ানডে ব্যাটিং গড় ২২.৩৪ দিয়ে তাঁর অবদানের পরিপূর্ণ চিত্র বোঝা যায় না। ১৯৭৫ এ এজবাস্টনে পাকিস্তান বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার বিশ্বকাপ ম্যাচে পাকিস্তান প্রথম ব্যাট করতে নেমে ১৪০ রানে ৩ টি উইকেট হারিয়ে ওয়াসিম রাজাকে মাঠে নামায়। ৫৭ বলে ৫৮ রান করে তিনি পাকিস্তানকে ২৬৬ রানে নিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও কাকতালীয়ভাবে সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিততে সমর্থ হয়েছিল।
তখনকার ক্রিকেট বিশ্বে অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সবচেয়ে শক্তিশালী দল হিসেবে বিবেচনা করা হত। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে এমন যে একটি ইস্পাত চরিত্র দরকার ছিল, ওয়াসিম রাজা ছিলেন পাকিস্তান দলের সেই চরিত্রটি।
অনেকটা সিংহের গুহায় ঢুকে তাঁকেই বধ করার মতো ব্যাপারটা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ১৯৭৬-৭৭ সিরিজে রাজা পাঁচটি টেস্টে ৫৭.৪৪ গড়ে ৫১৭ রান করেছিলেন। যার মধ্যে পাঁচটি অর্ধ-শতক ও একটি শতরান আছে। তিনি ১৮.৭১ গড়ে সাত উইকেটও নিয়েছেন।
যদিও সেবার সিরিজটি পাকিস্তান হেরে যায়, তাঁরা পরে ত্রিনিদাদ টেস্টটি জিতে এবং এর নেপথ্যের নায়ক ছিলেন রাজা। সেবার দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি ৭০ রান করেছিলেন এবং শেষদিন তিনটি উইকেট তুলে নিয়েছিলেন। সমগ্র খেলোয়াড়ী জীবনে ৫৭ টি টেস্ট ও ৫৪টি একদিনের আন্তর্জাতিকে অংশগ্রহণের সুযোগ হয় তার। শেষবার মাঠে পা রেখেছিলেন ১৯৮৫ সালে।
রাজনীতি বরাবরই পাকিস্তানি ক্রিকেটে জড়িয়ে আছে। রাজা বোর্ডের আমলাতন্ত্রের সাথে মানিয়ে নিতে পারেননি। যার জন্য তাঁকে প্রায়ই দলে উপেক্ষা করা হত। রাজনীতির চক্করে না পড়লে রাজা তার দেশের জন্য আরও অনেক কিছু করতে পারতেন।
লোকমুখে একটি গল্প প্রচলিত যে, রাজা পাকিস্তানের অধিনায়ক হতে পারেননি কারণ তিনি একবার একজন সিনিয়রের মোজা শুকাতে দিতে অস্বীকার করেছিলেন। যদিও এ গল্পের সত্যতা আমাদের জানা নেই। তবে এইটুকু নিশ্চিত যে রাজার সাথে বোর্ডের সম্পর্ক ভালো ছিল না।
খেলোয়াড়ী জীবনকে বিদায় জানানোর পর তিনি ২০০২ থেকে ২০০৫ এর সময়কালে আইসিসি ম্যাচ–রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তখন তিনি ১৫টি টেস্ট এবং ৩৪টি ওয়ানডেতে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডে বসতি স্থাপন করেন এবং ব্যক্তিগত জীবনে অ্যান নামে একজন ইংরেজ নারীকে বিয়ে করেন এবং শিক্ষকতায় একটি সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন করেন। আলি ও আহমেদ নামে এই দম্পতির দুই ছেলে রয়েছে।
ক্রিকেটের প্রতি তাঁর এতোই ভালবাসা ছিল , বোধহয় সেই জন্যই ক্রিকেট খেলতে খেলতে মাঠেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন। পঞ্চাশোর্ধদের হয়ে খেলতে নেমেছিলেন বাকিংহ্যামশায়ারে ২০০৬ সালের ২৩ আগস্ট। ফিল্ডিংয়ের সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাঠেই তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভে যায়।
তার ভক্ত তালিকায় ছিলেন খোদ ওয়াসিম আকরামও। ওয়াসিম আকরাম প্রয়াত ওয়াসিম রাজাকে নিয়ে বলেন, ‘একদম কিশোর বয়সে, যে সমস্ত খেলায় ওয়াসিম রাজা খেলতেন আমি সেগুলো দেখতাম। তিনি কেবল তাঁর হার্ড–হিট করার ক্ষমতার জন্যই নয় বরং তিনি একজন ক্যারিশম্যাটিক চরিত্রের কারণেই দর্শকদের কাছে প্রিয় ছিলেন। তিনি ৭০–৮০ এর দশকে বেশিরভাগ তরুণদের আইডল ছিলেন।’
ওয়াসিম রাজাকে নিয়ে জাভেদ মিয়াঁদাদ বলেন, ‘আমরা একসাথে বেড়ে উঠেছি এবং শুধু সতীর্থ হিসেবেই নয়, প্রতিপক্ষ হিসেবেও খেলেছি। তিনি কেবল একজন সত্যিকারের ক্রীড়াবিদ ছিলেন না, একজন নিখুঁত ভদ্রলোকও ছিলেন। আমরা সেরা কয়েকটি ম্যাচ একসাথে খেলেছি। এমন একজন চমৎকার ক্রিকেটার, একজন ভালো ক্রীড়াবিদ এবং দেশের একজন সত্যিকারের দূতকে হারানো দু:খজনক।’
পাকিস্তান ক্রিকেট যতদিন থাকবে, ততদিন ‘দ্য এলিগেন্ট কিং অব পাকিস্তান ক্রিকেট’ – ওয়াসিম রাজার নামটি পাকিস্তান ক্রিকেটে উচ্চারিত হতে থাকবে। হ্যাঁ, এটা ঠিক তিনি একই সাথে যথেষ্ট আন্ডাররেটেডও। তবে, তাই সই!