একটি নিভুনিভু হৃদস্পন্দনের গল্প

পোস্ট-মর্টেমে অবশেষে ধরা পড়েছিলো ক্ষতিগ্রস্ত ধমনি, যা এত বছর অজানাই ছিলো। দ্য ক্রিকেটারে সাইমন হিউজ লিখেছিলেন, ‘কেউ যদি তাঁর নিভুনিভু হৃদস্পন্দনটা ধরতে পারতেন, যদি তাঁর হৃদপিণ্ডে একটা পেইসমেকার বসানো যেত, তাহলে এই গল্পটা বলার জন্য আজ স্ল্যাক বেঁচে থাকতেন।’

সংবাদ প্রতিদিনের প্রতিবেদনে দেখলাম মমতা ব্যানার্জি সৌরভ গাঙ্গুলিকে দেখতে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন এমনটা কীভাবে হলো। দাদা উত্তরে বলেছেন, ‘বড় ম্যাচ বা টুর্নামেন্টের আগে খেলোয়াড়দের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় না।’ এটা দেখার পর আমার অনেকদিনের একটা উপলব্ধি আরো জোরালো হলো- যেকোনো খেলাতেই মৌসুমের শুরুতে খেলোয়াড়দের সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং অতি অবশ্যই *ইসিজি* করানো জরুরি। কেন এমনটা মনে হয়, বলছি।

১৯৮১ অ্যাশেজের হেডিংলি টেস্ট শেষ হবার পর পেরিয়ে গেছে প্রায় চার দশক। এখনো সেই ম্যাচ নিয়ে বহুল চর্চা, আলোচনা হয়। সেই ম্যাচে গ্রাহাম ডিলিকে সঙ্গে নিয়ে স্যার ইয়ান বোথাম যখন অজিদের প্রতি আক্রমণ করছিলেন, তখন সাড়ে তিন ঘন্টার ট্রেন দূরত্বে লর্ডসে চলছিলো অসামান্য প্রতিরোধ। ২৩৭ রানে পিছিয়ে থেকে উস্টারশায়ারের বিপক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করছে মিডলসেক্স। স্কোরবোর্ডে কোনো রান না উঠতেই ফিরে গেছেন দুই ব্যাটসম্যান। এমতাবস্থায় হাল ধরলেন উইলফ স্ল্যাক।

না, বোথামের মতো প্রতিআক্রমণ নয়। ধীরেসুস্থে, ঠাণ্ডা মাথায় নিজের সহজাত ভঙ্গিতে রান তুলে গেছেন স্ল্যাক। শেষ অবধি ৭ উইকেটে ৪৪৪ রান নিয়ে ইনিংস ঘোষণা করে মিডলসেক্স, স্ল্যাক অপরাজিত থাকেন ২৪৮ রানে।

ইংল্যান্ড যখন সবচাইতে বড় মঞ্চে সবচাইতে বড় মিরাকলগুলোর একটি মঞ্চস্থ করে, তখন মিডলসেক্সের মিডল অর্ডারে নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত করে ফেলেন উইলফ স্ল্যাক।

ইংল্যান্ড অ্যাশেজ যখন খোয়ানো-পুনরুদ্ধার নিয়ে উত্তাল, তখন ঠিক বিপরীত চরিত্র নিয়ে দৃশ্যপটে আবির্ভাব উইলফ স্ল্যাকের। সেন্ট ভিনসেন্টে জন্ম নেয়া স্ল্যাক পরিবারসহ যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান বারো বছর বয়সে।

নিয়মিত দৃশ্য, মাঠে লুটিয়ে পড়েছেন স্ল্যাক

সময়ের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলারদের অমিত সাহসের সঙ্গে খেলে সাজঘরে ফিরে খুব একটা কথা বলতেন না স্ল্যাক। নিজের জায়গায় বসে ধীরে ধীরে প্যাডগুলো খুলে রেখে আপন মনে চুপচাপ বসে থাকতেন। সাইমন হিউজের মতে, ‘He was deeply religious, which was possibly an explanation for such contemplation.’

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি। তিন টেস্টে সাড়ে তেরো গড়ে মাত্র ৮১ রান এবং দুটো একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে সাড়ে ২১ গড়ে ৪৩ রান। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ছিলেন বেশ সফল। ২৩৭ ম্যাচে ৩৯ ছুঁইছুঁই গড়ে ২৫ সেঞ্চুরির সাহায্যে তার সংগ্রহ ১৩,৯৫০ রান। তবে সবচাইতে চোখে লাগার মতো ব্যাপার হলো ২৩৭ ম্যাচে ক্যাচ ধরেছিলেন ১৭৪ টি।

যে সময়ের কথা বলছি, তাঁর আগের দুই মৌসুম মিলিয়ে মোট চারবার মাঠেই মূর্ছা গেছেন স্ল্যাক। প্রতিবারই তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে এবং বড়জোর সপ্তাহ দুয়েক পরেই তিনি মাঠে ফিরেছেন৷ তবে স্ল্যাক কেন বারবার এমন পরিস্থিতিতে পড়ছেন, সেটা চিকিৎসকরা ধরতে পারেননি।

অ্যাশেজ সফরে একবার হোবার্টে নেট করার একইভাবে মাটিতে পড়ে গেছিলেন। মিকি স্টুয়ার্ট সেই স্মৃতি স্মরণ করেছেন এভাবে, ‘আমি ওকে কেবলই দেখলাম ঠিকঠাক, পরমুহূর্তেই ও মাটিতে লুটিয়ে পড়লো আর ওকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হলো। আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি যে ও জীবনঘাতী রোগে ভুগছে।’

১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে স্ল্যাক ক্যাভালিয়ারস একাদশের হয়ে ইসরায়েল, বার্বাডোজ ও গাম্বিয়াতে প্রীতি সফরে গিয়েছিলেন৷ গাম্বিয়া সফরে ১৯৮৯ এর ১৫ জানুয়ারি এক ম্যাচে ব্যাট করার সময় একইভাবে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন স্ল্যাক। দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হলেও এযাত্রায় আর সেরে ওঠেননি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৩৪ বছর ৩৪ দিন।

পোস্ট-মর্টেমে অবশেষে ধরা পড়েছিলো ক্ষতিগ্রস্ত ধমনি, যা এত বছর অজানাই ছিলো। দ্য ক্রিকেটারে সাইমন হিউজ লিখেছিলেন, ‘কেউ যদি তাঁর নিভুনিভু হৃদস্পন্দনটা ধরতে পারতেন, যদি তাঁর হৃদপিণ্ডে একটা পেইসমেকার বসানো যেত, তাহলে এই গল্পটা বলার জন্য আজ স্ল্যাক বেঁচে থাকতেন।’

সে বছর মিডলসেক্সের ক্রিকেটারদের মৌসুম-পূর্ব স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ইসিজি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো। দ্য গার্ডিয়ানে মাইক সেলভি লিখেছিলেন, ‘Slack had breathed his last in perhaps the best possible way for a cricketer and the way Slack would have preferred to have died- with the sun on his back and runs under his belt.’

পরিশেষে, দাদার দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি। সাথে সাথে আশা করছি যে, সব ধরনের খেলা শুরু হবার পূর্বে খেলোয়াড়দের স্বাস্থ্য পরীক্ষার গুরুত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহ দ্রুতই অনুধাবন করতে পারবেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...