ক্যালসিওর দৈত্য

১৮৯৯ তে কিছু শিল্পপতি, সুইস এবং ইংরেজ ফুটবলাররা স্থানীয় জিমন্যাসিয়াম সোসাইটির সাথে মিশে প্রতিষ্ঠা করেন ফুটবল ক্লাব। এবং সবাইকে চমকে দিয়ে জেনোয়ার একাধিপত্যের মাঝে ১৯০১ সালে জিতে নেয় ইতালীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা। ‘ইল লর্ড’ হারবার্ট কিলপিনের হাত ধরে জন্ম হয় এক ইউরোপিয়ান ফুটবল সাম্রাজ্যের এক সম্রাট-এসি মিলান।

ইতালি। ফুটবলের দৈত্যদের মধ্যে অন্যতম নাম। চিরকাল দুর্ভেদ্য ডিফেন্সের জন্য পরিচিত দলটি এবার অনেককেই চমকে দিয়েছে তাদের দুরন্ত আক্রমনাত্মক খেলা দিয়ে।

তবে আজকের গল্প ২০২১ এর নয় বরং আঠেরো শতকের। আজ্জুরির ফুটবলের একদম শুরুর দিকের কথা। প্রামাণ্য সেরকম নথি না থাকলেও বলা হয়ে থাকে ১৮৮০ সালে ব্রিটিশ টেক্সটাইল কোম্পানির এডুয়ার্ডো বোসিও এর হাত ধরেই ইংল্যান্ড থেকে ইতালিতে আসে ফুটবল। বোসিওই তৈরি করেন ইতালির সর্বপ্রথম ক্লাব তুরিনে। তারপর খেলার প্রসার ঘটতে থাকে লিভোরনো, জেনোয়া, পালেরমো, নেপলস বন্দরে।

তবে ইতালির ফুটবলের শুরুর দিক প্রায় পুরোটাই বিতর্কিত এবং রাজনীতির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। ১৯০৯ সালে দেশের ফুটবল প্রধানরা খেলাটির নাম দেন স্থানীয় ভাষায় ক্যালসিও।

এই নামটিও কিন্তু রাজনৈতিক। তাঁদের উদ্দেশ্যই ছিল যাতে ইংরাজি শব্দ না ব্যবহার করতে হয়। জার্মানরা যেমন খেলাটির নামবদল ঘটিয়ে স্থানীয় ভাষায় ফুসবল নাম দেন, ঠিক সেভাবেই ইতালীয়রা বদলে দেন নামটিকে।

রেঁনেসার সময়কালে ক্যালসিও ফিওরেন্তিনো বলে একটি খেলা হত ফ্লোরেন্সে। রাগবি আর ফুটবলের সংমিশ্রণ। সেই সূত্র ধরেই ফুটবলের জনক হিসেবে প্রচার করতেই এই নামবদল।

মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট সময়ে এই ফুটবলের জাতীয়তাকরণ আরও বাড়ে। প্রখ্যাত সাংবাদিক ব্রেরা পরবর্তীকালে জোরালো দাবি করেন যে ইংরেজরা মোটেই খেলা টির উদ্ভাবক নয়, তারা এই ক্যালসিও খেলাটিরই সামান্য পরিবর্তন করেছে। তবে তর্ক বিতর্ক যাই ই হোক না কেন,শেষ পর্যন্ত অফিসিয়াল শব্দ হিসেবেই ইতালির ফুটবলে জায়গা করে নেয় ক্যালসিও শব্দটি।

তবে সমস্যা হয় অন্যত্র। ক্যালসিও এর সাথে আজকের ফুটবলের কোন মিলই নেই। ১৩০০ এর সময় থেকে বলগেমের বিরোধিতা করা হয়েছে চার্চ থেকেই। তবে ক্যালসিও প্রথমে নিরীহ খেলা হিসেবে প্রবর্তন হলেও পরের দিকে বদলে যায় সম্পূর্ণ গুন্ডামিতে। দুই দল,প্রত্যেক দলে সাতাশ জন করে খেলোয়াড় (৯-৯-৯ ফর্মেশন?) ,ছজন রেফারি নিয়ে শুরু হত খেলা হাত অথবা পা দিয়ে। গোলকিপার তিনজন। এন্ড লাইনের বাইরে গেলেই পয়েন্ট। আজকের দিনে গোলের মতন। খানিকক্ষণ পরেই খেলা বদলে যেত বল ছাড়া মারদাঙ্গায়। কয়েকদিনের মধ্যে ই এমন অবস্থায় পৌঁছয় যে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় খেলাটিকে।

তবে ক্যালসিওর আবার পুনর্জন্ম হয় বিদেশি টুরিস্টের সৌজন্যে। তাদের মনোরঞ্জনের জন্য আবার নতুন ভাবে আনা হয় খেলাটিকে,অবশ্যই বেশ কিছু নিয়ম কানুন বদল করে। তাতে অবশ্য বিপত্তি আটকানো যায়নি। ২০০৫ সালের ক্যালসিও প্রতিযোগিতাটিকেই বাতিল করে দেওয়া যায় অত্যধিক মারামারির জন্য।

তবে এডুয়ার্ডো বোসিও এর হাত ধরেই সাবালক না হোক, হামাগুড়ি দিতে শেখে ইতালিয়ান ফুটবল।

১৮৯১ তে প্রথম ফুটবল ক্লাব তৈরি করেন তিনি নিজের সহকর্মীদের নিয়ে। নাম দেওয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল ক্লাব। কিন্তু সমস্যা হয় বিপক্ষ খুঁজে পেতে। কারণ দেশে তখন এই একটিই ফুটবল দল। খেলায় না আছে রেফারি, না আছে কোন ফেডারেশন,না আছে খেলার মাঠ।

বিভিন্ন রিপোর্টে পাওয়া যায়, খেলা চলাকালীন দলের খেলোয়াড় সংখ্যা বেড়ে যেত। দর্শকরা নেমে আসতেন যেকোন দলের হয়ে খেলার জন্য। শেষে মাঠে বল না খুঁজে পাওয়া গেলেও খেলোয়াড়ের অভাব হত না ম্যাচে। তবে বোসিও কে দেখেই তৈরি হয় পরবর্তী দল। ১৮৯৩ সালে জেনোয়ার জন্ম হলেও প্রথমে তাতে সদস্যপদ ছিল না কোন ইতালীয়র। ইংরেজ ডাক্তার স্পেনসলির হাত ধরেই জন্ম নেয় ক্লাবটি। পরের দিতে অবশ্য নিয়মের বদল হয়। খেলোয়াড় ও সদস্য হন ইতালীয়রা।

৬ জানুয়ারি ,১৮৯৮ তে সরকারী হিসেবে প্রথম খেলা হয় জেনোয়া বনাম ফুটবল ক্লাব টোরিনেসের মধ্যে। মাঠে উপচে পড়া দর্শকে গোটা ম্যাচের ইভেন্টে লাভ হয় তখনকার দিনে একশো ইতালীয় লিরা। প্রথম চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই ও শুরু হয় তারপরেই। জেনোয়ার জয়ই প্রথম সাফল্য বলে ধরা হয় ইতালীয় ফুটবলের ইতিহাসে।

১৮৯৯, ১৯০০, ১৯০২, ১৯০৩, ১৯০৪-এ একচ্ছত্র দাপটে জেনোয়া হয়ে ওঠে ইতালীয় ফুটবল সাম্রাজ্যের অধিপতি। যাঁর হাত ধরে জেনোয়ার পথ চলা শুরু, সেই স্পেন্সলি নিজেও ছিলেন দলের গোলরক্ষক,পরে অবশ্য হন লেফট ব্যাক। পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি ছিলেন সামরিক ডাক্তার, সেখানেই জার্মানির এক হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়, একেবারে একা, কোন পরিচিত, পরিজন ছাড়াই।

ইতালিয়ান ফুটবলের বর্তমান আসল দৈত্যদের তাদের শুরুর গল্পটা বলেই এই গল্পের সমাপ্তি। ১৮৯৭ তে ফিয়াট ম্যাগনেট আগনেলি এবং লেভির হাত ধরে শুরু হয় তুরিন স্পোর্টস ক্লাব। সেই যুব দলের নাম হয় জুভেন্টাস। বর্তমানে ওল্ড লেডি নামে বিখ্যাত দলটি ইতালীর ফুটবলের সর্বকালের সেরা সর্বাধিক জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতার তকমা নিয়ে।

১৮৯৯ তে কিছু শিল্পপতি, সুইস এবং ইংরেজ ফুটবলাররা স্থানীয় জিমন্যাসিয়াম সোসাইটির সাথে মিশে প্রতিষ্ঠা করেন ফুটবল ক্লাব। এবং সবাইকে চমকে দিয়ে জেনোয়ার একাধিপত্যের মাঝে ১৯০১ সালে জিতে নেয় ইতালীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা। ‘ইল লর্ড’ হারবার্ট কিলপিনের হাত ধরে জন্ম হয় এক ইউরোপিয়ান ফুটবল সাম্রাজ্যের এক সম্রাট-এসি মিলান।

এবং অতি অবশ্যই ইন্টার যারা বর্তমানে ইতালিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের বিজয়ী। ১৯০৮ সালে মিলান দল থেকে বেরিয়ে এসে রেঁস্তোরা ‘দি ক্লক’ এ বসে শিল্পী জর্জিও মুজিয়ানি তৈরি করেন ফুটবল দল বিয়াল্লিশ জন বিদ্রোহী নিয়ে। অনেক পরে দীর্ঘদিন ধরে দলের আইনজীবী প্রিসকো মজা করে বলেছিলেন, ‘সবাই ভাবে আমরা মিলান থেকে এসেছি,আসলে আমরা কোথাও থেকেই আসিনি।’

মিলান থেকে বিচ্ছেদের বহু কারণের একটা মূল কারণ ছিল ইতালিয়ান ও বিদেশি ফুটবলার দের বিরোধ। গোঁড়া ইতালীয় দের অনেকেই রাজি ছিলেন না মিলান দলে বিদেশী খেলোয়াড়দের জায়গা দিতে। সেই বঞ্চনা থেকেই জন্ম হয় ইন্টারের। প্রথম ইন্টার দলের আটজনই ছিলেন সুইস। প্রথম দুবারের সাক্ষাতেই ইন্টার ধ্বংস করে দেয় মিলান কে দুই ম্যাচে দশ গোল দিয়ে। একে প্রতিশোধ বলা হোক, কি বঞ্চনার জবাব, খুব শীঘ্রই মিলান ডার্বির দামামা বাজিয়ে দেয় ইন্টার মিলান।

শুরু হয় ইতালীয় ফুটবলের জয়যাত্রা এবং ক্যালসিওর উত্থান।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...