লিটনের রান-তত্ত্ব

সেই চাওয়ায় তাকে গ্রেট ব্যাটারদের কাতারে দেখতে চাওয়ার অভিপ্রায়ও লুকিয়ে থাকে। কারণ ব্যাটার অনেকেই হন, ব্যাটারের সাথে শিল্পী কজন হন, ব্যাটের তুলি দিয়ে বাইশ গজে আঁচড় দিতে পারেন কজন! তাই লিটন অনন্য, লিটন অনিন্দ্য সুন্দর।

ক্যারিয়ারে তখনও আলো আসেনি। কখনও আঁধার, কখনও আলো- এই দোলাচলে ঝুলছে ক্যারিয়ার। সে সময়েই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭০ রানের ইনিংস খেললেন লিটন কুমার দাস।

লিটনের সেই ইনিংস দেখে কমেন্ট্রি বক্সে থাকা ইয়ান বিশপ বললেন, ‘লিটন দাস ইজ পেইন্টিং আ মোনালিসা হেয়ার?’ বাইশ গজে আঁকা সেই মোনালিসার চিত্রকর এখন পরিণত হয়েছেন। ক্রমেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে হয়ে উঠেছেন অন্যতম ভরসার নাম। বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে শত হতাশার গল্পের মাঝে লিটন দাশের ব্যাটিং যেন মুগ্ধ-জাগানিয়া এক দৃশ্যের নাম। 

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মাস দুয়েক আগে শেষ টি-টোয়েন্টি ফিফটি করেছিলেন। এরপর ৬ ইনিংস খেলেছেন। প্রতি ইনিংসেই দারুণ শুরু এনে দিয়েছেন। কিন্তু সেই ইনিংসটি আর বড় করতে পারেননি। তাই বড় একটি ইনিংসের খুব প্রয়োজন ছিল লিটনের। অবশেষে সেই অপেক্ষার অবসান ঘটেছে।

ত্রিদেশীয় সিরিজে পাকিস্তানের বিপক্ষে ফিফটি করে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে নিজের সপ্তম অর্ধশতক তুলে নিয়েছেন লিটন দাস। আর এ ফিফটিটা আসলো ঠিক তাঁর ২৮ তম জন্মদিনে। নিজের জন্মদিনটা রাঙিয়ে রাখলেন ৬৯ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে। 

লিটন দাস যখন আজ ব্যাটিংয়ে আসলেন তখন বাংলাদেশ ইনিংসে ঘোর অমানিশা। পাকিস্তানের শুরুর পেস অ্যাটাক যেন বুঝতেই পারছিলেন না সৌম্য-শান্ত জুটি। ইনিংসের তৃতীয় ওভারে সৌম্য সরকার আউট হয়ে গেলে উইকেটে আসেন লিটন দাশ। কাঠফাটা রোদ্দুরের মাঝে প্রশান্তির শীতল বাতাস নিয়ে যেন আবির্ভূত হলেন লিটন।

কথাটা উপামা অর্থে বলা, কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই, লিটন দাস যতক্ষণ উইকেটে ছিলেন ততক্ষণ যেন বাংলাদেশের ইনিংসে প্রশান্তিময় শীতল হাওয়া বইছিল। যদিও ইনিংসের শুরুতেই পায়ে চোট পেলেন। সেই চোট যে সাময়িক সেটাও নয়, ইনিংস জুড়েই বয়ে বেড়ালেন। কিন্তু স্ট্রেইট ড্রাইভ, কভার ড্রাইভ, ফ্লিকের নান্দনিকতায় চোটের দৃশ্য কি আর চোখে পড়ে! ভুবন ভুলানো সব শটেই যেন চোখের প্রশান্তি, আত্মিক তৃপ্তি। 

৬ চার আর ২ ছক্কায় ৪২ বলে ৬৯ রানের ইনিংস। ক্রিজে ছিলেন ৬৩ মিনিট। তবে সময়ের হিসেবে সে দৈর্ঘ্য টেলিভিশন সেটের সামনে দর্শক কিংবা মাঠে থাকা সমর্থক- দুইয়ের কাছেই ছিল কম। কারণ ততক্ষণে লিটনের নান্দনিকতায় মোহাচ্ছন্ন সবাই, লিটনের ব্যাটের রঙ-তুলিতে মুগ্ধতায় ডুবে গিয়েছে।

নওয়াজের বলে আউট হওয়ার পর তাই সহস্র সমর্থকদের কন্ঠে আক্ষেপের সুর, ইশ! আরেকটু যদি থেকে যেতে পারতেন। এত শৈল্পিকতায় ফ্লিক, ড্রাইভ, স্ট্রেট ড্রাইভ বাংলাদেশের কোন ব্যাটারদের ব্যাটেই বা দেখা যায়। তাই সমর্থকদের স্বল্প দেখা নান্দনিকাতেই তো চোখ আটকে থাকবে।

 নিজের ২৮ তম জন্মদিনে ফিফটি তুলে নেওয়ার দিনে দুটি রেকর্ডও গড়েছেন লিটন দাস। এর আগে লিটনের সর্বোচ্চ টি-টোয়েন্টি ইনিংস ছিল ৬১। পাকিস্তানের বিপক্ষে আজকের ৬৯ করার দিনে তাই আগের সর্বোচ্চ রানের ইনিংসকে ছাপিয়ে গেলেন তিনি।

আর বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে কম ইনিংসে(৫৯) ৭ ফিফটি করার আরেকটি কীর্তি গড়লেন তিনি। এর আগের রেকর্ডটি ছিল সাকিব আল হাসানের। তিনি ৬৮ তম ইনিংসে ৭ম ফিফটির দেখা পেয়েছিলেন। আর তামিম ইকবাল ৭৭ তম ইনিংসে করেছিলেন ক্যারিয়ারের সপ্তম হাফ সেঞ্চুরি। 

লিটন দাসের যে ইনিংসটির ব্যপ্তি বড় হয় সেটিই যেন দেখার মত চোখ জুড়ানো ইনিংস। সে ইনিংস দেখাতে থাকে না কোনো বিরক্তির ছাপ। তবে এমন ইনিংসের ধারাবাহিকতায় লিটন সমর্থকদের মুগ্ধতায় আরও আবেশিত করবে সেটিই তো চাওয়া।

সেই চাওয়ায় তাকে গ্রেট ব্যাটারদের কাতারে দেখতে চাওয়ার অভিপ্রায়ও লুকিয়ে থাকে। কারণ ব্যাটার অনেকেই হন, ব্যাটারের সাথে শিল্পী কজন হন, ব্যাটের তুলি দিয়ে বাইশ গজে আঁচড় দিতে পারেন কজন! তাই লিটন অনন্য, লিটন অনিন্দ্য সুন্দর।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...