টেনিসের অরণ্যদেবী

২০১৩ সালে প্রয়াত তার বাবা পিটার গ্রাফ ছিলেন গাড়ি আর বীমার সেলসম্যান, আর তাঁর সঙ্গে ছিল লন টেনিস কোচ হবার প্যাশন। স্টেফির যখন ৯ বছর, তখন (১৯৭৮) পাশের শহর ব্রুহিতে চলে যান তার পরিবার।

তিনি লন টেনিসের প্রবাদনারী স্টেফি গ্রাফ। ১৪ জুন ১৯৬৯ তারিখে পশ্চিম জার্মানির ম্যানহেইমে জন্মেছিলেন তিনি।২০১৩ সালে প্রয়াত তার বাবা পিটার গ্রাফ ছিলেন গাড়ি আর বীমার সেলসম্যান, আর তাঁর সঙ্গে ছিল লন টেনিস কোচ হবার প্যাশন।

স্টেফির যখন ৯ বছর, তখন (১৯৭৮) পাশের শহর ব্রুহিতে চলে যান তার পরিবার। এরই মধ্যে ৩ বছর বয়সে স্টেফিকে তিনি লন টেনিসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ঘরের লিভিং রুমে কাঠের ব্যাট (Racket) দিয়ে শুরু সেই সলতে পাকানোর পর্বে ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ ছিল পিটারদের বেশ কিছু আসবাবপত্র।

চার বছরের স্টেফি তারপর বাবার হাত ধরে যাবেন পাশের কোর্টে, পরের বছরেই খেলবেন একটা টুর্নামেন্টে, জিততে থাকবেন একের পর এক জুনিয়র টুর্ণামেন্টে, ১৯৮২-এর মধ্যে জিতে ফেলবেন ইউরোপিয়ান জুনিয়র টুর্নামেন্ট, এগুলো নিয়তিনির্দিষ্টই ছিল।

এগুলো ছিল সবার জন্য দৃশ্যমান, সবাই দেখেছিল। এর পিছনের ওই বয়সের হাড়ভাঙা পরিশ্রম কেউ দেখেনি, দেখতে দেননি পিটার। সেই পরিশ্রমের মালিকানা ও যন্ত্রণা ছিল একান্তই স্টেফির নিজস্ব। ১৯৮৫ অবধি তার কোচ ছিলেন বাবা পিটার গ্রাফ। ১৯৮৬-১৯৯১ পর্যন্ত সেই দায়িত্ব ছিল পাভেল স্লোজিলের উপর। আর ১৯৯২-১৯৯৯ অবধি তাঁর কোচ ছিলেন হেইঞ্জ গুনথার্ট।

১৯৮২-এর পরের ঘটনাগুলি অনেকটা গল্পের মত, কিন্তু আসলে সত্যি, যার পরতে পরতে সেই হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের বিদ্যুৎ আলো ছড়িয়েছিল। ১৩ বছর বয়সে, ১৮ অক্টোবর, ১৯৮২ তারিখে ‘পেশাদার লন টেনিস’ খেলোয়াড় হয়েছিলেন স্টেফি, দ্বিতীয় নবীনতম খেলোয়াড় হিসেবে আন্তর্জাতিক Rankingও পেয়েছিলেন ১৯৮২-তেই। প্রায় ১৭ বছর সার্কিটে থেকে ১৯৯৯ সালে ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দু’দিন আগে অবসর নিয়েছিলেন ডানহাতের খেলোয়াড়, এক হাতে ব্যাকহ্যান্ড মারায় অভ্যস্ত স্টেফি গ্রাফ।

আর সেই হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের নির্যাস ছিল ওই ১৭ বছরে বিশ্বের মহিলা টেনিসে তার একচ্ছত্র সাফল্যের কথা, যা ধরে রেখেছে বহু পরিসংখ্যান, যার কিছু কিছু তার খেলা ছাড়ার ২২ বছর পরে আজও চর্চিত হয়।

টানা ৩৭৭ সপ্তাহ ধরে (১৭ আগস্ট ১৯৮৭ থেকে ৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে) ১ নম্বর স্থান (Ranking) ধরে রাখেন তিনি। ২২ টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম সিঙ্গলস (৪ বার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯০ আর ১৯৯৪ সালে, ৬ বার ফ্রেঞ্চ ওপেন ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৩, ১৯৯৫, ১৯৯৬ আর ১৯৯৯ সালে, ৭ বার উইম্বলডন ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯১, ১৯৯২, ১৯৯৩, ১৯৯৫ আর ১৯৯৬ সালে এবং ৫ বার ইউ এস ওপেন ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯৩, ১৯৯৫, ১৯৯৬ সালে) জেতা ও একটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম ডাবলস (উইম্বলডন ১৯৮৮) জেতা, গ্যাব্রিয়েলা সাবাতিনিকে সঙ্গে নিয়ে।

১৯৮৩ থেকে গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেলা শুরু করে ৬ বছরের মধ্যেই ১৯৮৮ সালে ৪ রকমেরই গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতে ‘ক্যারিয়ার গোল্ডেন স্ল্যাম’ পান, সঙ্গে অলিম্পিক স্বর্ণপদকও জয় করেন। আর দু’বার করে সবকটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম তাঁর পাওয়া হয়ে গিয়েছিল ১৯৮৯ সালেই, ৭ বছর (১৯৮৩-১৯৮৯) গ্র্যান্ড স্ল্যামে খেলেই। ১৭ বছর ধরে (২০০৫-২০২১) গ্র্যান্ড স্ল্যামে খেলে গত বছর পুরুষ টেনিসে যে রেকর্ড করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন এখন বরেণ্য নোভাক জকোভিচ।

পাঁচটি ট্যুর ফাইনাল (১৯৮৭, ১৯৮৯, ১৯৯৩, ১৯৯৫ ও ১৯৯৬) জয়, একটি অলিম্পিক স্বর্ণপদক (১৯৮৮) জয়, মোট ১০৭ টি ক্যারিয়ার সিঙ্গলস টাইটেল ও ১১ টি ক্যারিয়ার ডাবলস টাইটেল জিতেন। ৮৮.৭ শতাংশ ক্যারিয়ার সিঙ্গলস ম্যাচ জয়ের রেকর্ড (৯০০-১১৫) ও ৭০.৬১ শতাংশ ক্যারিয়ার ডাবলস ম্যাচ জয়ের রেকর্ড (১৭৩-৭২) তাঁর দখলে।

পশ্চিম জার্মানি ও জার্মানির হয়ে দু’বার ফেডারেশন কাপ (১৯৮৭ ও ১৯৯২) জেতা এবং জার্মানির হয়ে একবার হফম্যানস কাপ (১৯৯৩) জয়ের কীর্তি আছে তাঁর।

২০০১ সালে আরেক খ্যাতনামা টেনিস তারকা আন্দ্রে আগাসিকে বিয়ে করে এখন লাস ভেগাসের স্থায়ী বাসিন্দা স্টেফি এক পুত্র ও এক কন্যার মা। তাদের টেনিসে আসা বা আগ্রহ নিয়ে একেবারেই নিরুত্তাপ আন্দ্রে-স্টেফি। লাস ভেগাসে তারই সঙ্গে থাকেন তার মা আর ভাইও।

১৯৯৮ সালে ‘চিলড্রেন ফর টুমরো’ নামের নন প্রফিট সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা-চেয়ারউওম্যানের নামও স্টেফি গ্রাফ। তাঁর আত্মজীবনীতে তার কথানুযায়ী, ‘This organization was established for implementing and developing projects to support children who have been traumatized by war or other crises.’

২০০১ থেকে স্টেফি তাঁর ইচ্ছানুযায়ী পরিচিত হন স্টেফানি মারিয়া গ্রাফ নামে। ২০০৪য়ে তিনি লন টেনিসের ‘হল অফ ফেম’-এ অন্তর্ভুক্ত হন। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এক বিশেষজ্ঞ প্যানেল ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তাকে ‘Greatest female tennis player of the 20th century’ হিসেবে নির্বাচিত করেছিল। ২০২০ সালের জুলাইয়ে ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার গত ৫০ বছরের ‘Greatest female tennis player’-এর বিশেষ নির্বাচনেও নিরঙ্কুশ আধিপত্যে জয়ী খেলোয়াড়ও ছিলেন তিনিই।

আধুনিক নারী টেনিসের ‘সিগনেচার টিউন’ অরণ্যদেবীরও বয়স বাড়ে, দু:খজনক হলেও এটা সত্যি জানিয়ে দেয় নিরুত্তাপ ক্যালেন্ডার। তাঁর টেনিস এবং সৌন্দর্য্য’র যোগফলে প্রায় চারটি দশককে আজও মোহিত করে রাখা মহিলা টেনিস।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...