লরেন্স রো – সাবেক জ্যামাইকান ব্যাটিং কিংবদন্তি। এই নামটির সাথে যারা পরিচিত নন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, টেস্ট অভিষেকের এক ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি, আরেক ইনিংসে সেঞ্চুরি হাঁকানো একমাত্র ক্রিকেটার হলেন লরেন্স রো। ১৯৭২ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ইতিহাসের বিরলতম এই কীর্তি গড়েন তিনি।
ডানহাতি টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান লরেন্স রো বিখ্যাত ছিলেন তাঁর স্টাইল, গ্রেস এবং অ্যাগ্রেসনের কারণে। তাঁর ট্রেডমার্ক শট ছিল তিনটি — হুক, ব্যাকফুট ড্রাইভ এবং লেট কাট। তাছাড়া স্পিনারদের বিপক্ষে তাঁর পায়ের কাজ ছিল দেখার মতো।
লরেন্স রো’র সবচেয়ে বিখ্যাত ইনিংসটি ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে (৪৩০ বলে ৩০২)। গুণে গুণে তিন ডজন বাউন্ডারি মেরেছিলেন তিনি! একমাত্র ছক্কাটি মেরেছিলেন বব উইলিসের বাউন্সারে হুক করে। শটটির টাইমিং নাকি এতটাই নিখুঁত আর জোরালো ছিল যে একে ‘গাইডেড মিসাইল’ এর সাথে তুলনা দিয়েছেন স্যার গ্যারি সোবার্স।
বিখ্যাত এই শটের বর্ণনা দিয়েছেন সাবেক উইজডেন সম্পাদক গিডিওন হেইগ, ‘A flat hook off Bob Willis, that went straight into the stands over square-leg, almost at head height.’
৩০ টেস্টে সাত সেঞ্চুরি, ৪৩.৫৫ গড়ে ২০৪৭ রান। পরিসংখ্যান লরেন্স রো’র গ্রেটনেস বোঝাতে পারবে সামান্যই। তাঁর যা সামর্থ্য ছিল, সে তুলনায় অর্জন কিছুই না। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, লরেন্স রো ছিলেন একজন আন্ডার-অ্যাচিভার।
লরেন্স রো’র ক্যারিয়ারের সূচনাটা ছিল আলোর ঝলকানির মত চোখ ধাঁধানো, কিন্তু শেষটা ছিল ততটাই মলিন। প্রথম ১২ টেস্টে ৭০.৬৯ গড়ে ১১৩১ রান; ৫ সেঞ্চুরির মধ্যে ১টি ডাবল, ১টি ট্রিপল! নিঃসন্দেহে ফিনমিনাল নাম্বার্স! ততদিনে তিনি পেয়ে গেছেন বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যানের স্বীকৃতি। এমনকি তাঁকে তুলনা করা হচ্ছিল স্যার ডন কিংবা ‘কালো ব্র্যাডম্যান’ খ্যাত জর্জ হেডলির সাথে।
অথচ সেই একই ব্যাটসম্যানের শেষ ১৮ ম্যাচে মাত্র ২ সেঞ্চুরি, ব্যাটিং গড় নেমে গিয়ে ঠেকেছে চল্লিশের কোটায়!
লরেন্স রো’র মত অমিত সম্ভাবনাময় ও তুখোড় ব্যাটসম্যানের এভাবে হারিয়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল অসুস্থতা। ১৯৭৫ সালে ডার্বিশায়ারের হয়ে ইংল্যান্ডে কাউন্টি খেলতে গিয়ে আক্রান্ত হন রহস্যজনক অসুখ ‘গ্রাস এলার্জি’তে। ঘাসের সংস্পর্শে এলেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন তিনি, জ্বর আসত, প্রচণ্ড মাথাব্যথা করত।
কিন্তু, তারপরও খেলা চালিয়ে গেছেন লরেন্স রো। অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে ব্রিসবেনের বাউন্সি ট্র্যাকে দুর্দান্ত সেঞ্চুরিও (১০৭) হাঁকিয়েছেন।
তবে বিপত্তিটা বাঁধল ১৯৭৬ সালে ভারতের বিপক্ষে হোম সিরিজে। এরই মধ্যে জানা গেল, হঠাৎ করেই তাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাছে, বল দেখতে পাচ্ছেন না ঠিকমত। ওই সিরিজটা খুব বাজে গিয়েছিল রো’র জন্য , ৪ ম্যাচে কোন ফিফটি ছাড়া ২৯ গড়ে করলেন মাত্র ১৭৯ রান। পরে দেখা গেল, চোখের বিরলতম রোগ টেরিজিয়ামে (Pterygium) আক্রান্ত হয়েছেন তিনি।
একটা পর্যায়ে ডান চোখে কিছুই দেখতেন না রো! বাম চোখও আংশিকভাবে সংক্রমিত হল। এই অবস্থায় আর যাই হোক ক্রিকেট খেলা সম্ভব নয়। কিন্তু লরেন্স রো হার মানবার পাত্র নন, চোখে সার্জারি করিয়ে তিন বছর পর আবার ফিরে আসেন তিনি। ঝাপসা দৃষ্টিশক্তি নিয়েই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ব্রিসবেন টেস্টে হাঁকান ফিফটি, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রাইস্টচার্চে হাঁকান সেঞ্চুরি।
কিন্তু না, এভাবে বেশিদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি তাঁর পক্ষে। ১৯৮০ সালে অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা টেস্টটিই হয়ে রইল তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। বলাবাহুল্য, সেই ম্যাচেও ফিফটি করেছিলেন তিনি।
স্যার গ্যারি সোবার্সের মতে, ‘টেকনিক, পাওয়ার, রিফ্লেক্স — একজন গ্রেট ব্যাটসম্যান হতে গেলে যা যা থাকার দরকার তার সবই ছিল লরেন্স রো’র মধ্যে। সামর্থ্য অনুযায়ী খেলতে পারলে ও হতে পারত ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান।’
মাইকেল হোল্ডিংয়ের ভাষায়, ‘লরেন্স রো আমার দেখা ফাইনেস্ট ব্যাটসম্যান এভার।’ নি:সন্দেহে বিশ্বসেরা হওয়ার সামর্থ্য তাঁর ছিল, কিন্তু সেটা তিনি পারেননি!