জোগো বোনিতো, আসল ফুটবলের জনক

ইংল্যান্ড নয়, সত্যিকারের ফুটবলটা এসেছে স্কটল্যান্ড থেকে!- এমন কিছু শোনার পর আপনি অবাক হতেই পারেন। উড়ো কথা ভেবে আপনি উড়িয়েও দিতে পারেন। তবে ইতিহাসের পিছু ছুটলে আপনাকে আবার ভাবনার উদ্রেকে ডুবিয়েও দিতে পারে। এর জন্য আপনাকে ফিরে যেতে ১৮৮০ এর দিকে।

ইংল্যান্ড নয়, সত্যিকারের ফুটবলটা এসেছে স্কটল্যান্ড থেকে!- এমন কিছু শোনার পর আপনি অবাক হতেই পারেন। উড়ো কথা ভেবে আপনি উড়িয়েও দিতে পারেন। তবে ইতিহাসের পিছু ছুটলে আপনাকে আবার ভাবনার উদ্রেকে ডুবিয়েও দিতে পারে। এর জন্য আপনাকে ফিরে যেতে ১৮৮০ এর দিকে।

ইংল্যান্ড থেকেই তখন ফুটবলের শুরু। কিন্তু তখনকার ফুটবলটা ঠিক জমতো না। ঠিক তেমন দৃষ্টিনন্দন লাগতো না। আর সে কারণে টিকিট কেটে ফুটবল ম্যাচ দেখার প্রচলনও তখন শুরু হয় নি। ফুটবলের মত এমন একটা খেলা নিয়ে কেন তখন গণমানুষের আগ্রহ জমেনি? কারণ তখন তো আর ফুটবলটা এতটা শৈল্পিক ছিল না। দুই দলের খেলোয়াড়রা নিজেদের বল শুধু কিক করতো।

আর এভাবেই খেলাটা চলে আসছিল। মাঠে তেমন উপভোগ করার মুহূর্ত জমে না। দুই দলের খেলোয়াড়রা শুধু বল কিক করে। তখনকার ফর্মেশনও ছিল আবার ভিন্ন রকম। ইংলিশরা সে সময় ২-২-৬ কিংবা ১-২-৭ ফরম্যাশনে খেলতো। বলের পেছনে শুধু দৌড়ানো আর কিক মারা, এভাবেই উনবিংশ শতাব্দীর শেষ কোয়ার্টারে ফুটবল খেলা হয়ে আসছিল। 

তবে ১৮৭০ এর নভেম্বরের দিকে হঠাৎই এক ম্যাচের মাধ্যমে ফুটবলের সব কিছু পাল্টে গেল। বলা যেতে পারে, এক ধরণের বিবর্তন ঘটে গেল। স্কটল্যান্ডের সাথে ইংল্যান্ডের এক ম্যাচে হঠাৎই ফুটবলের অন্যরকম একটা চিত্র দেখা গেল। সেখানে দেখা গেল স্কটল্যান্ডের একজন ফুটবলার তাঁর অন্য প্লেয়ারদের সাথে পাস দিয়ে খেলছেন।

ফুটবল খেলায় কেউ কাউকে পাস দিচ্ছে, এমন কিছুর দৃশ্য ততদিনে দেখেনি পুরো বিশ্ব। এভাবে পাসিং এর সাথে বিশ্ব ফুটবলকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সেই মানুষটি ছিলেন জোগো বোনিতো। স্কটিশ এ ফুটবলারের নতুন টেকনিকে স্কটল্যান্ডে সে ম্যাচে ড্র করতে সক্ষম হয়েছিল, যা সে সময়ে বিশ্বাস করাও অনেকের জন্য কঠিন ছিল। কারণ তখন ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ড ফুটবলের মাঝে বিস্তৃত ফারাক। 

যাহোক, জোগো বোনিতোর সেই পাসিং স্টাইল মাঠে থাকা দর্শকদের খুব মনে ধরলো। ব্রিটিশ মিডিয়াতেও জোগো বোনিতোর পাসিং ফুটবল নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হল। ফুটবল ইতিহাসবেত্তাদের মতে, ফুটবলের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে জোগো বোনিতোর সেই প্লেয়িং স্টাইলের সূত্র ধরেই।

আর স্কটিশ-ইংলিশদের সেই ম্যাচের পরেই ফুটবলকে নিয়ে অন্যরকম একটা আগ্রহ তৈরি হয় মানুষের মাঝে। এরপরেই প্রথমবারের মত টাকা দিয়ে ফুটবল ম্যাচ দেখার প্রচলন শুরু হয়ে যায়। সবাই জোগো বোনিতোর খেলা দেখার জন্য দূর শহর থেকে ছুটে আসত। ফুটবলের জনপ্রিয়তার পালে হাওয়া লাগে এ সময় থেকেই। 

এখন প্রশ্ন হল, সত্যিকারে ফুটবল স্কটল্যান্ড থেকে কিভাবে এসেছে। প্রথম কারণ হচ্ছে, ইংল্যান্ডে ফুটবল খেলার জন্ম হলেও আজকের ফুটবলের যে বিবর্তন তাঁর শুরুটা হয়েছিল স্কটল্যান্ড থেকে। কারণ পাসিং ফুটবল দিয়ে খেলায় ভিন্নতা এনেছিলেন বোনিতো। এখন পর্যন্ত পাওয়া টিকি টাকা ফুটবল কিংবা নেদারল্যান্ডসের টোটাল ফুটবলের টেকনিক- সবকিছুই জোগো বোনিতোর কৌশলের সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ ফুটবলের ছন্দময় গতি, উত্তাল সাগর তরঙ্গের মত আক্রমণ, শৈল্পিক ছোঁয়া এসেছে জোগো বোনিতোর হাত ধরেই। আর এ কারণেই, স্কটল্যান্ড থেকে যে সত্যিকারের ফুটবল এসেছে, সেই কথায় তেমন ভুল বের করা যায় না। 

১৮৬৭ সালে স্কটল্যান্ডে কুইন্স পার্ক ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এ ক্লাবের হাত ধরেই ফুটবলের ট্যাক্টিসের অদ্ভুত এক বিশ্বায়ন ঘটে। বার্সেলোনা যে নিজেদের টেকনিকে আজ বহুল পরিচিত তাঁর সূত্রপাত হয়েছিল এই কুইন্স পার্ক ক্লাব থেকেই। শুধু বার্সা নয়, টটেনহ্যাম থেকে মিডলসবার্গ, স্পার্স থেকে ওয়েস্ট ব্রম, আয়াক্স- এমন বড় বড় ক্লাবেরও প্রথম দিকের কোচ ছিলেন কুইন্স পার্ক ক্লাবের ছাত্র। এমনকি টোটাল ফুটবলের জনক ইয়োহান ক্রুইফেরও দীক্ষা হয়েছে এ ক্লাব থেকে।

এবার আসা যাক, ব্রাজিলের ফুটবল খেলার উত্থানে স্কটিশদের ভূমিকা কতটুকু তা নিয়ে। ১৮৯৪ সালে থমাস দোনাহিউ আর চার্লস মিলার নামে দুই স্কটিশ ব্রাজিলে পাড়ি জমান। দোনাহিউ সেখানে বাগু অ্যাথলেটিক ক্লাব নামে একটি ফুটবল ক্লাব তৈরি করেন। আর এই ক্লাবই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গদের ফুটবল খেলার অনুমতি দিয়েছিল।

এ দিকে মিলারও একটি ফুটবল ক্লাব তৈরি করেন। নাম দেন সাউ পাওলো অ্যাথলেটিকো ক্লাব। এভাবে আরও একটি দল নিয়ে ব্রাজিলে একটি ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপ শুরু হয়। মিলার, দোনাহিউ, নিজেরাও খেলতেন সেখানে। একটা সময় পরে এসে রেফারির দায়িত্বও পালন করেছেন। ব্রাজিলের ফুটবলটা শুরু হয় ঠিক এভাবেই। 

এর কিছু বছর বাদে ব্রাজিলে আরও দুজন স্কটিশ ব্রাজিলের এসে ফুটবলের সাথে জড়িয়ে যান। হক হ্যামিল্টন আর আরকি ম্যাকলেন নামে এ দুজন স্কটিস, প্রথমে ব্রাজিলে পাসিং ফুটবল শুরু করেন। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলাররও সেই কৌশল অনুশীলনে রপ্ত করার চেষ্টা করতেন। জোগো বোনিতো সেই পাসিং ফুটবল ইংল্যান্ডের বাইরে এসে এবার পরিচিত হয় দক্ষিণ আমেরিকায়। আর ব্রাজিলকে দিয়েই সেটি শুরু হয়। এরপর অন্য দেশগুলোতে বিস্তৃতি লাভ করতে শুরু করে।

স্কটিশদের শেখানো সেই কৌশলকে অবলম্বন করেই ব্রাজিল একসময় ফুটবল বিশ্বের মহা পরাক্রমশালী দল হয়ে ওঠে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৫ বার বিশ্বকাপ  শিরোপা জিতেছে তারা। তবে তাদের এমন বিবর্তনের পেছনে ছিল স্কটিশ কিছু মানুষ। ফুটবল মানচিত্রে স্কটল্যান্ড খুব বড় নাম না, বিশ্বকাপেও তাদের এখন দেখা মেলে না। কিন্তু প্রাচীন ফুটবল থেকে আধুনিক ফুটবলের ট্যাক্টিস কিংবা আধুনিক ফুটবলের শুরুর ধাপটা হয়েছিল তাদের হাত ধরেই।

বিখ্যাত ফুটবল ইতিহাসবেত্তা জন লিস্টার তাঁর বই ‘দ্য স্কটিশ ওয়ার্ল্ড: আ জার্নি ইন টু স্কটিশ ডায়াসপোরা’ তে লিখেছেন, ফুটবল বলতে আমরা যে খেলাটা বুঝি তাঁর শুরুটা স্কটল্যান্ডেই। শুধু ব্রাজিল ফুটবল নয়, পুরো বিশ্বের ফুটবলেই স্কটল্যান্ডের ভূমিকা আছে। স্কটল্যান্ডই সত্যিকারের ‘হোম অফ ফুটবল’। 

জোগো বোনিতো আসল ফুটবলের শুরুটা করেছিলেন। ফুটবলে যে চারাগাছ তিনি বুনে গিয়েছিলেন শতবর্ষ পরে সেই ফুটবল এখন ফসলে পরিণত হয়েছে। যে ফসল সক্রেটিস,জিকোদের বিচরণে হয়েছে শৈল্পিক সৌন্দর্যের পূণ্যভূমি। আর এখন সেই সৌন্দর্য্য ধরে রাখছেন মেসি, রোনালদোরা। যুগের পর যুগ স্কটিশদের সেই আসল ফুটবলের ধারা অনুযায়ী চলে আসছে, ভবিষ্যতেও আসবে। আর সুন্দর এ ফুটবলের আবিষ্কারক জোগো বোনিতো তো বিশ্ব ফুটবলের মন্ত্র মনের গহীনে অনেক আগেই পৌঁছে গিয়েছেন। কারণ সুন্দরের ধারক সব সময় অপরাজেয়, অপরাজিত।   

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...